১২ আগস্ট, ১৯৪৭। ভারত স্বাধীন হওয়ার তিন দিন আগের কথা। আমার চিকিৎসক বাবা আমাদের তিন ভাইকে ডাকলেন; জানতে চাইলেন আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছি? আমি বললাম, আমি পাকিস্তানে থাকতে চাই, কারণ মুসলমানরা ভারতে থাকবে। আমার বড় ভাই বললেন, পশ্চিম পাঞ্জাবে মুসলমানরা হিন্দুদের ঘর খালি করে দিতে বলছে। আবার একইভাবে পূর্ব পাঞ্জাবের হিন্দুরা মুসলমানদের ঘর খালি করে দিতে বলছে। আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি হিন্দুরা বাড়ি ছাড়তে রাজি না হয়? আমার ভাই বললেন, আমাদের জোর করে উঠিয়ে দেওয়া হবে।

হ্যাঁ ঠিক, এমনটাই ঘটেছিল। স্বাধীনতার পর ১৭ আগস্ট কয়েকজন মুসলমান ভদ্রলোক এসে আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বললেন। আমি তাঁদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কোথায় যাব?’ তিনি তখন তাঁর জলন্ধরের বাড়ির চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তাঁর বাড়িটি আসবাব দিয়ে সুন্দর করে সাজানো আছে এবং এখনই সেখানে ওঠা যাবে। আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম।

ঠিক হলো, আমরা আপাতত দিল্লি যাব। পরিস্থিতি ঠিক হলে ফিরে আসব। ঘরে তালা দেওয়ার সময় আমার মা বললেন, তাঁর মনে হচ্ছে আমরা হয়তো আর কোনো দিন এখানে ফিরতে পারব না।

ব্যাগে কাপড়চোপড় ভরে নিলাম। গন্তব্য দিল্লির দারিয়া গনি এলাকায় মামাবাড়ি। রওনা হওয়ার সময় আমার মা আমাকে ১২০ রুপি দিলেন। আমার বাবা আমাদের যাত্রাকে আরও সহজ করে দিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারকে, যিনি কিনা তাঁর একজন রোগী ছিলেন, অনুরোধ করলেন তাঁর তিন সন্তানকে সীমান্তে নিয়ে যেতে। ব্রিগেডিয়ার জানালেন, তাঁর গাড়িতে তিনজনকে নেওয়ার মতো জায়গা নেই; তিনি একজনকে নিতে পারবেন। পরদিন সকালে আমি ওই ব্রিগেডিয়ারের গাড়িতে করে রওনা হলাম। আমি তখন চোখের জল গোপন রাখতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম কোনো দিন কি আমার আবার সবার সঙ্গে দেখা হবে?

শিয়ালকোট থেকে সামব্রাওয়ালে আসতেই দেখা গেল লোকজনের কাফেলা। হিন্দুরা যাচ্ছে ভারতের দিকে আর মুসলমানরা যাচ্ছে পাকিস্তানের দিকে। হঠাৎ আমাদের গাড়িটি থেমে গেল। একজন বৃদ্ধ শিখ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুরোধ করছিলেন তাঁর নাতিকে যেন আমরা ভারতে নিয়ে যাই। আমি তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি এখনো পড়ালেখা করছি এবং তাঁর নাতিকে সঙ্গে নিতে পারব না।

তখন ওই বৃদ্ধ বলেন, তিনি পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েছেন এবং এখন কেবল তাঁর নাতিটি বেঁচে আছে। তিনি চান তাঁর নাতি বেঁচে থাকুক। আমি এখনো তাঁর অশ্রুসিক্ত মুখটি মনে করতে পারি। আমি তখন তাঁকে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করি। বললাম, আমার নিজের ভবিষ্যতের যেখানে ঠিক নেই, সেখানে কী করে একজন শিশুর দায়িত্ব আমি নেব? এরপর তাঁরা সেখান থেকে চলে যান।

সেই সময় আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা আমি চালিয়ে যাব। আর এ কারণে আমি ওয়াগাহ সীমান্তে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি শুরু করি। ২০ বছর আগে এই কর্মসূচির সূচনা হয়। এটা ছিল খুব ছোট একটি আন্দোলন, যা মাত্র ১৫-২০ জন দিয়ে শুরু হয়। এখন কম করে হলেও দুই দেশের এক লাখ মানুষ প্রতিবছর মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচিতে অংশ নেয়।

জনগণের উৎসাহের কোনো সীমা নেই। কিন্তু দুই দেশের সরকারের এ নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। পুরো সীমান্ত এলাকায় কারফিউ জারি করা থাকে এবং কাউকে সীমান্তে যেতে হলে অনুমতি নিতে হয়। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কাছে চিঠি লিখেছি যেন বিএসএফ ও সিআরপিএফ আমাদের জিরো পয়েন্টে যাওয়ার অনুমতি দেয় এবং আমরা সেখানে মোমবাতি প্রজ্বালন করতে পারি।

আমি চাই সীমান্ত থাকবে শান্ত, যাতে উভয় দেশের বৈরিতা দূর হয়ে যায়। কিন্তু হতাশ হই, যখন দেখি যে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়েছে; যাতে এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যেতে না পারে। আগে উভয় দেশের বুদ্ধিজীবী, সংগীতজ্ঞ ও শিল্পীরা পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, যৌথভাবে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। কিন্তু এখন আর সেসব হয় না। উভয় দেশের সরকারই পরস্পরের দেশের মানুষকে ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে।

পাকিস্তানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়, তা তিনি নিশ্চিত করবেন। কিন্তু আমার উদ্বেগ হচ্ছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে ইমরান হয়তো প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here