নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হঠাৎ উতলা হওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মনে হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আগে ইভিএম-বিতর্ক বিরোধী দলকে আরও চাপে ফেলতে সহায়ক হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এবার ‘মেশিনে ভর’ করার যুক্তি খণ্ডন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘মেশিনের ওপর ভর করে নয়, আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে।’

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থার প্রবর্তনে জনমতের ধার ধারেনি সরকারি দল। তবে বিশ্বের উন্নত গণতন্ত্রে আছে, তাই বাংলাদেশকেও করতে হবে—এ রকম একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখন আবার ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। ভারতেও বেশ কয়েকটি নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেও তাই হবে।’ তাঁর এই বক্তব্য যাচাইয়ের দাবি রাখে।

ভারতের নির্বাচন কমিশন ১৯৭৭ সালে প্রথম ইভিএম চালু করে। ১৯৮১ সালে প্রথম কয়েকটি রাজ্যে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু হয়। তবে ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সংস্কারের মতো ইভিএম কার্যকর করা নিয়েও আদালতে রিট হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে মাদ্রাজ, কেরালা, দিল্লি, কর্ণাটক ও বোম্বে (নাগপুর বেঞ্চ) হাইকোর্টে রিট হয়েছে এবং তাতে তারা ইভিএমের পক্ষে রায় পেয়েছে। তিনটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পরও ২০১৭ সালে উত্তরাখন্ড হাইকোর্টকে রায় দিতে হয়েছে। গত বছর সুপ্রিম কোর্টকেও রায় দিতে হয়েছে। ২০১২ সালে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, এটা ‘টেম্পার প্রুফ’ (জালিয়াতি নিরোধক) নয়। আবার এ বিষয়ে ইসিকে নির্দেশনা দেওয়াও ‘জটিল’। তিনটি মৌলিক ধাপে ইভিএমের আধুনিকায়ন ঘটিয়ে ভারত এ পর্যন্ত এসেছে।

ভারতের ইসির এ–সংক্রান্ত বায়ান্ন পৃষ্ঠার একটি স্ট্যাটাস পেপারের দিকে আমাদের ইসি এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সেখানে লেখা আছে, ‘ভারতের নির্বাচনগুলো ইভিএমে হবে, সেই বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে।’ অথচ লোকসভার ৫৪৩ আসনেই ইভিএমে প্রথম নির্বাচনটি হয় ২০০৪ সালে। তার মানে সংসদ নির্বাচনে এটা চালু করার আগে ভারত পরীক্ষা করেছে ২২ বছর। আর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও ইসি সময় নিয়েছে পুরো ৬ বছর।

২০০৪, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে। কিন্তু এখনো বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হলে ভারত দৃশ্যত আল গোরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারা ২০১৩ সালে স্বচ্ছতার বাড়তি রক্ষাকবচ হিসেবে ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল) চালু করে। ভোট গ্রহীতার নাম ও প্রতীক সংবলিত একটি কাগজ তৈরি করবে যন্ত্র, যা ভোটারের জন্য একটি রক্ষাকবচ। এই পদ্ধতি যুক্ত করার পরেই কেবল সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন। ২০০৯ সালে নাগাল্যান্ডের উপনির্বাচনে এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। অথচ আমাদের দেশে যে ইভিএম চালু করা হয়েছে, তাতে ভিভিপিএটির কথা চিন্তাভাবনাও করা হয়নি বলে একজন কর্মকর্তা আমাদের রোববার নিশ্চিত করেন।

১৯৯০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডস ইভিএম ব্যবহার করেছে। একটি ডাচ বেসরকারি কোম্পানির (এনইডিএপি) উদ্ভাবন ছিল এটি। পরে ডাচদের দেখাদেখি জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড ওই একই কোম্পানি থেকে নিয়ে ইভিএম চালু করেছিল। দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিশনের সুপারিশে ডাচরা ইভিএম ত্যাগ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে হ্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত বিপর্যয় সত্ত্বেও জালিয়াতি নিরোধক ভোট প্রদানের ব্যবস্থা হিসেবে ইভিএমের স্বীকৃতি নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এই পথে যেতে পারে। ফলে ইভিএম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অন্য দেশগুলো কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। দুই ডাচ কমিশনের মূল্যায়ন আমাদের জন্য প্রযোজ্য। তারা বলেছিল, ‘যন্ত্র তদারকির নিজস্ব লোকবল নেই, তাই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আর তাতে যন্ত্র সরবরাহকারীরাই নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তি সেকেলে, যা ডিজিটাল হুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। টেস্টিং রিপোর্টগুলোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে, সে কারণে তা স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা যাচাই করতে অপারগ। নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধিবিধান ছিল আলগা ও অপ্রতুল।’

জার্মানরা ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ইভিএম ব্যবহার করলেও সমালোচনার মুখে তা বন্ধ করে। সেখানে গণনা পর্যায়ে হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৯ সালে জার্মান ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত ইভিএম নাকচ করেন। আদালত তাঁর রায়ে দুটি মুখ্য কারণ দেখান। প্রথমত, বিদ্যমান জার্মান সংবিধান ইভিএম সমর্থন করে না। কারণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিটি অত্যাবশ্যকীয় ধাপ জনগণের পরীক্ষা করে দেখার অধিকার আছে। কিন্তু যন্ত্র তাদের সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় যে কারণ দেখানো হয়েছে, সেটি উচ্চশিক্ষিত নাগরিকের দেশ জার্মানির জন্য যদি প্রযোজ্য হয়, তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য তা আরও বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। রায়ে বলা হয়েছে, ভোটের গণনা এমন হতে হবে, যাতে ভোটাররা কারিগরি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান জানা ছাড়াই নিজেরাই যাচাই করতে পারেন। সেই নিশ্চয়তা ইভিএম দেয় না। বাংলাদেশ সংবিধান বলেছে, সংসদ গঠন হতে হবে ‘প্রত্যক্ষ ভোটে’। প্রস্তাবিত ইভিএম এই শর্ত পূরণ করে না। তাই সংবিধান সংশোধন লাগবে।

আয়ারল্যান্ডও ২০০২-২০০৪ সালে ইভিএম ব্যবহারের পরে বিতর্কের মুখে দুটি কমিশন করে এবং তারাও দেখতে পায় যে, ‘ওই ডাচ যন্ত্র বিশ্বস্ত নয়। প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচ অপ্রতুল। কোনো একটিমাত্র সংস্থার দ্বারা ভোটদান থেকে গণনা ও ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রক্রিয়া যাচাই করা সম্ভব নয়। উপরন্তু সব সংসদীয় আসনে ইভিএমের নিরাপত্তা (ফিজিক্যাল সিকিউরিটি) নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের উদ্বেগ বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক।

আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি, ২০০০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্কিত ভোট গণনা এবং বুশের কাছে আল গোরের হেরে যাওয়া। ফ্লোরিডার পুনরায় ভোট গণনাকে অসাংবিধানিক বলে একটা তর্কিত সমাধান দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। গোর সব ভোট ‘হাতে গণনা’র দাবি করেছিলেন। সেটা পূরণ হয়নি। গোর বলেছিলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের শক্তি ও গণঐক্যের স্বার্থে আমি রায়টা মানছি মাত্র।’ ওই অভিজ্ঞতার পরে যুক্তরাষ্ট্র ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই) চালু করে, যার আওতায় এখন একাধিক স্থানে ভোটদান রেকর্ড হয়ে যায়। দেখার বিষয়, এই উন্নততর ডিআরই চালুর পরেও ভোটারদের মনের খুতখুতানি যায়নি। এরপর তারা উল্লিখিত ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল চালু করে।

ইভিএম এখন পর্যন্ত বিশ্বে এমন একটি ব্যবস্থা, যা নিতান্তই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে অন্যদের তুলনা হবে না। কারণ, তারা আমদানি করেনি। নিজেরা উদ্ভাবন করে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে হাতে গোনা যারা ইভিএম ব্যবহার করছে, তারাও অনেকে সাধারণ নির্বাচন করতে সাহস করছে না। আমরা নিজেদের ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্র চর্চা করি বলে দাবি করি। সেই গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডও ইভিএম ব্যবহারের সাহস করেনি। ২০০০ সাল থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কিছু পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। ২০১৬ সালে এক প্রশ্নের উত্তরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বলা হয়েছে, ‘সাংবিধানিক সংস্কারে আমাদের পূর্ণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং চালু বা সে জন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ আইন করার কোনো চিন্তাভাবনাও নেই।’

বিএনপি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ষড়যন্ত্র দেখছে। এটা তারা তাদের অভ্যাসগত অবস্থান বা রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে বলে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ওপরের আলোচনার দিকে সরকারের এবং ইসির নজর কাড়তে চাই। একই সঙ্গে আমরা নির্বাচন কমিশনকে এখনই আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকায় ইভিএম কেনার প্রকল্প বাতিল করতে অনুরোধ রাখব।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here