ঢাকায় আমরা কেমন আছি-এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন। প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘অন্ধ নাকি? দেখতে পাচ্ছেন না?’ যাঁরা একটু রসিক প্রকৃতির, তাঁরা পরিহাসের সুরে বলতে পারেন, ‘তা আর বলতে!’

কিন্তু প্রশ্নটা আসলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো অর্থহীন নয়। আমরা ভালো নেই, এটা আমরা সবাই জানি। অনেকেই মনে করেন, আমরা ভীষণ খারাপ আছি। কিন্তু আমরা আছি, এই মহানগরে আমাদের জীবন পুরোপুরি থেমে যায়নি। এখানে বসবাস করা আর একদমই সম্ভব হচ্ছে না বলে কেউ এ শহর ছেড়ে চলে গেছেন, তা-ও হয়তো নয়। অবশ্য অনেকেই স্থায়ীভাবে প্রবাসে চলে গেছেন; কিন্তু কোনো উপায়ই আর অবশিষ্ট ছিল না বলে তা করেছেন, এমনও হয়তো নয়। তবু ঢাকায় আমরা কেমন আছি, এই প্রশ্ন অনর্থক নয়। এটা আত্মজিজ্ঞাসা। রুগ্ণ পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকলে একপর্যায়ে স্নায়ুবৈকল্য ঘটতে পারে; তখন রোগীর পক্ষে নিজের প্রকৃত অবস্থা বোঝা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৮ সালের গ্লোবাল লিভেবলিটি ইনডেক্স বা বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতার সূচক বলছে, পৃথিবীর যেসব মেগাসিটি বা বড় শহরের বসবাসযোগ্যতা সবচেয়ে কম, সেগুলোর তালিকায় আমাদের প্রিয় রাজধানী দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। বসবাসের জায়গা হিসেবে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক সবচেয়ে খারাপ, আমাদের ঢাকা তার একটু ওপরে।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এই তালিকা তৈরি করেছে পৃথিবীর ১৪০টা শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে। শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা পরিমাপ করা হয়েছে মোটাদাগে ৫টি ক্ষেত্রের ৩০টি দিকের গুণগত ও পরিমাণগত অবস্থানের ভিত্তিতে। ৫টি ক্ষেত্র হলো স্থিতিশীলতা (রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত), স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ও সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং ভৌত অবকাঠামো। মূল্যায়নের জন্য ছিল মোট ১০০ নম্বর। ৩০ দশমিক ৭ নম্বর পেয়ে ১৪০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন স্থানটি অধিকার করেছে সিরিয়ার দামেস্ক। ঢাকা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানের অধিকারী হয়েছে ৩৮ নম্বর পেয়ে। সর্বনিম্ন নম্বর পাওয়া ১০টি শহরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আরও একটি শহর আছে, সেটি হলো পাকিস্তানের করাচি। ৪০ দশমিক ৯ পেয়ে করাচি হয়েছে সম্মিলিত তালিকার চতুর্থ শহর।

দামেস্কের বসবাসযোগ্যতা সর্বনিম্ন হওয়ার প্রধান কারণ সিরিয়ার যুদ্ধ। শহরটি স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে পেয়েছে মাত্র ২০ নম্বর, যেখানে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫০। এটা স্পষ্ট যে সিরিয়ায় যুদ্ধ না বাধলে দামেস্ক থাকত ঢাকার অনেক ওপরে এবং ঢাকাই হতো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম বসবাসযোগ্য শহর। ঢাকার এই দুর্দশার প্রধান কারণ হলো, ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ঢাকা পেয়েছে মাত্র ২৬.৮। এই ক্ষেত্রে এত কম নম্বর ১৪০টা শহরের মধ্যে আর কোনো শহরই পায়নি। দামেস্ক পেয়েছে ৩২.১। আর করাচি পেয়েছে ৫১.৮, অর্থাৎ ঢাকার প্রায় দ্বিগুণ।

এর মানে হলো, আমাদের প্রিয় রাজধানীর ভৌত অবকাঠামোর পরিমাণগত ও গুণগত মান পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ভৌত অবকাঠামো বলতে বোঝানো হচ্ছে রাস্তাঘাট, খোলা জায়গা, পার্ক, হাঁটাচলার জায়গা, পয়োনিষ্কাশন ও পানিনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ সব ধরনের নাগরিক সেবার সঞ্চালন লাইন। কোনো নগরের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের জন্য এগুলো অপরিহার্য। কিন্তু এই ক্ষেত্রেই ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এতটাই খারাপ যে তা এই মহানগরকে সত্যিকার অর্থেই বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে।

জনসংখ্যা ও যানবাহনের তুলনায় পর্যাপ্ত রাস্তাঘাটের অভাবের ফলে ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধীরগতির মহানগর। যানজটের কারণে এই শহরে যানবাহনের গতি কমতে কমতে এখন মানুষের হাঁটার গতির প্রায় সমান হতে চলেছে। সবার আগে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে গিয়ে কেউ কারও আগে যেতে পারে না। পথের ক্লেশ কাজের স্পৃহা নষ্ট করে দেয়; অবিরাম স্নায়ুর পীড়নে মেজাজ হয়ে যায় খিটমিটে। মানুষের সঙ্গে মানুষের আচরণে দেখা দেয় নানা ধরনের অপ্রীতিকর অসংগতি। বিপুল পরিমাণ কর্মঘণ্টার ক্ষতি এবং সেই ক্ষতির আর্থিক হিসাবের কথা বলাই বাহুল্য। পর্যাপ্তসংখ্যক সচল নালা-নর্দমা ও পানিনিষ্কাশনের অভাবে এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই এই মহানগরের অনেক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে; সেই জলমগ্নতাকে অসহ্য করে তোলে পয়ঃপ্রণালি থেকে বেরিয়ে আসা বর্জ্য। জলমগ্ন রাস্তাঘাটে যানজট অনেক বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে যেন এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, যার শারীরিক প্রতিক্রিয়া ও বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় অনেক প্রকট হয় নেতিবাচক মানসিক অভিঘাত। পানি ও গ্যাসের সংকটও এই নগরবাসীর জন্য এক বিরাট সমস্যা।

প্রশ্ন হলো, ঢাকা মহানগরের ভৌত অবকাঠামো ও তার ব্যবস্থাপনার এই শোচনীয় দুর্দশার কারণ কী। এই প্রশ্নের উত্তর অনেক লম্বা হতে পারে। সংক্ষেপে বললে, প্রথম যে সুস্পষ্ট কারণটির কথা বলা যায় তা হলো এই নগরের বিশৃঙ্খল বিস্তার। নগরবিশারদেরা বলেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ। দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব সব সময়ই ছিল, তবে পরিকল্পনাও কিছু গ্রহণ করা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু আন্তরিক, দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতার কারণে কোনো পরিকল্পনাই ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ব্যবস্থাপক হিসেবে আমরা হতাশাব্যঞ্জকভাবে ব্যর্থ। সেই সঙ্গে আছে ক্ষীণদৃষ্টি ও স্বার্থপরতা; ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে বারবার মার খেয়েছে সামষ্টিক স্বার্থ। নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্ববোধের ঘাটতির পাশাপাশি আছে নৈতিকতার প্রকট অভাব। এই মহানগরের জীবন যে একটা যৌথ জীবন,
এখানে ধনী-নির্ধন, ক্ষমতাধর-ক্ষমতাহীন কেউই যে বিচ্ছিন্নভাবে একা ভালো থাকতে পারে না, এই উপলব্ধির ভীষণ অভাব। এই মহানগরের যৌথ জীবনকে যাপনযোগ্য করে তোলার ওপরই যে প্রত্যেক নগরবাসীর ভালো থাকা নির্ভরশীল, এই সত্য উপলব্ধি না করা পর্যন্ত এখানে আমাদের জীবন যাপনযোগ্য হবে না।

ঢাকা মহানগরের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত এই নগরের জনসংখ্যার ঘনত্ব। কারণ, এখানকার জনঘনত্ব ইতিমধ্যে পৃথিবীর সব জনপদের জনঘনত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। এই শহরে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গার মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের বাস। এখনো প্রতিদিন এই শহরে গড়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০ নতুন বাসিন্দা যুক্ত হচ্ছে। ঢাকামুখী এই জনস্রোত অব্যাহত থাকলে একটা সময়ে এই মহানগর বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে যাবে। তাই সবকিছুর আগে প্রয়োজন এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে ঢাকামুখী জনস্রোত কমে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here