ঢাকা ০৮:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে কারণে কমলার হার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

কমলা হ্যারিস। ছবি : সংগৃহীত

 

দাপুটে জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ফিরলেন ডোনার্ড ট্রাম্প। ডেমোক্রেফট প্রার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হাওয়াইট হাউসে যাচ্ছেন রিপাবলিকন এই প্রার্থী। যদিও বেশিরভাগ জরিপেই এগিয়ে ছিলেন কমলা। কিন্তু ভোটাররা শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখলেন ট্রাম্পেই। সেই সঙ্গে ডেমোক্রেটদের পেছনে ফেলে আমেরিকার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সেনেট এবং নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস’-এও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল রিপাবলিকানরাঅ দল।

মার্জিন নির্বাচনের এবারের বেশিরভাগ জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন কমলা হ্যারিস। এমন কি জো বইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে যখন কমলার প্রার্থিকা নিশ্চিত হয়, তখন অনেকেই তার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে কম সময়ে বেশি পরিমাণ তহবিল সংগ্রহেরও রেকর্ড গড়েন কমলা।

কিন্তু যাবতীয় জনমত সমীক্ষাকে তুড়ি মেরে বাজিমাত করল ট্রাম্পের ‘পপুলিজমে’র রাজনীতি। কোন অংকে এল এই সাফল্য। এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এর মধ্যে উঠে এসেছে তিনটি ফ্যাক্টর বা ট্রাম্প কার্ড—মূল্যবৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা এবং পশ্চিম এশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থীর দৃঢ় অবস্থান। কমলার মূল লক্ষ্য ছিল, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনো, আফ্রিকান-আমেরিকান, নারী, কলেজ শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ যুবসমাজ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের সমর্থন পাওয়া। কিন্তু শেষ চারটি ক্ষেত্রেই কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। আট মাস ধরে ২০টি সাক্ষাৎকার এবং ধারাবাহিক প্রচারে ভর করে বাজিমাত করলেন ট্রাম্প।

মূল্যবৃদ্ধি

মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত আমেরিকায় এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থনীতি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রামীণ ভোটারদের বড় অংশ চিরাচরিত ভাবে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। কিন্তু শহরের শ্রমিক-কর্মচারী শ্রেণি সাধারণ ভাবে ডেমোক্রেট প্রার্থীদেরই ভোট দিতেন। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত অনেক ডেমোক্রেট ভোটার ট্রাম্পকে অপচ্ছন্দ করলেও এবার শেষ মুহূর্তে তার প্রতি আস্থা রেখেছেন। অনেকে আবার বুথমুখো হননি। যা কিছু ‘দোদুল্যমান’ প্রদেশে এ বার ট্রাম্পকে জিতিয়েছে।

আমেরিকায় মূল্যবদ্ধি, আর্থিক মন্দা এবং উৎপাদন শিল্পের অধোগতিকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প তরুণদের মনে আউটসোর্সিং, ছাঁটাইয়ের ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বার বার ভোটদাতাদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন— বাইডেনের আমলে কি আপনারা ভাল আছেন?

কাজ হারানোর ফলে বা হারানোর আশঙ্কায় শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে। সামগ্রিক ভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে সাড়া জাগিয়েছে তার আবেদন। এমনকি, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনো আর কৃষ্ণাঙ্গ প্রভাবিত পেনসিলভেনিয়াতেও।

অভিবাসন সমস্যা

আমেরিকায় এবারের নির্বাচনে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি অভিবাসন সমস্যা নিয়ে প্রচার বড়সড় প্রভাব ফেলেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন। বিশেষত, ‘রাস্ট বেল্ট’ হিসেবে পরিচিত প্রদেশগুলিতে ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করছে ডেমোক্রেটদের চিরাচরিত শ্রমিক-কর্মচারী ভোটব্যাংকে ফাটল ধরাতে পেরেছেন ট্রাম্প। প্রচারের তিনি বার বার বলেছেন, ভোটে জিতলে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেবেন। সুরক্ষিত করবেন কলকারখানা, দপ্তরের কর্মীশ্রেণির আমেরিকানদের আর্থিক নিরাপত্তা। ফল বলছে, সেই প্রচার প্রভাব ফেলেছে ভোটে।

ভোটের আগে প্রকাশিত একটি জনমত সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অভিবাসনের বিষয়টিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ভোটারদের সংখ্যা ৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৫ বছরে এই সংখ্যা সব থেকে বেশি বেড়েছে ’২১ থেকে ’২৪-এর মধ্যে বাইডেনের জমনায়—প্রায় ৫.৪ শতাংশ। বর্তমানে আমেরিকায় চার কোটি ৭৮ লাখ অভিবাসী বসবাস করেন। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ এমনকি, কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক-কর্মচারীদের অনেকে মনে করেছেন তাদের রোজগারের নিশ্চয়তায় আঘাত হানছেন অভিবাসীরা। কমলা অভিবাসন নিয়ে কড়া অবস্থান ঘোষণা না করায় ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন তারা।

২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে মেক্সিকো-আমেরিকা সীমান্তে প্রাচীর তোলা, বহু অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো, সীমান্তে পরিবারগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বাচ্চাদের পরিবারের থেকে আলাদা করা—এমন নানা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে যখন বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন, তার নীতি হয় সীমান্তে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে মানবিকতা বজায় রেখে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যেখানে মেক্সিকো সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিন লাখে পৌঁছায়। সীমান্ত শহরগুলিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সেই পরিস্থিতিতে টেক্সাস, ফ্লরিডার মতো প্রদেশগুলির গভর্নরেরা বাস ভর্তি করে বহু অবৈধ অভিবাসীকে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলসের মতো এলাকায় পাঠিয়েছিলেন। সে সময় প্রকাশিত একটি জনমত সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, আমেরিকার ৩৫ শতাংশ ভোটার জোরালো ভাবে মনে করেন যে, পরিচয়পত্রহীন শরণার্থীদের সংখ্যা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করল সেই সমীক্ষায় ভুল ছিল না।

ইসরায়েল, ইউক্রেন এবং অন্যান্য

সেপ্টেম্বরের গোড়ায় পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের রাজধানী ফিলাডেলফিয়ায় আয়োজিত মুখোমুখি বিতর্কে (প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট) ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, নির্বাচিত হয়ে পশ্চিম এশিয়ায় অশান্তি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবেন তিনি। সেই সঙ্গে তার তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছিল—“আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেব।”

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে ভলোদিমির জেলেনস্কির বাহিনীকে ধারাবাহিকভাবে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বাইডেন সরকার। অন্য দিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর শুরু হয়েছে ধারাবাহিক অশান্তি। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে। যার জেরে তিন দফায় উপসাগরীয় অঞ্চলে বাড়তি সেনা পাঠাতে হয়েছে পেন্টাগনকে। তার অভিঘাত এসেছে আমেরিকার করদাতাদের পকেটে।

এই পরিস্থিতিতে একাংশ বিশ্বাস করেছেন, স্বভাবে বেপরোয়া ট্রাম্প ইসরায়েল এবং ইউক্রেন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের পুরনো সমীকরণও মাথায় রেখেছেন ভোটদাতাদের অনেকে। ভরসা করেছেন তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ স্লোগানে। পাশাপাশি, ইসলামিক মৌলবাদে ভীত জনতার একাংশ ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্যে নীরবে সমর্থন জুগিয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বাইডেন সরকারের ইসরায়েল নীতিতে ক্ষুব্ধ আরবীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের একটি অংশ এবার ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। যারা চিরাচরিত ভাবে ডেমোক্রেট সমর্থক বলেই পরিচিত।

সবুজদেশ/এসইউ

About Author Information
আপডেট সময় : ০৩:৫১:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০২৪
৩২ Time View

যে কারণে কমলার হার

আপডেট সময় : ০৩:৫১:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০২৪

 

দাপুটে জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ফিরলেন ডোনার্ড ট্রাম্প। ডেমোক্রেফট প্রার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হাওয়াইট হাউসে যাচ্ছেন রিপাবলিকন এই প্রার্থী। যদিও বেশিরভাগ জরিপেই এগিয়ে ছিলেন কমলা। কিন্তু ভোটাররা শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখলেন ট্রাম্পেই। সেই সঙ্গে ডেমোক্রেটদের পেছনে ফেলে আমেরিকার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সেনেট এবং নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস’-এও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল রিপাবলিকানরাঅ দল।

মার্জিন নির্বাচনের এবারের বেশিরভাগ জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন কমলা হ্যারিস। এমন কি জো বইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে যখন কমলার প্রার্থিকা নিশ্চিত হয়, তখন অনেকেই তার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে কম সময়ে বেশি পরিমাণ তহবিল সংগ্রহেরও রেকর্ড গড়েন কমলা।

কিন্তু যাবতীয় জনমত সমীক্ষাকে তুড়ি মেরে বাজিমাত করল ট্রাম্পের ‘পপুলিজমে’র রাজনীতি। কোন অংকে এল এই সাফল্য। এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এর মধ্যে উঠে এসেছে তিনটি ফ্যাক্টর বা ট্রাম্প কার্ড—মূল্যবৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা এবং পশ্চিম এশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থীর দৃঢ় অবস্থান। কমলার মূল লক্ষ্য ছিল, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনো, আফ্রিকান-আমেরিকান, নারী, কলেজ শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ যুবসমাজ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের সমর্থন পাওয়া। কিন্তু শেষ চারটি ক্ষেত্রেই কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। আট মাস ধরে ২০টি সাক্ষাৎকার এবং ধারাবাহিক প্রচারে ভর করে বাজিমাত করলেন ট্রাম্প।

মূল্যবৃদ্ধি

মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত আমেরিকায় এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থনীতি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রামীণ ভোটারদের বড় অংশ চিরাচরিত ভাবে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। কিন্তু শহরের শ্রমিক-কর্মচারী শ্রেণি সাধারণ ভাবে ডেমোক্রেট প্রার্থীদেরই ভোট দিতেন। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত অনেক ডেমোক্রেট ভোটার ট্রাম্পকে অপচ্ছন্দ করলেও এবার শেষ মুহূর্তে তার প্রতি আস্থা রেখেছেন। অনেকে আবার বুথমুখো হননি। যা কিছু ‘দোদুল্যমান’ প্রদেশে এ বার ট্রাম্পকে জিতিয়েছে।

আমেরিকায় মূল্যবদ্ধি, আর্থিক মন্দা এবং উৎপাদন শিল্পের অধোগতিকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প তরুণদের মনে আউটসোর্সিং, ছাঁটাইয়ের ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বার বার ভোটদাতাদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন— বাইডেনের আমলে কি আপনারা ভাল আছেন?

কাজ হারানোর ফলে বা হারানোর আশঙ্কায় শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে। সামগ্রিক ভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে সাড়া জাগিয়েছে তার আবেদন। এমনকি, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনো আর কৃষ্ণাঙ্গ প্রভাবিত পেনসিলভেনিয়াতেও।

অভিবাসন সমস্যা

আমেরিকায় এবারের নির্বাচনে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি অভিবাসন সমস্যা নিয়ে প্রচার বড়সড় প্রভাব ফেলেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন। বিশেষত, ‘রাস্ট বেল্ট’ হিসেবে পরিচিত প্রদেশগুলিতে ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করছে ডেমোক্রেটদের চিরাচরিত শ্রমিক-কর্মচারী ভোটব্যাংকে ফাটল ধরাতে পেরেছেন ট্রাম্প। প্রচারের তিনি বার বার বলেছেন, ভোটে জিতলে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেবেন। সুরক্ষিত করবেন কলকারখানা, দপ্তরের কর্মীশ্রেণির আমেরিকানদের আর্থিক নিরাপত্তা। ফল বলছে, সেই প্রচার প্রভাব ফেলেছে ভোটে।

ভোটের আগে প্রকাশিত একটি জনমত সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অভিবাসনের বিষয়টিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ভোটারদের সংখ্যা ৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৫ বছরে এই সংখ্যা সব থেকে বেশি বেড়েছে ’২১ থেকে ’২৪-এর মধ্যে বাইডেনের জমনায়—প্রায় ৫.৪ শতাংশ। বর্তমানে আমেরিকায় চার কোটি ৭৮ লাখ অভিবাসী বসবাস করেন। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ এমনকি, কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক-কর্মচারীদের অনেকে মনে করেছেন তাদের রোজগারের নিশ্চয়তায় আঘাত হানছেন অভিবাসীরা। কমলা অভিবাসন নিয়ে কড়া অবস্থান ঘোষণা না করায় ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন তারা।

২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে মেক্সিকো-আমেরিকা সীমান্তে প্রাচীর তোলা, বহু অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো, সীমান্তে পরিবারগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বাচ্চাদের পরিবারের থেকে আলাদা করা—এমন নানা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে যখন বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন, তার নীতি হয় সীমান্তে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে মানবিকতা বজায় রেখে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যেখানে মেক্সিকো সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিন লাখে পৌঁছায়। সীমান্ত শহরগুলিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সেই পরিস্থিতিতে টেক্সাস, ফ্লরিডার মতো প্রদেশগুলির গভর্নরেরা বাস ভর্তি করে বহু অবৈধ অভিবাসীকে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলসের মতো এলাকায় পাঠিয়েছিলেন। সে সময় প্রকাশিত একটি জনমত সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, আমেরিকার ৩৫ শতাংশ ভোটার জোরালো ভাবে মনে করেন যে, পরিচয়পত্রহীন শরণার্থীদের সংখ্যা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করল সেই সমীক্ষায় ভুল ছিল না।

ইসরায়েল, ইউক্রেন এবং অন্যান্য

সেপ্টেম্বরের গোড়ায় পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের রাজধানী ফিলাডেলফিয়ায় আয়োজিত মুখোমুখি বিতর্কে (প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট) ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, নির্বাচিত হয়ে পশ্চিম এশিয়ায় অশান্তি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবেন তিনি। সেই সঙ্গে তার তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছিল—“আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেব।”

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে ভলোদিমির জেলেনস্কির বাহিনীকে ধারাবাহিকভাবে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বাইডেন সরকার। অন্য দিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর শুরু হয়েছে ধারাবাহিক অশান্তি। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে। যার জেরে তিন দফায় উপসাগরীয় অঞ্চলে বাড়তি সেনা পাঠাতে হয়েছে পেন্টাগনকে। তার অভিঘাত এসেছে আমেরিকার করদাতাদের পকেটে।

এই পরিস্থিতিতে একাংশ বিশ্বাস করেছেন, স্বভাবে বেপরোয়া ট্রাম্প ইসরায়েল এবং ইউক্রেন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের পুরনো সমীকরণও মাথায় রেখেছেন ভোটদাতাদের অনেকে। ভরসা করেছেন তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ স্লোগানে। পাশাপাশি, ইসলামিক মৌলবাদে ভীত জনতার একাংশ ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্যে নীরবে সমর্থন জুগিয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বাইডেন সরকারের ইসরায়েল নীতিতে ক্ষুব্ধ আরবীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের একটি অংশ এবার ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। যারা চিরাচরিত ভাবে ডেমোক্রেট সমর্থক বলেই পরিচিত।

সবুজদেশ/এসইউ