সবুজদেশ ডেক্সঃ একজন নির্বাচন কমিশনার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠক বর্জন করায় দিনভর উত্তেজনা ছিল নির্বাচন কমিশনে। বাক-স্বাধীনতা ‘কেড়ে নেওয়ার’ অভিযোগ তুলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে আবারও গতকাল নির্বাচন কমিশন সভা বর্জন করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গতকাল কমিশনের ৩৬তম সভা শুরুর পর ১০ মিনিটের মাথায় মাহবুব তালুকদার সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। বাকি তিন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে বৈঠক চালিয়ে যান সিইসি নূরুল হুদা। আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসির সভা কক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।

এদিকে গতকাল বিকালে ইসি সভা বর্জনের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা’ শিরোনামে আমি যা আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, আমাকে নির্বাচন কমিশন সভায় তা উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। অথচ গত ৮ অক্টোবর ইসি সচিবালয় থেকে ইউওনোটের মাধ্যমে আমাকে এই সভায় তা উপস্থাপনার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। আমাকে আমার প্রস্তাব উপস্থাপন করতে বলে তা না দেওয়ায় আমি অপমানিত হয়েছি। মাহবুব তালুকদার বলেন, বাক প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান প্রদত্ত আমার মৌলিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে আমি নির্বাচন কমিশনের এরকম সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি এবং এর প্রতিবাদস্বরূপ নির্বাচন কমিশনের সভা বর্জন করেছি।’

মাহবুব তালুকদারের ৫ সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসির সংলাপে ২৬টি দল সেনা মোতায়েনের পক্ষে ও তিনটি দল বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর সব নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছে। তবে তা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। ভোটে সেনা মোতায়েন হলেও তারা কীভাবে দায়িত্ব পালন করত তা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সেনাবাহিনী বাদ দেওয়ার পর তাদের কার্যপরিধি কেমন হবে তা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এ ছাড়া দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এ নির্বাচনটি একটি দল বর্জনও করেছে। তবে বর্তমান বিরোধী দল সরকারের পাশাপাপাশি মন্ত্রিসভায় অংশ নিয়েছে। এ অবস্থায় কীভাবে একটি দল সরকারে ও বিরোধী দলে থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে কঠিন সমস্যারও সমাধান হতে পারে। ভোটে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি নির্বাচনের পূর্বশর্ত। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ক্ষমতাসীন দল যে সুবিধা ভোগ করে বিরোধী দল তা ভোগ করতে পারে না। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের কমিটি ধরে ধরে মামলা দায়ের ও গায়েবি মামলা দায়েরে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণার আগে ইসি সম আচরণ নিশ্চিতে বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। নির্বাচনকালে সার্বিকভাবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্ত করতে বলেছেন অনেকে। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ইসির কাছে অর্পিত হলে জন আস্থা বেড়ে যাবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তা সহায়ক হবে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য মনে হলে তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের সঙ্গে তা নিয়ে ইসির সংলাপ করা উচিত।

উল্লেখ্য, এর আগে গত ৩০ আগস্ট কমিশনের যে সভায় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রাখতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখান থেকেও মাহবুব তালুকদার আপত্তি জানিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না। কারণ, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএম চায় না।’

অক্টোবরের পর যে কোনো দিন তফসিল :  একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ৩০ অক্টোবরের পর যে কোনো সময় তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলায় ৭০০ কোটি টাকার খাতওয়ারি বরাদ্দ অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। তিনি উল্লেখ করেন, ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ভোটের ক্ষণ গণনা শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে কাজে কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক প্রস্তুতি কমিশনকে অবহিত করেছে ইসি সচিবালয়।

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আমরা কমিশন সভায় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি তুলে ধরেছি। এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি-কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; আর কী করতে হবে। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করা হবে। তিনি জানান, ৩০ অক্টোবর পর যে কোনো সময় তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর পরেই প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তিনি জানান, সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয়ভাবে আইনশৃঙ্খলা সভা করবে ইসি। সেই সঙ্গে দেশের ৮ বিভাগে রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রশাসন, পুলিশ, সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করা হবে। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা সবখানে সফর করবে। নির্বাচনী কাজ তদারকির জন্যও চার নির্বাচন কমিশনার কাজ ভাগ করে নেবেন।

ইসি সচিব জানান, সংসদ নির্বাচনে এবারই প্রথমবারের মতো অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং (ইভিএম) মেশিন ব্যবহারের প্রস্তুতিও থাকবে। এক্ষেত্রে সরকারের কাছে আইন সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আইন সংশোধন হলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। না হলে আগের পদ্ধতিতে (ব্যালট পেপার) প্রস্তুত থাকবে। তিনি জানান, ২৭ অক্টোবর দেশের নয়টি স্থানে এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে দুই দিনব্যাপী ইভিএম মেলার আয়োজন করা হবে।

ইসি সচিব জানান,  নির্বাচনে প্রচুর লোকবলের প্রয়োজন হয়। এজন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে লোকবল সংগ্রহ করা হবে। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের শূন্যপদ পূরণেও সরকারের কাছে ইসির নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। ভোটকে সামনে রেখে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদের প্যানেল প্রস্তুতের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানান সচিব হেলালুদ্দীন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here