সবুজদেশ ডেক্সঃ ১৭ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে চারটা। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে পাঁচ তারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় বিকট শব্দে ছিটকে পড়েন মোটরসাইকেলসহ দুই আরোহী। র‌্যাব-১ এর সদস্যরা তাদের গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চালক লাফিজুর রহমান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাত্রীবাহী বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মোটরসাইকেলটি। গত দুই মাসে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৫ ব্যক্তির সাতজনই ছিলেন এরকম মোটরসাইকেলের আরোহী। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় প্রাণে  বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ববরণ করে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন অনেকে। ওয়াকিবহালরা বলছেন, রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন  মোটরসাইকেল চালকরা। ফলে প্রায়ই ঘটছে ভয়ঙ্কর সব দুর্ঘটনা। ২০১৭ সালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার ২৭ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। জানা গেছে, ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানি অ্যাপভিত্তিক  মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং সেবা শুরু করার পর থেকেই মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে ঢাকায় উবার, পাঠাও, ওভাই, স্যাম, চলো, ইজিয়ার, আমার বাইক, সহজ রাইডার্স, বাহন, আমার রাইড, ঢাকা রাইডার্স, ঢাকা মটোসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের সুবিধা দিচ্ছে। আর যানজট এড়াতে অনেক মোটরবাইক চালকই ফুটপাথের ওপর দিয়ে বাইক উঠিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে দুর্ঘটনাই ঘটছে না, পথচারীরাও পড়ছেন খুব অস্বস্তিতে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর অনেক সড়কে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পয়েন্টেই আরোহীরা ট্রাফিক সিগন্যাল না মেনে ফাঁকফোকর দিয়ে চলছেন। ফুটপাথ দিয়ে বাইক চালিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। অবশ্য দুজনের বেশি আরোহী না নেওয়া ও চালক-আরোহী উভয়কে হেলমেট ব্যবহারের নিয়ম মান্য করা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, রাজধানীতে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক তরুণ মোটরসাইকেলে ঝুঁকছেন। রাজধানীর পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফুট, আগারগাঁও সংলগ্ন ৬০ ফুট, মিরপুর ডিওএইচএস থেকে বিমানবন্দরমুখী সড়কে এসব তরুণের বিকট শব্দে মোটরবাইক চালানো দেখে অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত। বিশেষ করে এসব তরুণের স্ট্যান্টবাজিতে প্রায়ই ঘটছে ভয়ঙ্কর সব দুর্ঘটনা। তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর বদৌলতে ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল ঢাকার যানবাহন ব্যবস্থাপনাকে বিশৃঙ্খল করে তুলছে। তাই ঢাকার মতো একটি শহরে কতগুলো মোটরসাইকেল চলতে পারে— এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা উচিত বিআরটিএর। বিআরটিএর হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে শুধু রাজধানীতে দৈনিক গড়ে ২৭২টি নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন পেয়েছে। এভাবে  মোটরসাইকেল নিবন্ধন বৃদ্ধির কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকির পাশাপাশি রাস্তায় বিশৃঙ্খলাও বেড়েছে। নিসচা সারা দেশে ২২ লাখের হিসাব দিলেও বিআরটিএর পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে নিবন্ধিত  মোটরসাইকেল রয়েছে ২৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই চলাচল করছে প্রায় ৫ লাখ ৭৮ হাজার  মোটরসাইকেল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নিবন্ধন পেয়েছে ৬৫ হাজার ৩৩২টি। গড় হিসাবে এ সময়ে ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ২৭২টি করে নতুন  মোটরসাইকেল নেমেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, রাস্তা ফাঁকা থাকলে চালকদের মনোজগতে পরিবর্তন আসে। তরুণরা এ সময় অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারা তখন বিভিন্ন রাস্তায় রেস করে। তাদের মনোজগতে নানা ধরনের উদ্দীপনা কাজ করে। গাড়ি চালানোর সময় নিজেদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ কারণেই  মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) মফিজ উদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাইড শেয়ারিংয়ের কারণে অন্য সময়ের তুলনায়  মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। বেড়েছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও। তবে সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখতে আমাদের অভিযানও অব্যাহত আছে। বেড়েছে মামলার সংখ্যাও। এক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা বিআরটিএর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।  নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, গত দুই মাসে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) ঢাকায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন। এর সাতজনই মোটরসাইকেল আরোহী। ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছেন, তার ২৭ শতাংশের সঙ্গেই যুক্ত  মোটরসাইকেল। তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৬২৬টি। একইভাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুর্ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ২ হাজার ৩১৬ ও ৩ হাজার ৩৪৯টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৬৭২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে  মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাত লাখ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২২ লাখ। মোটরসাইকেলচালকদের একটা বড় অংশ কিশোর। তাদের বেপরোয়া ভূমিকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) নুরুল ইসলাম বলেন, মোটরসাইকেল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। যারাই আসছে, আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যাচাই করে তাদের নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল নিবন্ধন বিআরটিএর রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, উপায় না পেয়েই হয়তো মানুষ মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছে। তবে এটা কোনো সমাধান নয়। এতে করে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনিরাপদ হয়ে উঠছে মোটরসাইকেলগুলো। একটি শহরে কতগুলো মোটরসাইকেল চলার অনুমতি দেওয়া উচিত— এ বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত দ্রুততর সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা, যাতে করে মানুষ মোটরবাইকের দিকে ধাবিত না হয়। একইসঙ্গে লেন বাস্তবায়নের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে  মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চলাচল ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here