নাটোরঃ

এমএ পাস করেও পাননি কাঙ্খিত চাকরি। তাই একটি খাবার হোটেলে থালাবাসন ধোয়ারও কাজ করেন তিনি। রাত  ৯টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত একটানা ১২ ঘণ্টা  ঠাণ্ডা পানিতে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করেন। বেতন পান শুধু তিনশ টাকা। সে টাকায় বৃদ্ধ মা আনোয়ারা বেওয়া, বাকপ্রতিবন্ধী স্ত্রী কুইন খাতুন এবং চার বছরের ছেলে হাসিবুর রহমান হিমেলসহ চার সদস্যের সংসার চলে। 

বলছিলাম নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউপির বড়বড়িয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান নজরুল ইসলামের কথা। আট ভাই এবং ছয় বোনের মধ্যে নজরুল সবার ছোট। কৃষক বাবা জমির উদ্দীনের মৃত্যুর পর অন্যের জমিতে ক্ষেতমজুরি কাজ করেই কলেজের পাঠ চুকিয়েছেন।

এমএ পাস করা এ যুবক নাটোরের শহরের চকরামপুর এলাকার বিসমিল্লাহ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টর বাবুর্চি খানায় নাইট শিফটে থালাবাসন পরিষ্কার ও ধোয়া মোছার কাজ করেন। শহরের পরিচিতজন এবং সহপাঠীদের সঙ্গে  দেখা হবে এ লোকলজ্জার ভয়ে বাবুর্চি খানার বাইরেও আসেন না। 

জানা গেছে, ২০১৬ সালে নাটোর এন এস সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়  কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে এমএ পাস করেন। আগে মানুষের জমিতে কাজ করতেন বলে জানান নজরুল। গ্রামে কাজ না থাকায় তিনমাস ধরে শহরের এই হোটেলটিতে কাজ করছেন। এমএ পাশ করার পর কিছুদিন স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে দুই হাজার টাকা বেতনে শিক্ষকতাও করেছেন। বাড়তি আয়ের জন্য অন্যের জমিতে কাজ করছিলেন এ যুবক।

তবে চাকরির খোঁজে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। ব্যাংক ড্রাফট আর পে অর্ডার করতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। কাজ হয়নি। বেসরকারি  স্কুল ও কলেজে চাকরির আবেদন করলেই ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ডেনোশন দিতে হয় বলে জানান নজরুল। যার নুন আনতে পান্তা ফুরায়- সে কিভাবে এতো টাকা দেবে।

এরপরও একটি মিডিয়া কোম্পানিতে সহকারী পরিচালক পদে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেন নজরুল। চাকরির শর্ত মোতাবেক ধারকর্য করে ৬০ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠান। চাকরি তো হয়নি, উল্টো টাকা ফেরত চাইলে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। সে টাকা শোধ করতে সন্ধ্যায় দুটি প্রাইভেট পড়ানোর পাশাপাশি হোটেলে কাজ করতে হচ্ছে। 

তার আত্মীয় ও পরিজনরা জানান, একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তবে ভাগ্যে ভালো কোনো চাকরি জুটেনি। তাই এ পেশা  ছাড়তে পারছেন না। কনকনে শীতের পুরো রাত ঠান্ডা পানিতে হোটেলে কাজ করেও আশানুরূপ চাকরির স্বপ্নটা এখনো ছাড়েননি। কোনো কাজই ছোট নয় জানিয়ে নজরুল জানান, চাকরি না পেলে ক্ষেতমজুর বা হোটেলে কাজ করেই জীবন পার করে দিতে সমস্যা নেই। 

নজরুল বলেন, শুধু কৃষিজমিতে মজুরির কাজ  করছি না, আমি যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেছি তা স্থানীয়রা জানেন। সে সুবাদে কয়েকটা টিউশনিও করি। সংসারের সব ভরণপোষণের দায়িত্ব আমারই। তাই এ কাজ করতে আমরা আপত্তি নেই।

এদিকে নজরুলের স্কুলের শিক্ষক আশরাফ আলী  বলেন, বড়বড়িয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও আহম্মেদপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে  নাটোর এন এস সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ( সম্মান) শ্রেণিতে  ভর্তি হন নজরুল। সেখান থেকেই এমএ পাশ করেন। ছোট থেকেই ছেলেটা মেধাবী। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়েছে। এখনো যেভাবে সংসার চালাচ্ছে, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরো বেড়ে গেছে।

স্থানীয়  পরিবহন ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার বলেন, উচ্চশিক্ষিত যুবককে হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতে দেখলে মন খারাপ হয়। ওর জন্য ভালো একটা চাকরির চেষ্টা করছি। আশা করছি খুব শিগগিরই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

হোটেলের অন্যান্য কর্মচারীরা বলেন, শীতের দীর্ঘরাত ১২ ঘণ্টা একটানা থালাবাসন ধোয়া যে কত কষ্ট, সেটা একমাত্র নজরুলই বলতে পারবেন। আমরা তাকে হোটেলের সামনে কাজ করতে বলি। সে পরিচিতদের ভয়ে সামনে আসতে চান না। বাবুর্চি খানায় লুকিয়ে কাজ করেন। এমএ পাশ একটি ছেলেকে এ কাজে দেখে আমাদের খারাপই লাগে। কেউ যদি নজরুলকে সম্মানজনক চাকরি দিত, তাহলে বেচারা এই কষ্ট থেকে বেঁচে যেত। 

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here