সবুজদেশ ডেক্সঃ  মামলা ও গ্রেপ্তার–আতঙ্কে গতকাল প্রচারণা শুরুর প্রথম দিনে বিএনপির প্রার্থীরা ছিলেন অনেকটা ম্রিয়মাণ। প্রতীক পেয়েই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু জায়গায় মিছিল ছাড়া সারা দেশে তেমন উৎসাহের সঙ্গে প্রচারণায় নামেননি ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা।

গতকাল প্রচারণা শুরুর প্রথম দিনেই ঢাকা মহানগর বিএনপির (উত্তর) সহসভাপতি আবদুল আলী নকীকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। নোয়াখালীর কবিরহাট ও নাটোরের লালপুরে ধানের শীষের প্রচার-গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে বিএনপির প্রার্থী ইসহাক চৌধুরীর বাড়িতে বৈঠক করার সময় পুলিশ ঘেরাও করে ১৫ জনকে আটক করেছে।

বিএনপি অনেক আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছে, নির্বাচনে এখনো সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়নি। ‘গায়েবি’ মামলায় গ্রেপ্তার, হয়রানিসহ নানামুখী চাপের ভেতরে তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ অবস্থায় ধরপাকড় নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।

বিএনপির সূত্র জানায়, সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচার শুরু করবে। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা আ স ম আবদুর রব, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান ও আবদুল আউয়াল মিন্টু কাল সিলেটে যাবেন। তাঁরা সিলেট সদরসহ ফিরতি পথে তিনটি সভা করতে পারেন।

এদিকে ৩০০ আসনে নিজ দল ও দুই মিত্র জোটের কিছু মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে বিএনপিতে। তবে সব ছাপিয়ে আলোচনা এখন দলের নতুন প্রার্থীদের নিয়ে।

দলটির প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এবার ভোটযুদ্ধে বিএনপির ভরসার বড় জায়গায় রয়েছে তৃণমূলের একঝাঁক তরুণ ও নতুন মুখ। যার সংখ্যা বিএনপির দলগত মোট প্রার্থীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি। যদিও অনেক নতুন প্রার্থী নিয়ে দলে সমালোচনাও আছে।

বিশেষ করে ঢাকা মহানগরী, চট্টগ্রামসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু আসনে বিতর্কিত ও দুর্বল প্রার্থী দেওয়া নিয়ে কথা উঠেছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীর অন্তত চারটি আসনের প্রার্থী নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা সমালোচনার মুখে আছেন। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে অন্তত পাঁচটি আসনের (২,৪, ৬,৮ ও ১২) প্রার্থী নিয়েও বিতর্ক আছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-৮ আসনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খানকে বাদ দিয়ে তাঁর জায়গায় চট্টগ্রাম মহানগরীর নেতা আবু সুফিয়ানের মনোনয়নে দলের অনেকে বিস্মিত হয়েছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০–দলীয় জোটের শরিকদের ৬০টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। ২৪০ টিতে বিএনপির যে প্রার্থী তালিকা, তাতে দেখা যায়, ৮৯টি আসনের প্রার্থী একেবারেই নতুন মুখ। তাঁরা এর আগে কখনো সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হননি। এঁদের বড় অংশ অপেক্ষাকৃত তরুণ। এবার প্রয়াত এবং বিভিন্ন কারণে প্রার্থী হতে না–পারা নেতাদের কারও কারও স্ত্রী-সন্তানদেরও প্রার্থী করা হয়েছে।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সব নির্বাচনেই থাকে। তবে এবার বিএনপি প্রার্থী মনোনয়নে মাঠপর্যায়ের ‘ত্যাগী’ নেতাদের ব্যাপারে উদার ছিল। যে কারণে নতুন মুখের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে বিএনপির উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ের নেতা এবং ছাত্রদল ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাও আছেন। যেমন ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদারকে প্রার্থী করা হয়েছে মাদারীপুর-৩ আসনে। ঢাকা মহানগর যুবদলের দক্ষিণ শাখার সভাপতি রফিকুল ইসলামকে প্রার্থী করা হয়েছে খালেদা জিয়ার আসনে (ফেনী-১)। তারুণ্য এবং আন্দোলনের সময় ঢাকায় তাঁর ভূমিকাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে মনোনয়ন–প্রক্রিয়ায় জড়িত এক নেতা জানান।

আবার ঢাকায় মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস বা যশোরে সদ্য প্রয়াত তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলামের মতো অন্তত ৩০ জনকে প্রার্থী করা হয়েছে, যাঁরা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের স্ত্রী-সন্তান বা আত্মীয়। একজন শেরপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. হজরত আলীর মেয়ে সানসিলা জেবরিনকে শেরপুর-১ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে। ঋণখেলাপির অভিযোগে বাবার মনোনয়ন বাতিল হলে তিনি প্রার্থী হন। পেশায় চিকিৎসক সানসিলা জেবরিন নিজেকে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলে দাবি করেছেন।

ঢাকায় দুর্বল প্রার্থী
ঢাকা মহানগরীর ১৫টি আসনের মধ্যে বিএনপি নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছে ১০ টিতে, ৫টি ছেড়েছে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চার শরিক দলকে। এর মধ্যে তিনটি আসনে বিএনপির প্রার্থী নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা আছে। জোটের প্রার্থীদেরও অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে করা হচ্ছে। ঢাকা-১১ আসনে বিএনপির প্রার্থী শামীম আরা বেগম, ঢাকা-১২ আসনে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম, ঢাকা-১৬ আসনে আহসান উল্লাহ হাসান। এই তিনজনের মধ্যে শামীম আরা সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুমের স্ত্রী। কাইয়ুম রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যা মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘদিন পলাতক, দেশের বাইরে আছেন। তাঁর স্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে কথা উঠেছে। সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে। আহসান উল্লাহ হাসানও অনেকগুলো মামলার আসামি, তাঁকে সচরাচর জনসমক্ষে দেখা যায় না।

এ ছাড়া ঢাকা-১৪ আসনটি জামায়াতে ইসলামী, ঢাকা-১৭ আসনটি বিজেপি, ঢাকা-৬ ও ৭ গণফোরামকে দেওয়া হয়। ঢাকা-১৮ আসনের প্রার্থী জেএসডির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি এর আগে কখনো নির্বাচন করেননি, প্রার্থী হিসেবেও তেমন পরিচিত নন। ঢাকা-৬ আসনে সাদেক হোসেন খোকার বিশেষ প্রভাব আছে। তাঁর ছেলে ইশরাক হোসেনকে বাদ দিয়ে গণফোরামের নেতা সুব্রত চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এটা স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা মন থেকে মানতে পারছেন না।

ঢাকা-১৪ আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান এবং ঢাকা-১৭ আসন বিজেপির আন্দালিব রহমানকে ছেড়ে দেওয়া নিয়েও বিএনপির নেতাদের মধ্যে নানা কথা আছে। তবে এই দুজন জোটের শীর্ষ নেতা হওয়ায় এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলছেন না।

ঢাকার মনোনয়নে দুর্বলতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের কারণে আমাদের আপস করতে হয়েছে। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির যে প্রার্থী মনোনয়ন, তাতে এবার নবীন, নারী প্রার্থী এবং দুর্দিনে দলের ত্যাগী নেতাদের সংখ্যা বেড়েছে। আমি তো মনে করি, এবার মনোনয়ন অনেক ভালো হয়েছে। প্রবীণদের পাশাপাশি অনেক ভালো মুখও এসেছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here