ফারুক নোমানীঃ

ঈদ শব্দটির আরবি শব্দমূল আউদ। এর অর্থ যা ফিরে ফিরে  আসে বারবার । ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া, ইফতার করা। আর ঈদুল ফিতর মানে সে আনন্দঘন উৎসব, যা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে। আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীরঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ঈদ আসে। ঈদ আসে  শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে ঈদ আসে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ভেঙে  বন্ধুত্ব ও মিত্রতার হাত ধরে । ঈদ আসে মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে, পরিশোধিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লাগাতে। ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে সিয়াম ভঙ্গ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়ার আনন্দময় দিবসটি ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত।

ঈদ আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। এটা যেমন দ্বীনীভাবে, তেমনি পার্থিব ও জাগতিক দিক থেকেও। যারা হক আদায় করে, যথার্থ সুনিয়ত ও সদাচারের সঙ্গে গুনাহমুক্ত থেকে সারা মাস রোযা রেখেছেন ঈদের দিনটি তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও পুরস্কারপ্রাপ্তির দিন। অপর দিকে টানা এক মাস দিনের বেলায় ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত ও সংযত থেকে রোযা রাখার পর প্রথম এ দিনটিতে দিনের বেলায় খানাপিনার সুন্দর সুযোগ থাকে। অনুমোদিত পর্যায় পর্যন্ত আনন্দ করা, ভালো পোশাক পরা, সুগন্ধির ব্যবহার, ভালো খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। এ ছাড়া এদিনটির সামাজিক আবেদনের একটি বিরাট দিগন্তও বিদ্যমান। এদিনে প্রতিটি মুসলিম দেশ ও সমাজেই উৎসবের একটি আমেজ বিরাজ করে। ঈদের দিনটি আমাদের জন্য আনন্দের দিন। মনের সব কালিমা দূর করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, মান-অভিমান বিসর্জন দিয়ে সবাই হাতে হাত মেলানো, বুকে বুক মেলানো, গলায় গলা মেলানো অর্থাৎ সবার দেহ-মন এক হওয়ার আনন্দ হলো ঈদের আনন্দ। নিজের মনের হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহংকার, অহমিকা, আত্মম্ভরিতা, আত্মশ্লাঘা, রাগ, ক্রোধ, বিদ্বেষসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আনন্দ। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির আনন্দ।নবীজি  (সা.) বলেন-‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলো যখন সে ইফতার করে; দ্বিতীয়টি হলো যখন সে তার মাবুদ আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।’ (বুখারি)। রোজাদার প্রতিদিন ইফতার করে; আবার পরের দিন রোজা রাখে। এটি হলো ছোট ইফতার; কারণ এটির পর আবারও রোজা আসে। ইফতার বা ফিতর হলো রোজা পূর্ণ করার পর আহার গ্রহণ করা; পূর্ণ রমজান মাস রোজা পালন শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন সকালে যখন রোজাদার মিষ্টিমুখ করে তখন সে এক বছরের জন্য প্রকৃত অর্থে ইফতার করে বা সিয়াম সাধনা সম্পূর্ণ করে আজ প্রথম সকালের আহার গ্রহণ করে; তাই এটি এক বছরের জন্য বড় ইফতার; সুতরাং ঈদুল ফিতর রোজাদার মুমিন মুসলমানের জন্য পরম আনন্দের দিন।

ঈদ মুসলমানের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। মুসলিম জাতির আনন্দের দিন। নবীজি  (সা.) এ দিনের আনন্দ-উৎসব মুসলিম জাতির জন্য পবিত্র ও সার্বজনীন ঘোষণা করেছেন।হাদিস শরিফে এসেছে, ‘প্রতিটি জাতির উৎসবের দিন রয়েছে আর এটি আমাদের উৎসবের দিন।’  (সহিহ বোখারি)অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত,  রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন মদিনাবাসী বছরের দু’দিন ক্রীড়া-কৌতুকে কাটাতো। নবীজি  (সা.) বললেন, দু’দিনের বিশেষত্ব কি? তারা বললো, আমরা জাহেলি যুগ থেকেই এ দিনে ক্রীড়া-কৌতুক করি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহ এ দু’দিনের পরিবর্তে তোমাদেরকে নতুন আরও উত্তম দু’টি দিন দিয়েছেন। ইয়াওমুল আজহা (কোরবানির ঈদ) ও ইয়াওমুল ফিতর (ঈদুল ফিতর)।  এ হাদিসের আলোকে মুহাদ্দিসরা বলেন, ঈদে মুসলমানের উৎসব অবশ্যই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে হবে। তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সার্বজনীন সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি।

প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় নির্দিষ্ট দিনে আনন্দ করে থাকে। সাধারণত দেখা যায়, যারা ধনী তারা আনন্দ-ফুর্তি করে, গরিব অসহায়রা তা হতে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু ইসলামের আনন্দ উদযাপনের বিষয়টি অন্য ধর্মের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্য ধর্মের আনন্দ উদযাপনের মূল কথা হলো- ‘নিজে খাও নিজে আনন্দ করো। ‘ কিন্তু ইসলামের নির্দেশ হলো- নিজে আনন্দ উদযাপনের আগে গরিব অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাও।  নিজের আনন্দের সাথে দুঃস্থ পরিবারকেও যুক্ত করে নাও। একাকী আনন্দ উদযাপনের স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গির চরম বিরোধিতা করেছে ইসলাম।  তাই বিত্তহীনতা, দারিদ্র, সংকট ও অভাব  এ দিনেও যেন বেদনাঘন চিত্রের জন্ম না দেয়। গরিব মানুষেরা ঈদের আনন্দে নিজেরাও শরীক হতে পারে , শরীক করতে পারে যেন নিজেদের শিশু সন্তানদেরও।তাই মুসলিমদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে ঈদের নামাযের আগেই যেন তারা তাদের সদকাতুল ফিতর আদায় করে। ধনীর সন্তান দামি কাপড় পরে ঈদের মাঠে যাবে, আর প্রতিবেশি অসহায় বাচ্চাটি চোখের পানি ছেড়ে তা দেখবে ইসলাম কখনোই তা মানতে পারেনি। তাই তো ধনীর সম্পদে ‘গরিবের অধিকার’ যাকাতের আবশ্যিক বিধান দিয়েছে ইসলাম।  নামায যেমন ফরয, যাকাতকেও তেমন ফরয করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই ধনী গরিবের সম্প্রীতি নিশ্চিত করেছে ইসলাম।

সমাজে উঁচুনিচু ও বড়ছোট ও জাতপাতের নানা কুসংস্কার ও নিকৃষ্ট নীতির প্রচলন রয়েছে।  কিন্তু ইসলামে সকল মানুষকে এক ও সমান বলে ঘোষণা করা হয়েছে।  তাই গরিবের ওপর নেই ধনীর শ্রেষ্ঠত্ব। কালোর ওপর সাদার। সকলকে সমান মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম।  এ কারণেই ঈদের নামাযে একজন বিত্তশালীর পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই সাথে নামায আদায় করেন আরেকজন খেটে-খাওয়া  দিনমজুর।  কোন বিভেদ নেই।  নেই কোন সংকোচ। এটাই ইসলামের শিক্ষা।  এভাবেই ইসলাম সমাজে গড়ে ওঠা সকল অমানবিক বৈষম্যের বিপরীতে সার্বজনীন সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি নিশ্চিত করেছে। 

লেখক: মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ। ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ,  কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ। 

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here