বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি রাশেদ চৌধুরীকে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনিক নীতি, তাঁর ঘোষণা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অব্যাহত প্রচেষ্টায় শিগগিরই এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক খবর মেলার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
অপরাধীদের আমেরিকায় আশ্রয় দেওয়া, লালন-পালন করার নীতি থেকে সরে আসার কথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জোরেশোরে বলে আসছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের টানা উদ্যোগের কারণে অনেকেই এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর (বরখাস্ত) এ এম রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া এবং পরিণতি ভোগ করা এখন সময়ের ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে। নানা কাজে সমালোচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ভিন্নভাবে সমাদৃত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে মত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাশেদ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পরে ১৯৯৮ সালে নিম্ন আদালতের রায়ে অন্য আসামিদের সঙ্গে পলাতক অবস্থায় তাঁকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত ১২ জন কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জনের রায় কার্যকর হলেও রাশেদ চৌধুরীসহ বিদেশে পলাতক অন্যদের দণ্ড কার্যকর হয়নি। এসব ঘাতকদের বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে নিয়ে দণ্ড কার্যকর করার জোরালো দাবি জানানো হচ্ছিল।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, রাশেদ চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকে মার্কিন আমেরিকায় বসবাস করছেন। তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইন্টারপোল ২০০৯ সালে আমেরিকাকে সতর্ক করে দেয়, একজন দণ্ডিত হত্যাকারীকে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের মার্কিন নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন লিখেন ‘দুর্ভাগ্যবশত, হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায় অবস্থান করছেন। এই অবিচারের অবসান হওয়া উচিত। রাশেদ চৌধুরীর ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।’

রাশেদ চৌধুরী শিকাগো, সিয়াটল, আটলান্টা ও ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন শহরে বসবাস করে আসছেন। কদাচিৎ তাঁকে জনসমক্ষে দেখা গেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। সম্প্রতি এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে উভয় দেশের মধ্যে সভা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক রক্ষণশীল অভিমতভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য কলার ফাউন্ডেশনকে রাষ্ট্রদূত জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা আসার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাড়তি আশাবাদ পাওয়া গেছে। ওবামা প্রশাসনের সময় বাংলাদেশের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও খুনিদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো কার্যকর অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি।’

রাষ্ট্রদূত গত ২৪ ও ২৫ জুলাই এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমন্ত্রী জন জে সুলিভানের সঙ্গে বৈঠক করেন। ১ আগস্টের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনের কাছে বার্তা দিয়েছেন, রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুপিতে নতুন পালক যুক্ত হবে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি প্রশংসিত হবেন।
মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রাশেদ চৌধুরীর সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করা হবে। বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে রায় পর্যালোচনা করার অনুমতি দিতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানানো হয়েছে। রাষ্ট্র একজন আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে এবং রাশেদ চৌধুরী উচ্চ আদালতে নিজেকে উপস্থাপনের সুযোগ পাবেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, অপরাধ করে যারা আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছে—তাদের সবাইকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। রাষ্ট্রদূত জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘এটি আমাদের কাছে সুসংবাদ। আমরা মনে করি, রাশেদ চৌধুরী একজন নিশ্চিত দণ্ডিত হত্যাকারী।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে বিচার থেকে খুনি চক্রকে রেহাই দেয় তৎকালীন সরকার। খুনিদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। রাশেদ চৌধুরীকে জাপানে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি আইন বাতিল হলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের পথ খুলে যায়। অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবু নাসের সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি নর্থ ক্যালিফোর্নিয়াতে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে রাশেদ চৌধুরীকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। ‘খুনি’ উল্লেখ করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার জন্য বলার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন রাশেদ চৌধুরী। আমি মনে করি, এটি সত্যিই আমেরিকার জন্য অবমাননাকর। একজন খুনিকে মুক্ত জীবন উপভোগ করতে দেওয়া হচ্ছে।’
রেকর্ড ঘেঁটে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যানডোর এলাকায় রাশেদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী মুমতাজ চৌধুরীর মধ্যে বাড়ি নিয়ে একটি লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। চার বেডরুমের এই বাড়ির বাজার মূল্য প্রায় ছয় লাখ ডলার দেখানো হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন উন্নয়ন বিষয়ক এক উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘একজন হত্যাকারীকে আশ্রয় দেওয়া নৈতিক দিক থেকে যেমন খারাপ, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। একটি সার্বভৌম দেশের আইনি প্রক্রিয়া থেকে পালিয়ে বাঁচা, বিশেষ করে যখন এটি একটি দেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি হত্যাকাণ্ড।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ঢাকা অফিস ২০০৯ সালে মার্কিন সরকারকে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ করে। ওবামা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সে সময় ইন্টারপোলের অনুরোধে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। মার্কিন বিচার বিভাগের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এর আগে কয়েক দফা কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও অনুরোধ করার পর রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে কার্যত কোনো মার্কিন আশ্বাস পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালে ঢাকায় বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা আমেরিকায় খুনি রাশেদ চৌধুরীর বসবাসের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এর আগে ২০০৭ সালের জুনে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি এ কে এম মহিউদ্দিনকে আশ্রয় দেওয়ার আবেদন আমেরিকা প্রত্যাখ্যান করায় তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল। জর্জ বুশের শাসনামলে দেশে ফেরত যাওয়া মহিউদ্দিন আহমেদকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দেশে চূড়ান্ত দণ্ড ভোগ করতে হয়। খুনি রাশেদ চৌধুরীর পরিণতিও একই হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here