সবুজদেশ ডেক্সঃ   ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আনুষ্ঠানিক প্রচারণাও শুরু করেছে দলটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রচারণা শুরু করবেন কাল বুধবার।

আসন সমঝোতার বাইরে জোটের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) ও মিত্র দলের বিপুল প্রার্থী হওয়া নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, এভাবে শরিকদের প্রার্থী রাখার বিষয়টি কেন্দ্রীয় কৌশলের অংশ। কোনো প্রার্থী মহাজোটের প্রার্থীদের জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ালে নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এই কৌশল কোনোভাবে ব্যর্থ হলে এর মূল্য দিতে হতে পারে, এই শঙ্কাও আছে।

অন্যদিকে ১৪ দল ও জাপার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আসন সমঝোতায় এবার খুব বেশি সুবিধা করা যাবে না, এটা আগেই ধারণায় ছিল। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের কাছে মুখ রক্ষার জন্য নিজস্ব প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে শরিকেরা। এ ছাড়া জাপার মধ্যে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এতটা প্রবল ছিল যে, সমঝোতার বাইরে দলের নেতাদের ভোট করতে না দেওয়া হলে দলটি বেকায়দায় পড়ে যেত। এ জন্যই আওয়ামী লীগের সবুজ সংকেত পেয়েই সমঝোতার বাইরে আরও ১৪৮ আসনে প্রার্থী দেয় তারা।

তবে জাপা দাবি করছে, সমঝোতার মাধ্যমে ২৯টি আসন পেয়েছে তারা। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও জাপার প্রার্থী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাপা আসলে ২৬টি আসন পেয়েছে।

আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও জাপার নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, বিএনপিসহ বিরোধীরা মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন বা প্রচার-প্রচারণায় নেমে ভোটের আগে আগে পরিবেশ নেই অভিযোগ তুলে বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে—আওয়ামী লীগের মধ্যে এই আশঙ্কাও আছে। এ জন্য জোটের শরিক ও মিত্রদলগুলোকে নিজের মতো করে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সায় দেয়। এ ছাড়া এবারের নির্বাচনে বেশি প্রার্থী, বেশি দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা ছিল। এ জন্যই জোটের শরিক ও জাপার বিপুল প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেনি আওয়ামী লীগ। যত প্রার্থী তত এজেন্ট দেওয়ার সুযোগ আছে। প্রয়োজন হলে শরিক ও জাপার প্রার্থীদের এজেন্ট হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও দেওয়া যাবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, ১৪ দলের শরিক দলের যাঁরা নিজস্ব প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে প্রভাব ফেলতে পারবেন না। মূল সমস্যা হয়ে উঠতে পারে জাপা। এ ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের কিছু আসনে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভোটের আগে আগে স্থানীয়ভাবে জাপা ও জোটের শক্ত প্রার্থীদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করা হবে। প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয়ভাবেও উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরবঙ্গের অন্তত ২০টি আসনে জাপা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। সারা দেশে আরও এমন ১০-১৫টি আসনে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে জাপা প্রার্থীদের। পরিকল্পনা মতো সবকিছু না ঘটলে জাপা আওয়ামী লীগ ও জোটের অন্য শরিকদের ভোগাতে পারে। ওই নেতা বলেন, এরশাদকে আগে থেকে বোঝা কঠিন। কখন কী করেন বলা যায় না।

অতীতের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাপার হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ ১ লাখ ১৩ হাজার ভোটে বিএনপির প্রার্থীকে হারান। এবার এ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলী। হাফিজ আহম্মেদ লাঙল প্রতীকে ভোট করছেন। ওই নির্বাচনে নীলফামারী-১ আসনে জাপার জাফর ইকবাল সিদ্দিকী মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে পৌনে দুই লাখ ভোট পেয়ে বিএনপির প্রার্থীকে হারান। এবার আওয়ামী লীগ নিজ দলের আফতাব উদ্দিন সরকারকে প্রার্থী করেছে। আবার লাঙল নিয়ে আছেন জাফর ইকবাল সিদ্দিকী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে রংপুর-২ আসনে জাপার আনিছুল ইসলাম মণ্ডল ১ লাখ ৩০ হাজার ভোটে বিএনপির প্রার্থীকে হারান। এবার এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম মোহাম্মদ আহসানুল হক চৌধুরী। জাপার লাঙলের প্রার্থী আসাদুজ্জামান চৌধুরী। আনিছুল ইসলাম মণ্ডলও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

কুড়িগ্রাম-১ আসনেও আওয়ামী লীগের ভয়ের কারণ আছে। এখানে ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাপার এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান ২ লাখ ভোট পান। এবার আছলাম হোসেন সওদাগর আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আর মোস্তাফিজুর রহমান জাপার প্রার্থী।

এবার নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সবগুলোই অংশ নিয়েছে। অনিবন্ধিত দলগুলো নানা জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোনো একটা নিবন্ধিত দলের প্রতীকে ভোট করছে। আওয়ামী লীগ নিজে এবার ২৬০টি আসনে ভোট করছে। ১৪ দল ও যুক্তফ্রন্ট পেয়েছে ১৪ আসন। জাপা পেয়েছে ২৬ আসন। জাপা ছাড়াও ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি ও যুক্তফ্রন্ট আলাদাভাবে শ’ খানেক প্রার্থী দিয়েছে।

অবশ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, জোট ও মিত্রদের বিপুল প্রার্থী মহাজোটের প্রার্থীর ভোটে প্রভাব ফেলবেন না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগই বলেছে কেউ যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে নিজেদের অবস্থান ও সাংগঠনিক শক্তি দেখার জন্য নিজেদের প্রার্থী দিতে পারবে।

বিভ্রান্ত জাপা সংগঠিত হতে চাইছে
মহাজোটের শরিক থাকা না–থাকা, আসন সমঝোতা, ভোটে অংশগ্রহণ—সব প্রক্রিয়াতেই এইচ এম এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা বিশ্বাস-অবিশ্বাস বজায় ছিল। প্রার্থী মনোনয়ন, বাছাই ও প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার পুরো সময়টাতেই এরশাদ অসুস্থ হয়ে সিএমএইচ হাসপাতাল ও বাসায় আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগেও এরশাদ অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি ছিলেন। এ জন্য এবারের হাসপাতাল-বাসায় আসা যাওয়ার ঘটনায় এক ধরনের সন্দেহের জন্ম দেয়। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর রাতে চিকিৎসার জন্য এরশাদ সিঙ্গাপুরে গেছেন।

জাপা সূত্র বলছে, এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাপার চেয়ারম্যান এরশাদ, দলের সদ্য সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা অংশের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এরই অংশ হিসেবে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মশিউর রহমানকে মহাসচিব করা হয়। পরদিনই আবার হাওলাদারকে বিশেষ সহকারীর পদ দেন এরশাদ।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক আসন সমঝোতার বৈঠক হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে যে যার যার মতো করে আসন নিয়ে কথা বলেছেন। জাপা রোববার দাবি করে, মহাজোট থেকে তাদের ২৯টি আসন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম-১, বরিশাল-৩ ও টাঙ্গাইল-৫ আসন জাপা নিজেদের দাবি করেছে। কিন্তু এই তিন আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল-৫ আসনে গত রাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়। অন্যদিকে বিকেলে জাপা জানায়, সমঝোতার বাইরে আরও ১৩২ আসনে নিজস্ব প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। রাতে নির্বাচন কমিশনে আরও ১৩ জনের নাম পাঠায় জাপা। ফলে সব মিলিয়ে সমঝোতার বাইরে তাদের প্রার্থী আছে ১৪৮ আসনে।
গতকাল জাপার চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, মহাজোটে জাতীয় পার্টি যে কটি আসন পেয়েছে, তাতে পার্টির নেতা-কর্মীরা সন্তুষ্ট নন। কিন্তু মহাজোটের স্বার্থে তাঁরা মেনে নিয়েছেন।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আ. লীগের কৌশল
এবার নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকেই ধর্মভিত্তিক কিছু দলকে আওয়ামী লীগ কাছে টানার চেষ্টা শুরু করে। এর প্রয়াত মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামি ঐক্যজোট, মোস্তফা আমির ফয়সালের জাকের পার্টি, বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদীর ইসলামিক ফ্রন্ট ও মিছমাহুর রহমান ও এম এ আউয়ালের ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স অন্যতম। শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো আসনে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, এই দলগুলোর ভোট আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়বে না। মূলত তারা যাতে বিএনপি জোটে না ভিড়ে যায়, সে জন্যই কাছে টানার কৌশল নেয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here