প্রফেসর মোঃ আব্দুল হাইঃ

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ জুড়ে ফেসবুকের প্রোফাইল গুলো গর্বিত পিতা ও কন্যা সন্তানের সুন্দর সুন্দর ছবিতে ভেসে যেতে দেখেছি। বাতিকগ্রস্ত মনে প্রশ্ন জেগেছে সবই কি কন্যা সন্তানের মঙ্গল কামনায় ! নাকি শ্বাপদ সংকুল এই জনপদে কন্যা সন্তানের জন্য যে অনিশ্চিত ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে, অনাগত সেই বিপদের আঁচ পেয়ে পিতারা কন্যা সন্তানের জন্য সবার দোয়া কামনা করছেন। আবার এও মনে হয়েছে, আমরা নিজের কন্যার নিরাপদ ভবিষ্যত রচনায় যেরকম ব্যগ্র অন্যের কন্যা সন্তানের জন্য কি একই রকম সংবেদনশীল ! বলছি ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের কথা। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনি সহায়তা ও ন্যায্য অধিকার , চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে দিবসটির সূচনা। বলাবাহুল্য ৮ মার্চ পালিত নারী দিবসের উদ্দেশ্য ও মূলত একই । কন্যা শিশু দিবস থেকে নারী দিবস এবং কন্যা শিশু ও নারীর অবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির ধনাত্মক অভিঘাত কি সমাজে দৃশ্যমান? তাই যদি হবে তাহলে সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনা , রাজশাহীর চার্চের ঘটনা , নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ঘটনা এবং নারায়ণগঞ্জ ও  বরগুনার মত ঘটনাগুলোর বাড়বাড়ন্ত ঘটছে কেন দেশে? এসব কি অশিক্ষা – কুশিক্ষার ফল, সামাজিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ , নাকি নষ্ট রাজনীতির প্রতিক্রিয়া ? এসব বুঝতে হলে সমাজে কন্যা শিশু তথা নারীর অবস্থান কেমন, নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি , নারীর প্রতি সহিংস আচরণের কারণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে নারীর নিজস্ব মনোভঙ্গির নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

যে সময়ে আমরা কন্যা শিশু দিবস পালন করছি সে সময়ের সংবাদ শিরোনাম হতে দেখছি,  ৬ বছরের কন্যা শিশু ধর্ষণের। মসজিদের ছাদে ইমাম কর্তৃক ধর্ষণ, চার্চের ফাদার কর্তৃক ধর্ষণ , কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রনেতা কর্তৃক ধর্ষণ, প্রাক্তন স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দলবেঁধে  ধর্ষণ, পাড়ার বখাটে কর্তৃক দলবেঁধে গৃহবধূকে ধর্ষণ প্রভৃতি । পুরো দেশটা যেন কন্যা তথা নারী নির্যাতনের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত নয় মাসে দেশে ৯৭৫ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে । এর মধ্যে আগস্টে ১১০ জন এবং সেপ্টেম্বরে কন্যা শিশু সহ ১২৯ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন । যার মধ্যে দশটি গণধর্ষণের ঘটনা রয়েছে।

আবহমানকাল থেকেই নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য চলে আসছে । এই আধিপত্য কখন কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে  “অগাস্ট বেবেলের ” ভাষ্য পাওয়া যায় তাঁর লেখা, “নারী : অতীত-বর্তমানও ভবিষ্যৎ” গ্রন্থে । মূলত নারীর উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকেই নারী নির্যাতনের সূত্রপাত হয় । ইংরেজ দার্শনিক ‘জন স্টুয়ার্ট মিল ‘ তাঁর “সাবজেকশন অফ উইমেন ” গ্রন্থে নারীদেরকে নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য করার জন্য পুরুষদের নিন্দা করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর লেখিকা “মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ” তাঁর ” ভিন্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস অফ উইমেন (১৭৯২) গ্রন্থে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, নারী প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষ অপেক্ষা হীন এমনটি নয় । শিক্ষার অভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে । এভাবে ‘ক্লারা জেটকিন ‘থেকে ‘রোজা লুক্সেমবার্গ’ হয়ে রাজা রামমোহন রায় , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন  প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আজকে সমাজে নারীর অবস্থান।

সমাজের বিরুদ্ধ স্রোতের মোকাবেলা করে নারীকে সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কবি-সাহিত্যিকদের অবদানও কম নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি নাটকের গানে বলছেন,

          আমি তোমার মাটির কন্যা
          জননী বসুন্ধরা
          তবে আমার মানব জন্ম
          কেন বঞ্চিত করা।

          কোন স্বর্গের তরে
           ওরা তোমায় তুচ্ছ করে
           রহি তোমার বুকের পরে।

আবার চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্য বলছেন ,

  আমি চিত্রাঙ্গদা আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী
  নহি দেবী,  নহি সামান্যা নারী,
  পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি,
  হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।
  যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটে সম্পদে,
   সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
   পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।

নারীকে অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে যে পরিবর্তন সম্ভব নয়, পরিবর্তনের জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার, নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা পোষণ দরকার সেটি রবীন্দ্রনাথ বলার চেষ্টা করেছেন। এই কথাগুলোই আরো সোজা সাপ্টা ভাষায় বলেছেন কাজী নজরুল ইসলাম তার নারী কবিতায় :

     ‌ সাম্যের গান গাই
      আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই
      বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
      অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

   নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদিপাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।

বিচ্ছিন্ন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের নানা রকম সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ফলে বর্তমানে কন্যা শিশু তথা নারীর লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে অধ্যয়ন সহ শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ।মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে ।স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের হার কমে এসেছে ।খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও সফলতা এসেছে। ২০১৮ সালে করা দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ তম । সার্বিক নারী উন্নয়ন সূচকে ১৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪ তম।

এতো কিছু সত্বেও কন্যা শিশু তথা নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? নারীর প্রতি আমাদের মনোভাব কি পাল্টেছে? এখনো অনেক পরিবারেই কন্যা সন্তান জন্মদান কে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এখনো অনেক পরিবারে পুত্র সন্তানের প্রত্যাশায় চার পাঁচ টি কন্যা সন্তান জন্মদানের ঘটনা ও আমরা প্রত্যক্ষ করি। ফলাফল হিসেবে জন্মদাত্রী মায়ের উপর নির্যাতনের ঘটনাও বিচিত্র নয় । নির্যাতনের শিকার নারীদের একটি বড় অংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবিএস ও ইউনিসেফের করা মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) -২০১৯ এর ফলাফলে কন্যা শিশু ও নারীদের নানা ধরনের পশ্চাৎপদতার চিত্র উঠে আসে। কিশোরীদের সন্তান জন্মদানের হার(৮৩) । শিশু বিয়ে এখনো ব্যাপকভাবে প্রচলিত । বর্তমানে ১৫-১৭ বছর বয়সী ১৫.৪ শতাংশ নারী বিবাহিত । এছাড়াও  ২০-২৪ বছর বয়সী ১৫.৫ শতাংশ নারীর ১৫  বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয় । ইউনিসেফের হিসাব বলছে বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ মেয়েই বাল্যবিয়ের শিকার হয় । যদিও সরকারি হিসাব বলছে এই হার ৫২ শতাংশ। ফলশ্রুতিতে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ, অপরিণত শিশুর জন্মদান ও শিশু মৃত্যুর মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। প্রকৃতপক্ষে কন্যা শিশু পরিবারে, পরিবারের বাইরে , খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে, পোশাক পরিধানের ব্যাপারে, পেশা নির্বাচনের ব্যাপারে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে , সর্বত্র অবহেলার শিকার হচ্ছে।

নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকিয়া সাখাওয়াত হোসেন সমাজে নারীর পশ্চাৎপদ অবস্থা অবসানের জন্য নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন । তাঁর মতে এই স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে জীবিকা অর্জনের মাধ্যমে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন। কিন্তু কর্মজীবী নারীকে কর্মক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে । আর একই ধরনের কাজে পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম পারিশ্রমিক প্রাপ্তি খুব সাধারণ ঘটনা।

বিশ্বায়নের এই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমন বিশ্বায়ন হয়েছে তেমনি মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও ভোগবাদিতার ও বিশ্বায়ন হয়েছে । ভোগবাদী সমাজে সবকিছুকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এখানে কন্যা তথা নারী ও পন্য বই ভিন্ন কিছু নয় । তাইতো প্রচারমাধ্যমে সাবান , পাউডার ,রঙ ফর্সাকারী ক্রিম, লোশন এর মত বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। কোথাও দশদিনে রং ফর্সা করার হাতছানি, আবার কোথাও বা গ্লো বাড়ানোর আগ্রাসী প্রচারণা। এসব প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে নারী কখনো অবচেতনে আবার কখনোবা সচেতনভাবেই নিজেকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। তসলিমা নাসরিনের ভাষায়, ” নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বুঝতো যে জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে , সবচেয়ে বড় নির্যাতন হলো মেয়েদেরকে সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেওয়া।”

আবার ক্ষেত্রবিশেষে নারীর নিজস্ব মনোভঙ্গি ও নির্যাতন কে উস্কে দেওয়া বা নির্যাতন আহবানের গোপন কারণ হতে পারে। গণমাধ্যমে নাটক-সিনেমা বা বিজ্ঞাপনে যখন একজন নারী তাঁর জীবন সঙ্গীকে সাহেব , বড় সাহেব , কর্তা  জাতীয় বিশেষণে অভিহিত করে তখন তাঁর অধীনস্থ থাকার মানসিকতাই প্রকাশ পায়।

নাটক সিনেমায় নারী চরিত্র উপস্থাপন এবং গানের ভাষা ও কখনো কখনো নারীর প্রতি সহিংস আচরণের কারণ হতে পারে। ” রুপে আমার আগুন জ্বলে” বা   “আমি ডানা কাটা পরি” জাতীয় গান শুধু অশ্লীল কুরুচিকর নয় নারীর সম্মানহানিকর ও বটে। আবার বিপিএল এর (অথবা সাফ গেমস) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একজন স্বনামধন্য গায়িকা যখন গেয়ে শোনান  ” ও আমার রসিয়া বন্ধুরে, তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না, তুমি কেন জংলি ছাপার শাড়ি হইলা না ” তখন জাতি হিসেবে আমাদের সাংস্কৃতিক দীনতার প্রকাশ ঘটে। নারী সমাজ তথা সমাজের সর্বস্তর থেকে এসবের প্রতিবাদ হওয়া উচিত।

প্রকৃতপক্ষে নারী উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি হলেও নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টায়নি সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য আচরণের ব্যাপকতা সে কথারই ইঙ্গিত দেয়। নারীর প্রতি এরকম ঘৃন্য সহিংস আচরণ অবসানের জন্য সমাজের সকলের সচেতনতা প্রয়োজন । প্রয়োজন আইনের যথাযথ সংস্কার ও কঠোর প্রয়োগ । নির্যাতিতার সামাজিক শ্রেণী, পেশা ও পরিচয় কে গুরুত্ব না দিয়ে নির্যাতনকারীর শাস্তি বিধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। সর্বোপরি নারীকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তাকে বিবেচনা করতে হবে । তবেই নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হবে এবং কন্যা শিশু দিবস ও নারী দিবসের উদযাপন যথাযথ হবে।

 লেখক: বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। 

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here