ঢাকাঃ

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে চীনের করোনা ভাইরাস। প্রতিদিনই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর শঙ্কা। চীনের সীমানা ছাড়িয়ে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছড়িয়ে গেছে বেশ কয়েকটি দেশে। যদিও বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী এখনো শনাক্ত হয়নি তবু ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রস্তুতি যথেষ্ট তবে কোনো ধরনের তীব্রতা দেখা দিলে তা সামলাতে আরও প্রস্তুতি প্রয়োজন।

ভৌগোলিক ও ব্যবসায়িক কারণে চীন থেকে প্রতিদিনই যাত্রী যাওয়া-আসা করছে বাংলাদেশে। চীন থেকে চারটি ফ্লাইটে প্রতিদিন দেশে গড়ে ৬০০  থেকে ৭০০ যাত্রী ঢাকায় আসে। তাদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে। তাই আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

চীনে করোনা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৯৭৫ জন এবং মারা গেছেন ৫৬ জন।

চীনের উহান শহর থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি। পরবর্তী সময়ে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ১১টি দেশে নতুন এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে সতর্কতা বাড়ছে।

এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও সতর্কতামূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন ভ্রমণ করে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে আসার সময় সংকেত দিলে ওই যাত্রীকে পরীক্ষা করবেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। সাধারণত কারো শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকলেই থার্মাল স্ক্যানার সংকেত দিবে। তখন ওই যাত্রীকে বিমানবন্দরে কোয়ারেনটাইন রুমে রেখে পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হবে। এরপর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ওই যাত্রীকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হবে।

তবে স্ক্রিনিংয়ের এই প্রক্রিয়া আরও সতর্কভাবে করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, নভেল করোনা নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস। এটি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্তের খুব ঝুঁকিতে রয়েছে। হঠাৎ যদি দুই একজন আক্রান্ত রোগী দেশে ঢুকে পড়ে তাহলে অত্যন্ত বিপদজনক হবে। বিমানবন্দর থেকে সাধারণত সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়, তাই কেউ যেন পরীক্ষার বাইরে না থাকে সে বিষয়ে সতর্ক হতে থাকতে হবে। 

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যা পদক্ষেপ নিয়েছে তা যথেষ্ট তবে তা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এখন পর্যন্ত রোগীকে আলাদা করে নিবিড় পরিচর্যায় রাখা ছাড়া বিকল্প কোনো চিকিৎসা নেই।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া গেলে তাদের আলাদা করে রাখার জন্য রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড।

তবে কোন ধরনের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তা মোকাবেলায় কুর্মিটোলার পাশাপাশি রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতাল এবং মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দেন ওই চিকিৎসক।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিমানবন্দরে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে জানান শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তৌহিদ-উল-আহসান। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়েছে। কারো শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি হলে থার্মাল লাল সংকেত দিবে। তখন ওই যাত্রীকে আইসোলেট করে তাকে জিঙ্গাসাবাদ করে হাসপাতালে ভর্তি বা আমাদের নিবিড় কক্ষে রাখা হবে। সব যাত্রী যাতে এ মেশিনের মধ্য দিয়ে যায় তা আমরা নিশ্চিত করছি।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া চায়না ফ্লাইটের কেবিন ক্রু, পাইলট, ইমগ্রেশনে যারা আছে সবাইকে সচেতন করা হয়েছে। সোমবার তাদের আবার করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সতর্কতা, কীভাবে কী করতে হবে সে বিষয়ে সভা হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, এ অবস্থায় বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত নয়। তবে মোকাবেলায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থল/নৌ ও বিমান বন্দরসমূহে ইমিগ্রেশন ও আইএইচআর স্বাস্থ্য ডেস্কগুলোতে সর্তকতা এবং রোগের সার্ভিলেন্স জোরদার করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন প্রবেশপথগুলোতে নতুন করোনা ভাইরাস স্ক্রিনিং কার্যক্রম চালু হয়েছে।

নতুন ভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা কাজে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রোগপ্রতিরোধী পোশাক মজুত রাখা হয়েছে। আইসিইউ’র চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।  এখন দ্বিতীয় দফায় ৩০ জন চিকিৎসকের ট্রেনিং চলছে। 

বিমানবন্দরের ভেতরে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত সনাক্তকরণের জন্য ক্রুদের মাধ্যমে যাত্রীদের মধ্যে হেলথ ডিক্লারেশন ফর্ম ও প্যাসেঞ্জার লোকেটর ফরম বিতরণ করা হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইন এবং রোগীর স্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরদারসহ চীন ও আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আক্রান্ত যাত্রীদের হেলথ ফরম দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা বিষয়ক সহায়তার জন্য ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৭৮৭৬৯১৩৭২ ও ০১৭৮৭৬৯১৩৭৩ হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এদিকে, হটলাইন নম্বরগুলোতে অনেকেই যোগাযোগ করছেন বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর। তিনি বলেন, প্রতিদিনই করোনা ভাইরাসের ভয়ে সর্দি, কাশি নিয়ে রোগীরা ফোন দিচ্ছে। তবে যাদের ট্রাভেল হিস্ট্রি নেই তাদের টেস্ট করা হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সন্দেহে আট জনের টেস্ট করা হয়েছে।  তাদের মধ্যে দুই জনের ইনফ্লুয়েঞ্জা সনাক্ত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস পরীক্ষার রি-এজেন্ট দেশে পর্যাপ্ত আছে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

চীন ও বাংলাদেশের ভ্রমণ স্থগিতের বিষয়ে জরুরি সভা ২৮ জানুয়ারি 

রোববার করোনা ভাইরাস বিষয়ে বাংলাদেশের জরুরি সতর্কতা গ্রহণ করা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে জরুরি এক সভা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।  

সভায় বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর জানান, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ ধরা নাও পড়তে পারে। যেহেতু চীনে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে; তাই তারা সবাই এখন ফিরতে গিয়ে এই ভাইরাসের জীবাণু বহন করে দেশে নিয়ে এলে তা আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কাজেই সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশ থেকে চীনে যাতায়াত ব্যবস্থা স্থগিত করার উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান তিনি।

আহমেদুল কবীরের অনুরোধের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চীন-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেক গভীর। দেশের অনেক মানুষ বাণিজ্যিক কারণে চীনে যাতায়াত করছে। তাই এই ভয়াবহ ভাইরাস বাংলাদেশে যে কোনো উপায়ে চলে এলে এটি আমাদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। একারণে আগামী ২৮ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় জরুরি সভা করা হবে।

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে চীনে ও চীন থেকে বাংলাদেশে সকল ধরনের ভ্রমণ সাময়িকভাবে স্থগিত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here