ফারুক নোমানী:

মুহাররম ইসলামী হিজরী সনের প্রথম মাস। এ মাস অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। তাৎপর্যের দিক থেকেও এ মাস অসীম গুরুত্ববহন করে। পবিত্র কুরআনে চারটি সম্মানিত মাসের কথা বলা হয়েছে, এ চারটি মাসের অন্যতম মাস হলো মুহাররম। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২, তার মধ্যে ৪ টি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) সম্মানিত।’ (সূরা তওবা : ৩৬)।

মুহাররম মাসকে আবার হাদীসে আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ মাসের করণীয় ও বর্জনীয় কাজের বিবরণও রয়েছে কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসে। মহান আল্লাহ এ মাসে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন পাপ পরিহার করাকে। পাপ সব সময়ই পাপ। তবুও এই সম্মানিত মাসসমূহে বিশেষভাবে পাপ পরিহার করার আদেশ এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহ বলেন-‘অতএব এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ (সূরা তওবা : ৩৬) এখানে জুলুম দ্বারা শুধুমাত্র দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারকে বুঝানো হয়নি। ব্যাপকভাবে সকল পাপকেই বুঝানো হয়েছে। পাপ যত রকম হতে পারে সবগুলো থেকে বেঁচে থাকার আদেশ দিয়েছেন রব্বুল আলামিন মহান আল্লাহ।

সব মাসেই রোযার ফযিলত ও মর্যাদা রয়েছে। তবে রমযান মাসের পর রোযা রাখার শ্রেষ্ঠতম মাস হলো মুহাররম। এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বও দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭)

তাই এ মাসে সকল প্রকার পাপাচার বর্জন করা যেমন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব একই সাথে সাধ্যমত নফল রোযা রাখাও উচিত। যদি কারো পক্ষে পুরো মাস রোযা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে তিনি এ মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখতে পারেন। কারণ নবীজী সা. প্রতি চান্দ্র মাসের এই তিনদিন নিয়মিতই রোযা রাখতেন। এ ছাড়া এ মাসের অন্যতম একটি আমল হলো আশুরার দিনের রোযা।

আশুরা
মুহাররম মাসের দশম তারিখকে বলে আশুরা। এদিনটি মুসলিমদের কাছে নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব থেকে বড় বিষয় হলো মহান আল্লাহ মিশরের অত্যাচারী রাজা ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে এদিনে পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে মেরেছিলেন। আর নবী মুসা আ. ও তাঁর অনুসারী বনী ইসরাইলকে রক্ষা করেছিলেন নিমর্ম নির্যাতনের হাত থেকে। মহান আল্লাহ এ কাজটি করেছেন তাঁর বিশেষ কুদরতে। তিনি বনী ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন। (সহীহ বুখারী ১/৪৮১)

এদিনেই নবীজী সা. এর প্রিয় নাতি হুসাইন রা. শাহাদত বরণ করেছিলেন কারবালা প্রান্তরে। তবে হুসাইন রা. এর শাহাদাতের কারণে এ দিনের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে বিষয়টি এমন নয়। এ দিনের মর্যাদা আল্লাহ আরো বহু আগেই নির্ধারণ করেছেন আর হুসাইন রা. এর শাহাদত আকষ্মিকভাবে এদিনে সংঘটিত হয়েছে।

এ দিনের অন্যতম একটি আমল হলো রোযা রাখা। মুহাররম মাসের রোযার মধ্যে আশুরার রোযার ফযিলত আরও বেশি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’(সহীহ বুখারী ১/২১৮)

হযরত আলী রা.কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭

অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮)

আশুরার রোযা সম্পর্কে অন্য আরেক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’(সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯)

আমরা এসকল হাদীসের আলোকে আশুরার রোযার গুরুত্ব ও ফযিলত অবগত হলাম। আর এটাও জানলাম যে, আশুরার দিনের সাথে সাথে আগের দিনে অথবা পরের দিন আরো একটি রোযা রাখতে হবে।

নানা কুসংস্কার
মুহাররমের দশম তারিখের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। (আল আসারুল মারফ‚আ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭)

আশুরার দিনে হুসাইন রা.এর শাহাদতকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ইসলামবিরোধী কর্মকাÐ সমাজে প্রচলিত আছে। এটা অবশ্যই ঠিক যে, মুসলিমদের জন্য এ শোকের বোঝা অনেক ভারী। উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রæসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’

অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’

অতএব হুসাইন রা. এর শাহাদতকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাÐে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।

এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‌্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়।

এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার।

মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা-ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যতœবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন- সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।

লেখক: মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here