বেশ কিছুদিন ধরে নাজনীন আরা লক্ষ করছেন, পিক আওয়ার থাকলেই অনেক বেশি ভাড়া চায় উবার। অ্যাপে কল করার পর বেশ বড় অঙ্কের একটা ভাড়া চেয়ে লেখা হয়, অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ব্যাপারটায় বেশ বিরক্ত তিনি। সিএনজিচালিত অটোরিকশার নৈরাজ্যে নাস্তানাবুদ হয়েই উবার বেছে নিয়েছিলেন, সেই উবারও কিনা এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো আচরণ করছে!

চালুর হওয়ার পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অ্যাপভিত্তিক পরিবহনসেবা উবার। সিএনজিচালিত অটোরিকশার অধিক ভাড়া ও চালকের দুর্ব্যবহারের যন্ত্রণায় যাত্রীরা উবার পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। তবে স্বস্তি যেন বেশি দিন স্থায়ী হলো না। উবারের অনেক গ্রাহকেরই এখন অভিযোগ, উবার যেন সিএনজি স্কুটারের মতো হয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উবার কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছে।

কয়েক দিন ধরে উবারের বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অফিস শুরু বা শেষের সময়, কোনো উৎসব থাকলে, রাস্তায় কোনো সভা-সম্মেলন থাকলে বা বৃষ্টি হলেও ভাড়া বাড়িয়ে দেয় উবার। একেবারেই সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো।

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের মধ্যে উবারের ভাড়া নিয়ে বেশ বিপাকে পড়ার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এক গ্রাহক। নিপা আলম নামের ওই নারী বলেন, ‘বিকেল চারটার দিকে মোহম্মদপুরের অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় যানবাহন কম দেখে চিন্তায় পড়ে যাই। গণপরিবহন না থাকার পাশাপাশি রিকশাও কম ছিল। উবার ডাকি আমি। পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ি। পরে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখি ভাড়া উঠেছে ৪৫০ টাকা। অ্যাপসে যা টাকা দেখলাম, গন্তব্যে গিয়ে দেখি অনেক বেশি। এতটা হতভম্ব হয়ে যাই, তা বলার নয়।’

উৎসব বা বিশেষ দিবসে ভাড়াটা উবার অনেক বাড়িয়ে দেয় জানিয়ে নাইর আহমেদ নামের এক গ্রাহক বলেন, ‘নিয়মিত উবারের সেবা নিই। উৎসবের সময় সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া রাখে উবার। আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো দূরত্বে ভাড়া যা হওয়া উচিত, উবার তার চেয়ে সব সময়ই অন্তত ২০০ টাকা বেশি রাখে।’

মো. রাফসান নামের উবারের নিয়মিত এক যাত্রী জানান, সকাল ও সন্ধ্যায়, অর্থাৎ বিশেষ কিছু সময়ে উবারের ভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বৃষ্টি হলে, আবার গরম বেশি পড়লেও উবার ভাড়া বাড়িয়ে দেয়।

মোরশেদ আহমেদ নামের এক গ্রাহক বলেন, ‘এমন হয়েছে যে সকালে উবার এক্সে মোহাম্মদপুর থেকে মহাখালী আইসিডিডিআরবি গিয়েছি ৪৩৩ টাকায়। কাজ শেষে একই রাস্তায় দিয়ে একই সেবায় বাসায় ফিরেছি ২৬৩ টাকায়।’

টুশি নামের এক গ্রাহক জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কয়েক দিন আগে বিকেলে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। হাজিপাড়া থেকে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে যেতে উবার কল করেন তিনি। ভাড়া দেন ৫৮২ টাকা দিয়ে। তিনি বলেন, ‘উবার এক্সে গেলাম, তাও এত ভাড়া। অন্য সময় যদি ডিসকাউন্ট নাও থাকে, তারপরও ৩৫০ টাকায় যায়।’

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠলে চালক ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করেন বলে উবারই ব্যবহার করেন জামিল চৌধুরী। এ ছাড়া রাস্তার ধুলোবালু এড়াতে উবার তাঁর বেশ পছন্দ। তিনি বললেন, ‘সাধারণত উবারে পান্থপথ সিগন্যাল থেকে কারওয়ান বাজার ৬০-৭০ টাকায় আসি। গত ঈদের সময় আমি অফিস করেছি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা ভাড়া গুনে।’

উবার অ্যাপে গ্রাহক যে ভাড়াটি দেখেন, সেটি কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়। ছবি: প্রথম আলোউবার অ্যাপে গ্রাহক যে ভাড়াটি দেখেন, সেটি কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে এক উবার চালক বলেন, ‘অনেক সময় এত ভাড়া ওঠে অ্যাপসে যে আমিও অবাক হই। সেদিন এক নারী অল্প একটু দূরত্বের জন্য অনেক ভাড়া দিলেন। আমার বেশ খারাপ লেগেছিল। কিন্তু অ্যাপসে যে ভাড়া দেখায়, সেটা আমাদের নিতেই হয়। কম নেওয়ার সুযোগ নেই। আমি তাঁকে উবারে অভিযোগ করার পরামর্শ দিয়েছি।’

উবারের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেক গ্রাহক। রফিক আজাদ নামের এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘একজন উবার চালক আমার রাইড বাতিল করে দিয়েছেন। রাইড বাতিল করার আগে তিনবার মিসডকল দিয়েছেন আমার মোবাইলে। যাতে প্রমাণ করতে পারেন, কল না ধরায় তিনি রাইড বাতিল করেছেন। তবে রাইড বাতিল করায় ৩০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে আমাকে।’

নাফিসা রহমান বলেন, ‘একদিন মোহাম্মদপুর থেকে উবার নেওয়ার পর চালক জানতে চান কোথায় যাব। আমি বললাম, জায়গাটা পিকআপ পয়েন্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। চালক খুব বিরক্ত। গজ গজ করতে করতে বলেন, “এ জন্যই আগে কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করি। এত কাছের যাত্রী নিই না।” চালকের ব্যবহার খুবই বিরক্ত লাগে।’

২০১৬ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ট্যাক্সিসেবাদাতা উবার। এদের নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই। এটি মুঠোফোন অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ির মালিক-চালকদের সঙ্গে যাত্রীদের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। এখানে গাড়িচালক ও যাত্রী—দুই পক্ষকেই আগে থেকে নিবন্ধিত হতে হয়, যা এই অ্যাপ ব্যবহারকারী যাত্রী ও চালক—উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ঢাকায় প্রতি ট্রিপের ২৫ শতাংশ অর্থ পায় উবার। বাকিটা গাড়ির মালিক ও চালক পান। বাংলাদেশে উবারের কোনো কার্যালয় নেই। তবে ভারতে তাদের কার্যালয় রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানাতে প্রথম আলো বাংলাদেশে উবারের জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গ যোগাযোগ করে।

অ্যাপভিত্তিক উবার ট্যাক্সি সার্ভিসে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো উবার এক্স ও উবার প্রিমিয়াম সেবা। উবার এক্স ভাড়া করলে গ্রাহককে শুরুতেই গুনতে হয় ৪০ টাকা, প্রতি মিনিটে ৩ টাকা, প্রতি কিলোমিটার ১৮ টাকা। আর রাইড বাতিল ফি ৩০ টাকা। উবার প্রাইম ভাড়া করলে গ্রাহককে গুনতে হবে শুরুতে ৮০ টাকা, প্রতি মিনিটে ৩ টাকা, প্রতি কিলোমিটার ২২ টাকা, বাতিল ফি ৩০ টাকা। এ ছাড়া উবারের মোটরসাইকেল সেবাও আছে, যা উবার মোটো নামে পরিচিত।

গণপরিবহনে জনভোগান্তির শহর ঢাকায় উবার বা এ ধরনের সেবা নিয়ে অভিযোগ থাকলেও বিকল্প কম থাকায় মেনে নিচ্ছেন যাত্রীরা। উবার কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সার্ভিসের সব বিষয়ে অভিযোগ করার সুযোগ থাকলেও ঝামেলা এড়াতে অনেক যাত্রী সে পথে যান না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক ই-মেইল বার্তায় ঢাকার উবার কর্তৃপক্ষ জানায়, উবারের ভাড়া ডায়নামিক্যালি নির্ধারিত হয়। গ্রাহক যে ভাড়াটি দেখেন, সেটি কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়। এই বিষয়গুলোর মধ্যে গন্তব্যের আনুমানিক সময় ও দূরত্ব, ট্রাফিক, উবার ব্যবহার করা গ্রাহক ও চালকের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত। উবার জানায়, ডায়নামিক ভাড়ার কারণে গ্রাহকের চাহিদার সঙ্গে চালকের সরবরাহ মেলানো সম্ভব হয়। গ্রাহকও দ্রুত পিকআপ পান। ডায়নামিক প্রাইজিংয়ের কারণেই ভাড়া সাময়িকভাবে বেড়ে যায়।

সেবার মান ও চালকের আচরণের বিষয়ে উবার জানায়, গ্রাহককে ঝুটঝামেলাবিহীন পরিবহনসুবিধা দেওয়ায় ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ উবার। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক অ্যাপের মাধ্যমেই অভিযোগ করতে পারেন। উবার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ও ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া চালকের আচরণ বিষয়ে রেটিং দেওয়ার ব্যবস্থা আছে অ্যাপসে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here