ঢাকা ০৯:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাবির উন্নয়ন প্রকল্পে শোভন-রাব্বানীর থাবা : ভিসির কাছে চাঁদা দাবি

Reporter Name
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জাবির ভিসি : প্রকল্পে বরাদ্দের ৪-৬% টাকা চায় * শোভন-রাব্বানী তোমাকেও কষ্ট দিল : ভিসিকে প্রধানমন্ত্রী

সবুজদেশ ডেস্কঃ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ৪-৬ পারসেন্ট চাঁদা দাবি করেছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে এই চাঁদা চান দুই নেতা।

উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে- এমন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসিকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন শোভন ও রাব্বানী। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা রূঢ় আচরণ করেন। বুধবার সন্ধ্যায় ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তার বাসভবনে যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

ভিসি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, ওরা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও কষ্ট দিল।’

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আধা ঘণ্টার বেশি আলোচনা করেছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমার প্রতি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন করছে, তারা দুর্নীতির প্রমাণ করুক।’ এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প, প্রকল্প বাস্তবায়ন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও শাখা ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান ভিসি।

নির্বিঘ্নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঈদের আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটি ও শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছে একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

প্রশাসনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কর্মসূচিতে সরগরম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি ভিসি।

শাখা ছাত্রলীগ ও জাবির একাধিক শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহার আগে ৮ আগস্ট রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভিসির বাসভবনে এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এ সময় তারা ভিসিকে উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পাওয়া কোম্পানি থেকে কয়েক পার্সেন্ট টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু ভিসি তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে তারা রূঢ় আচরণ করেন।

এ বিষয়ে ভিসি বলেন, ‘সেদিন তারা (শোভন ও রাব্বানী) আমাকে বলে, এত বড় প্রকল্প, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। আপনি কোম্পানিগুলোকে বলে দেন তারা যেন আমাদের কিছু (পার্সেন্ট) টাকা দেয়।

আমাদের টাকা দিলে আমরা স্থানীয় (জাবি) ছাত্রলীগকে তা থেকে কিছু দিয়ে দেব। কিন্তু আমি তাদের কথায় রাজি হইনি এবং মুখের ওপরে বলে দিয়েছি আমি কোনো টাকা-পয়সার মধ্যে নেই। তখন তারা আমাকে বলল, আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন।

সেজন্য আপনার কাছে এসেছি। তখনও তাদের কথায় সাড়া না দেয়ায় তারা আমার সঙ্গে বেশ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা শুরু করে। এর কিছু সময় পর তারা চলে যায়।’ তারা কত পার্সেন্ট দাবি করেছিল- এমন প্রশ্নে ভিসি বলেন, ‘দু-এক পার্সেন্ট না, তারা চার কিংবা ছয় পার্সেন্টের কথা বলেছিল।’

প্রসঙ্গত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের জন্য এ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে ৫টি আবাসিক হল (তিনটি ছাত্র ও দুটি ছাত্রীনিবাস) নির্মাণের জন্য ৩৬৭ কোটি টাকার টেন্ডার চূড়ান্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় শোভন ও রাব্বানীর প্রসঙ্গ টেনে ভিসি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি নাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনা করার জন্য তাদের (শোভন-রাব্বানী) দায়িত্ব দিয়েছেন? তখন প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব কী? আমি তাদের কেন এ দায়িত্ব দেব?

এ সময় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন।’ এ সময় তিনি জাবি ছাত্রলীগ সম্পর্কেও কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানাকে ‘ভালো’ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম সুফিয়ান চঞ্চলকে ‘দূরে থাকে বা নিষ্ক্রিয়’ বলে মন্তব্য করেন।

ভিসি বলেন, প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে চলমান আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ‘সম্মানী মানুষকে কেন (তদন্ত কমিটি করে) আমরা অসম্মানিত করব? যারা আপনাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলছে, তারাই প্রমাণ করুক।

কোনো উড়ো চিঠি কিংবা উড়ো খবরের ভিত্তিতে কিছু করা হবে না।’ ভিসি আরও বলেন, ‘এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়ে আমার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প না চায় তবে দেব না।

আপনি না বলে দেন। তবে এ নিয়ে যেন আন্দোলন না হয়।’ এ সময় তিনি (প্রধানমন্ত্রী) পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও আড়িয়াল বিলের প্রকল্পকে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করেন বলেও জানান ভিসি।

ভিসির বাসভবন সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্যের পর ভিসির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রাব্বানী প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন।

সোমবার রাতে রাব্বানীর অনুসারী বলে পরিচিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবর রহমান সালেহী, ছাত্রলীগ কর্মী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪২ ব্যাচের রতন বিশ্বাসসহ চারজন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে যান।

তবে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করে। তবে সালেহী ওইদিন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে যায়নি বলে দাবি করেন। আর রতন বিশ্বাসের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমরা ভিসি ম্যামের সঙ্গে দেখা করেছি, সেটা সত্য। তবে আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি মোটেও সঠিক নয়। ভিসি ম্যাম ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন।

তার একটি টাকাও আমাদের ছিল না। অথচ বলা হচ্ছিল, আমাদের টাকা দেয়া হয়েছে। পরে তার ছেলের মাধ্যমে তিনি আমাদের কল করিয়েছেন। তখন আমরা সেখানে গিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার একটি কাজের জন্য আমাদের ছাত্রলীগের সাবেক এক বড় ভাইয়ের ফার্মের জন্য বলেছিলাম।

ভিসি ম্যাম সেই ফার্মকেও কাজটা দেননি। আমরা সেটা নিয়েও কিছু বলিনি। অথচ এখন উল্টো আমাদের নামে বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে, সেখানেই আমরা কিছু করিনি।

কেউ আমাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারেনি। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কেন করব।’

হল ও মাস্টাপ্ল্যান ইস্যুতে আলোচনা ইতিবাচক, দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন কার্যদিবস সময় নিয়েছে : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ইস্যুতে তিন দফা দাবি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন আন্দোলনকারীরা।

বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় নতুন প্রশাসনিক ভবনে আলোচনা শুরু হয়ে চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারী ২২ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলোচনায় অংশ নেন।

আলোচনা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনকারী জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের তিনটি হল স্থানান্তর ও মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

আর দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন কার্যদিবস সময় নিয়েছে।

আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের উত্তর-পশ্চিম পাশের হলটি ১০০ ফিট দূরে এবং দক্ষিণ ও পূর্বপাশের নির্মিতব্য হল দুটি অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ, বিশেষায়িত ও মনিটরিং নামে তিনটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি মাস্টারপ্ল্যান পুনর্গঠন ও প্রকল্পের স্বচ্ছতার বিষয়ে সার্বিক তদারকি করবে।

অপরদিকে দুর্নীতির তদন্তের জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরদিন বুধবার প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারীরা আবার বৈঠকে মিলিত হবে বলে জানান সাংস্কৃতিক জোটের প্রচার সম্পাদক মারুফ মোজাম্মেল।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন, প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক নুরুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) রহিমা কানিজ, প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) আহসান হাবিব অংশ নিয়েছেন।

আর আন্দোলনকারীদের পক্ষে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আলোচনায় অংশ নেয়া অধ্যাপকরা হলেন, খবির উদ্দিন, জামাল উদ্দিন, কামরুল আহসান, শামীমা সুলতানা, রায়হান রাইন, আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া নুরুল ইসলাম ও তারেক রেজা।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম পাপ্পু, প্রচার সম্পাদক মারুফ মোজাম্মেল, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয়, সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক, কার্যকরী সদস্য রাকিবুল রনি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদার, সাংগঠনিক সম্পাদক শোভন রহমান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) শাখা সভাপতি মাহাথির মোহাম্মদ, সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত দে, দফতর সম্পাদক রেবেকা আহমেদ এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখপাত্র খান মুনতাসির আরমান, যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন শিশির ও আরিফুল ইসলাম আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।

About Author Information
আপডেট সময় : ১০:২০:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
৩৭৬ Time View

জাবির উন্নয়ন প্রকল্পে শোভন-রাব্বানীর থাবা : ভিসির কাছে চাঁদা দাবি

আপডেট সময় : ১০:২০:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জাবির ভিসি : প্রকল্পে বরাদ্দের ৪-৬% টাকা চায় * শোভন-রাব্বানী তোমাকেও কষ্ট দিল : ভিসিকে প্রধানমন্ত্রী

সবুজদেশ ডেস্কঃ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ৪-৬ পারসেন্ট চাঁদা দাবি করেছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে এই চাঁদা চান দুই নেতা।

উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে- এমন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসিকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন শোভন ও রাব্বানী। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা রূঢ় আচরণ করেন। বুধবার সন্ধ্যায় ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তার বাসভবনে যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

ভিসি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, ওরা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও কষ্ট দিল।’

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আধা ঘণ্টার বেশি আলোচনা করেছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমার প্রতি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন করছে, তারা দুর্নীতির প্রমাণ করুক।’ এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প, প্রকল্প বাস্তবায়ন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও শাখা ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান ভিসি।

নির্বিঘ্নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঈদের আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটি ও শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছে একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

প্রশাসনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কর্মসূচিতে সরগরম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি ভিসি।

শাখা ছাত্রলীগ ও জাবির একাধিক শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহার আগে ৮ আগস্ট রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভিসির বাসভবনে এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এ সময় তারা ভিসিকে উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পাওয়া কোম্পানি থেকে কয়েক পার্সেন্ট টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু ভিসি তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে তারা রূঢ় আচরণ করেন।

এ বিষয়ে ভিসি বলেন, ‘সেদিন তারা (শোভন ও রাব্বানী) আমাকে বলে, এত বড় প্রকল্প, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। আপনি কোম্পানিগুলোকে বলে দেন তারা যেন আমাদের কিছু (পার্সেন্ট) টাকা দেয়।

আমাদের টাকা দিলে আমরা স্থানীয় (জাবি) ছাত্রলীগকে তা থেকে কিছু দিয়ে দেব। কিন্তু আমি তাদের কথায় রাজি হইনি এবং মুখের ওপরে বলে দিয়েছি আমি কোনো টাকা-পয়সার মধ্যে নেই। তখন তারা আমাকে বলল, আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন।

সেজন্য আপনার কাছে এসেছি। তখনও তাদের কথায় সাড়া না দেয়ায় তারা আমার সঙ্গে বেশ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা শুরু করে। এর কিছু সময় পর তারা চলে যায়।’ তারা কত পার্সেন্ট দাবি করেছিল- এমন প্রশ্নে ভিসি বলেন, ‘দু-এক পার্সেন্ট না, তারা চার কিংবা ছয় পার্সেন্টের কথা বলেছিল।’

প্রসঙ্গত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের জন্য এ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে ৫টি আবাসিক হল (তিনটি ছাত্র ও দুটি ছাত্রীনিবাস) নির্মাণের জন্য ৩৬৭ কোটি টাকার টেন্ডার চূড়ান্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় শোভন ও রাব্বানীর প্রসঙ্গ টেনে ভিসি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি নাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনা করার জন্য তাদের (শোভন-রাব্বানী) দায়িত্ব দিয়েছেন? তখন প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব কী? আমি তাদের কেন এ দায়িত্ব দেব?

এ সময় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন।’ এ সময় তিনি জাবি ছাত্রলীগ সম্পর্কেও কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানাকে ‘ভালো’ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম সুফিয়ান চঞ্চলকে ‘দূরে থাকে বা নিষ্ক্রিয়’ বলে মন্তব্য করেন।

ভিসি বলেন, প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে চলমান আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ‘সম্মানী মানুষকে কেন (তদন্ত কমিটি করে) আমরা অসম্মানিত করব? যারা আপনাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলছে, তারাই প্রমাণ করুক।

কোনো উড়ো চিঠি কিংবা উড়ো খবরের ভিত্তিতে কিছু করা হবে না।’ ভিসি আরও বলেন, ‘এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়ে আমার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প না চায় তবে দেব না।

আপনি না বলে দেন। তবে এ নিয়ে যেন আন্দোলন না হয়।’ এ সময় তিনি (প্রধানমন্ত্রী) পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও আড়িয়াল বিলের প্রকল্পকে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করেন বলেও জানান ভিসি।

ভিসির বাসভবন সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্যের পর ভিসির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রাব্বানী প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন।

সোমবার রাতে রাব্বানীর অনুসারী বলে পরিচিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবর রহমান সালেহী, ছাত্রলীগ কর্মী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪২ ব্যাচের রতন বিশ্বাসসহ চারজন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে যান।

তবে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করে। তবে সালেহী ওইদিন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে যায়নি বলে দাবি করেন। আর রতন বিশ্বাসের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমরা ভিসি ম্যামের সঙ্গে দেখা করেছি, সেটা সত্য। তবে আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি মোটেও সঠিক নয়। ভিসি ম্যাম ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন।

তার একটি টাকাও আমাদের ছিল না। অথচ বলা হচ্ছিল, আমাদের টাকা দেয়া হয়েছে। পরে তার ছেলের মাধ্যমে তিনি আমাদের কল করিয়েছেন। তখন আমরা সেখানে গিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার একটি কাজের জন্য আমাদের ছাত্রলীগের সাবেক এক বড় ভাইয়ের ফার্মের জন্য বলেছিলাম।

ভিসি ম্যাম সেই ফার্মকেও কাজটা দেননি। আমরা সেটা নিয়েও কিছু বলিনি। অথচ এখন উল্টো আমাদের নামে বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে, সেখানেই আমরা কিছু করিনি।

কেউ আমাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারেনি। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কেন করব।’

হল ও মাস্টাপ্ল্যান ইস্যুতে আলোচনা ইতিবাচক, দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন কার্যদিবস সময় নিয়েছে : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ইস্যুতে তিন দফা দাবি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন আন্দোলনকারীরা।

বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় নতুন প্রশাসনিক ভবনে আলোচনা শুরু হয়ে চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারী ২২ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলোচনায় অংশ নেন।

আলোচনা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনকারী জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের তিনটি হল স্থানান্তর ও মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

আর দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন কার্যদিবস সময় নিয়েছে।

আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের উত্তর-পশ্চিম পাশের হলটি ১০০ ফিট দূরে এবং দক্ষিণ ও পূর্বপাশের নির্মিতব্য হল দুটি অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ, বিশেষায়িত ও মনিটরিং নামে তিনটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি মাস্টারপ্ল্যান পুনর্গঠন ও প্রকল্পের স্বচ্ছতার বিষয়ে সার্বিক তদারকি করবে।

অপরদিকে দুর্নীতির তদন্তের জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরদিন বুধবার প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারীরা আবার বৈঠকে মিলিত হবে বলে জানান সাংস্কৃতিক জোটের প্রচার সম্পাদক মারুফ মোজাম্মেল।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন, প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক নুরুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) রহিমা কানিজ, প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) আহসান হাবিব অংশ নিয়েছেন।

আর আন্দোলনকারীদের পক্ষে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আলোচনায় অংশ নেয়া অধ্যাপকরা হলেন, খবির উদ্দিন, জামাল উদ্দিন, কামরুল আহসান, শামীমা সুলতানা, রায়হান রাইন, আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া নুরুল ইসলাম ও তারেক রেজা।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম পাপ্পু, প্রচার সম্পাদক মারুফ মোজাম্মেল, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয়, সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক, কার্যকরী সদস্য রাকিবুল রনি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদার, সাংগঠনিক সম্পাদক শোভন রহমান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) শাখা সভাপতি মাহাথির মোহাম্মদ, সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত দে, দফতর সম্পাদক রেবেকা আহমেদ এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখপাত্র খান মুনতাসির আরমান, যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন শিশির ও আরিফুল ইসলাম আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।