কত অজানারে জানাইলে তুমি…।’ ফোরাম এসডিএ সম্পর্কে সবিস্তারে জেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথাটুকুই মনের ভেতর বেজে উঠল। জানা ছিল, তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি ঈদুল আজহার তৃতীয় দিন পশু জবাই করে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের হাতে মাংস পৌঁছে দেয়। ১৩ আগস্ট প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে এই নিয়েই কথা শুরু করেছিলাম। কথাটি পাড়তেই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করলেন ফোরাম ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস (ফোরাম এসডিএ) নামের সংগঠনটির সভাপতি এ এম রায়হান ও সাধারণ সম্পাদক রাফায়েত রোমান। তাঁদের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল তথ্যের মধ্যে ঘাটতি আছে! এ এম রায়হান হাসিমুখে বলতে থাকেন, ‘গরুর মাংস বিলি-বণ্টন আসলে পুরো উৎসবের ছোট একটি অংশ।’

মেহেদি অাঁকামেহেদি অাঁকা উৎসব?

‘জি, উৎসব। আমাদের আয়োজনটি প্রত্যন্ত চরের মানুষের জন্য আনন্দ উৎসব। বলা যায়, অসহায় ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা।’

রায়হানের কথায় আরও জানা যায়, প্রতিবছর ঈদুল আজহার তৃতীয় দিন ফোরামের সদস্যরা ছুটে যান প্রত্যন্ত কোনো এলাকায়। সে এলাকায় আগে থেকেই জানানো হয় আয়োজন সম্পর্কে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরা মানুষের তালিকা তৈরি করেন। সবাই যেন স্বাচ্ছন্দ্যে খাবার বা অন্য উপহার হাতে পান সে জন্য দেওয়া হয় টোকেন।

রান্নার আয়োজনরান্নার আয়োজন ‘আনন্দ আয়োজন সকাল থেকেই শুরু হয়। সেখানে শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষ সবার জন্যই থাকে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। টোকেন পাওয়া মানুষ তো আসেনই, আসেন সচ্ছল মানুষেরাও। অংশ নেন খেলাধুলায়।’ বলে চলেন রায়হান।

ক্রীড়া পর্বে থাকে মেয়েদের বালিশ ছোড়া, হাঁড়ি ভাঙা, শিশু-কিশোরদের মোরগ লড়াই, পুরুষদের দৌড়, সাঁতার, পিচ্ছিল কলাগাছ বেয়ে ওপরে ওঠার মতো দেশীয় খেলাগুলো। প্রতিটি খেলায় বিজয়ীদের বালতি, হাঁড়ি-পাতিলসহ তাঁদের সাধ্যমতো পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এই ক্রীড়া পর্বের ফাঁকেই পশু জবাই করা হয়। চলে রান্নার পর্ব। বিকেল নাগাদ সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় খাবার। হাসিমুখে ফিরে যান ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত মানুষ।

নতুন পোশাকের আনন্দনতুন পোশাকের আনন্দ এতক্ষণ রাফায়েত রোমান মাথা নেড়ে তাল মিলিয়ে যাচ্ছিলেন। এবার মুখ খুললেন, ‘প্রথম কয়েক বছর আমরা রান্না করে খাইয়েছি। তবে সব সময় রান্নার কাজটি সম্ভব হয় না। তখন অসচ্ছল পরিবারের সদস্যদের মাংস ভাগ করে দেওয়া হয়; সঙ্গে দেওয়া হয় পোলাওয়ের চাল-ডাল-আলু-তেলসহ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। তাঁরা যেন নিজেরাই বাসায় গিয়ে রান্না করে খেতে পারেন, সে চেষ্টাই করা হয়।’

তাঁদের কথায় জানা হয় ফোরাম এসডিএ সম্পর্কে, সংগঠনের বিস্তৃত কার্যক্রম সম্পর্কে, গাঁটের পয়সা আর সময় ব্যয় করে যাঁরা যুক্ত আছেন—সেসব স্বেচ্ছাসেবী মানুষের সম্পর্কেও।

নতুন পোশাক পাওয়ার আনন্দ। ছবি: সংগৃহীতনতুন পোশাক পাওয়ার আনন্দ। ছবি: সংগৃহীত বিরিয়ানির ঘ্রাণ

কোরবানির ঈদের সময় রাজধানীতে নতুন মানুষের আগমন হয়। তাঁদের অনেকে আসেন মাংস সংগ্রহ করতে। কিন্তু সবাই মাংস পেলেও ভালোমতো কি খেতে পারেন? ফোরামের সদস্যরা ভাবলেন, তাঁরা মাংস সংগ্রহ করে পথশিশুদের বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবেন। ২০১৩ সালের ঘটনা এটি। সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংস সংগ্রহ করলেন। রান্নার জন্য পোলাওয়ের চাল-তেল-মসলাপাতি জোগাড়যন্ত্র করা হলো। রাফায়েত বলছিলেন, ‘পরিচিত মানুষের সহায়তাতেই জুটেছিল এই উপকরণগুলো। আমরা প্রায় ৫০০ পথশিশুকে বিরিয়ানি খাওয়াতে পেরেছিলাম।’

বয়স্ক মানুষদের জন্যও থাকে দৌড় প্রতিযোগিতাবয়স্ক মানুষদের জন্যও থাকে দৌড় প্রতিযোগিতা   সেটাই ছিল আপনাদের প্রথম আয়োজন?

‘প্রথম নয়, বলা যায় বৃহৎ আয়োজন। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। চার বন্ধু মিলে ২০১২ সালে ফোরাম এসডিএ প্রতিষ্ঠা করি। স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার কাজ করে সে বছর। এরপর থেকেই দুই ঈদে নিয়মিতভাবে উৎসবের আয়োজন করি।’ রায়হান বলেন।

প্রতিযোগিতার নাম—মিউজিক্যাল চেয়ারপ্রতিযোগিতার নাম—মিউজিক্যাল চেয়ার দশে মিলে করি কাজ

চার বন্ধুর প্রচেষ্টায় শুরু হওয়া ফোরামে দিনে দিনে অনেকেই যুক্ত হন। এই স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই শিক্ষার্থী; আছেন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ। মূল উদ্যোক্তারা ঢাকাতেই থাকেন। তবে ঢাকার বাইরেও আছে স্বেচ্ছাসেবীদের দল। কোনো কর্মসূচির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার সময় ফেসবুক গ্রুপে মুক্ত আলোচনা করা হয়। অর্থ সংস্থানের বিষয়েও কথা হয় সেখানে। নিয়মিত সহায়তা করেন এমন ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবী সদস্য আছেন ফোরামে। এ ছাড়া পরিচিতজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে সহায়তা পান। রোমান বলেন, ‘এমন সহায়তাতেই আয়োজন হয় ঈদ আনন্দ উৎসব, শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণের কাজগুলো। প্রতিটি আয়োজনের সময় হিসাব হালনাগাদ করা হয়। চাইলে অনলাইনেই যে কেউ দেখতে পারেন, কে কত টাকা দিলেন, কোন খাতে কত ব্যয় হলো ইত্যাদি বিষয়।’

ঈদের আনন্দঈদের আনন্দ এবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিনটি গ্রামে হবে এই আয়োজন। তাঁরা জানালেন, এবারের উদ্যোগে নতুনত্ব এসেছে। আগে পশু জবাই করে সবাইকে খাওয়ানো হতো কিংবা মাংস বিতরণ করা হতো। এবার আহ্বান জানানো হয়েছে কোরবানির। সাতজন পর্যন্ত শরিকানার মাধ্যমে তিনটি গরু কেনা হয়েছে। তবে অন্য আয়োজনগুলো থাকছে আগের মতোই।

কলা গাছ বেয়ে ওঠা সোজা নয়!

তো আমাদের প্রিয়জন। ঈদের পরদিন বাড়ি থেকে ছুটে আসতে তাই কষ্ট হয় না। সেখানে গিয়ে যে প্রাপ্তি তা বোঝানো যাবে না। একজন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে আনন্দ, তা ঈদ আনন্দের চেয়ে কিছু কম নয়।’

ঈদ মানেই তো ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরকে বুকে টেনে নেওয়ার উজ্জ্বলতম খুশির দিন। ঈদের মহিমা তো এটাই। ফোরাম এসডিএর তরুণেরা সে মহিমা মন্ত্রেই কাজ করে যাচ্ছেন—নিভৃতে, খুশি মনে। তাঁদের আনন্দ বিলানোর এই অভিযাত্রা অমলিন থাক।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here