সবুজদেশ ডেক্সঃ ১৫ বছর আগে মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে পুড়িয়ে মারার মামলায় বিচার না পেয়ে হতাশ বেঁচে যাওয়া একমাত্র সদস্য বিমল শীল। তিনি সংশয়ে আছেন আদৌ বিচার পাবেন কি না! আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এখন ক্লান্ত। মৃত্যুর আগে স্বজন হত্যার বিচার দেখে যেতে চান বিমল। তিনি বলেন, সারা দেশে আলোড়ন তোলা এত বড় ঘটনার বিচার মনে হয় হবে না।

২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের ১১ জনকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ওই পরিবারের এক সদস্য বেঁচে যান। বিমল শীল সেই একজন।

মামলায় ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৪ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। ৩৮ আসামির মধ্যে জামিনে গিয়ে পলাতক রয়েছেন ১৬ জন। গত এক বছরে মাত্র দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর শুধু তারিখ পড়ছে। মামলার এই বিবরণ তুলে ধরে বাদী বিমল শীল বলেন, ‘কীভাবে বিচারের আশা করতে পারি! দিন যতই যাচ্ছে সংশয় বাড়ছে। কোথায়, কার কাছে গেলে বিচার পাব জানি না।’

ঘটনার দিন রাতে বাঁশখালীতে পুড়িয়ে মারা হয় বিমল শীলের বাবা তেজেন্দ্র লাল শীলকে (৭০)। একই ঘটনায় মারা যান বিমলের মা বকুল শীল (৬০), ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল। বিমল শীলের চাচাতো বোন বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), এনি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা তাঁর খালু (মেসো) দেবেন্দ্র শীল (৭২)। পল্লি চিকিৎসক বিমল শীল সেদিন লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার পর থেকে তিনি বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকছেন। খালি পড়ে আছে ভিটেটি। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ঘটনার বিচার না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে স্থানীয় সংখ্যালঘু বাসিন্দারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, তাঁরা আতঙ্কে থাকেন। কখন আবার কী হয়ে যায়।

দেশে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও হত্যার বিচার হচ্ছে না, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানাদাশ গুপ্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিচার না হওয়ায় সংখ্যালঘুরা চরম নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতায় ভুগছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। বাঁশখালীর ঘটনার বিচার না হওয়ার দায়ভার রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা দরকার।

আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার ২৫ মাস পর পুলিশের দেওয়া প্রথম অভিযোগপত্রে বাঁশখালীর বিএনপি নেতা আমিনুর রহমানের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাদী নারাজি দিলে আদালত পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর পুলিশ আবারও আমিনুরকে বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এবারও বাদী নারাজি দেন। সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আমিনুরসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তবে আমিনুরের দাবি, রাজনীতি করার কারণে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর নাম জড়ানো হয়। এর মধ্যে এক আসামির নাম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

বর্তমানে তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মুনসী আবদুল মজিদের আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সর্বশেষ ১৪ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও একজন সাক্ষীও হাজির হননি। পরে আদালত আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেন।

কেন মামলাটি নিষ্পত্তি হচ্ছে না জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি বি কে বিশ্বাস বলেন, ঘটনার সময় সাক্ষীরা চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। পরে তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরিসূত্রে চলে যান। তাঁদের হাজির করতে পুলিশকে বারবার বলা হয়। কিন্তু ধার্য দিনে হাজির করা যায় না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা কোর্ট পরিদর্শক বিজন কুমার বড়ুয়া বলেন, সাক্ষীদের অনেকের ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে অনেককে পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী ধার্য দিনে হাজির করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here