ঢাকাঃ

বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পিটুনিতে নিহত ছাত্র আবরার ফাহাদকে নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে বৃহস্পতিবার একটি বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তার ওই স্ট্যাটাসে আপত্তি তুলে পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট ড. আসিফ নজরুল।

তিনি (আসিফ নজরুল) লিখেছেন, ‘তসলিমা নাসরিনের শিবলিঙ্গ পুজোয় সমস্যা নাই, সমস্যা আছে আবরারের নামাজ পড়া নিয়ে।

এই বিকারগ্রস্থ নারীকে নিয়ে কখনো লিখিনি আমি। কিন্তু তার এ কথার উল্লেখ প্রয়োজন হলো এটা বলতে যে বাংলাদেশের বহু ছদ্মবেশী সেক্যুলারের আসল চেহারা তসলিমার মতো। কেউ আল্লাহ লিখলে তাদের সমস্যা হয়, ভগবান বা ঈম্বর লিখলে ঠিক আছে। আরও কতো কিছু! অথচ সেক্যুলার (অসাম্প্রদায়িকতা অর্থে) মানে হচ্ছে সব ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল থাকা অথবা কোনো ধর্ম সম্পর্কেই বিরূপ মন্তব্য না করা। যারা একচোখা হয়ে শুধু একটা ধর্মে সমস্যা খোঁজে, তারা সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক ও মানবতার শত্রু।’

এর আগে আবরারকে নিয়ে তসলিমা নাসরিনের সেই বিতর্কিত ফেসবুক স্ট্যাটাস-

‘আরবার ফাহাদের গুণের বর্ণনা করতে গিয়ে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া পড়শি, চেনা পরিচিত সবাই বলছেন আরবাব মেধাবী ছিল এবং আরবাব ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। মেধাবী হওয়াটা নিশ্চয়ই গুণ কিন্তু ২১ বছর বয়সে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়াটা তো গুণ নয়, বরং দোষ। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই!

সাত আকাশের ওপর এক সর্বশক্তিমান বসে আছে, সে ছ’দিনে আসমান জমিন বানিয়েছে, আদম হাওয়াকেও মাটি দিয়ে বানিয়েছে, কথা শোনেনি বলে জমিনে ফেলে দিয়েছে, কেউ একজন ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে তাকে এবং তার বানানো স্বর্গ নরক দেখে এসেছে — এসব আজগুবি অবিজ্ঞান আর হাস্যকর গাল গপ্প কোনও বুদ্ধিমান কেউ বিশ্বাস করতে পারে?

আবরার পড়তো হয়তো বিজ্ঞানের বই, পরীক্ষা পাশের জন্য পড়তো। তার বিজ্ঞান মনস্কতা ছিল না। নিজস্ব চিন্তার শক্তি ছিল না। একে আমি পড়ুয়া বলতে পারি, মেধাবী বলবো না। আরবাব ছিল নিব্রাস ইসলামদের মতো। একবিংশ শতাব্দির আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, কিন্তু মাথায় চোদ্দশ’ বছর আগের অবিজ্ঞান আর অনাধুনিকতা।

আবরার অফিসিয়ালি শিবির না করলেও শিবিরের মতো চাল চলন আর চিন্তা ভাবনা ছিল। তাতে কী! শিবিরদেরও বাঁচার অধিকার আছে। তাকে যারা পিটিয়েছিল, আমার বিশ্বাস, মেরে ফেলার উদ্দেশে পেটায়নি। কিন্তু মাথায় আঘাত লেগেছে, মরে গেছে। যারা পিটিয়েছিল, তাদের শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। এর মধ্যেই কয়েকটাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আমি সমালোচনা করেছি তাদের, যারা আরবাবের গুণকীর্তন গাইতে গিয়ে বলছেন যে আবরার ধার্মিক ছিল, পাঁচ বেলা নামাজ পড়তো। মাদ্রাসার ছাত্রের বেলায় যেটি গুণ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের বেলায়ও সেটি গুণ? আমার পোস্টটি মূলত গুণ নিয়ে। খুব বেশি দিন আগে নয়, গুলশান ক্যাফের সন্ত্রাসীদের বেলায় একই রকম গুণ গাওয়া হয়েছিল। খুব মেধাবী ছাত্র, পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে। আইসিসে (আইএস) যোগ দেয়া সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে তারাও পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে।

এতো দেখার পর অল্প বয়সী ছেলেদের পাঁচ বেলা নামাজ পড়াকে এত প্রশংসা করা হয় কেন? সে পরীক্ষায় ভালো ফল পেত, এটিই কি গুণ নয়? গুণী এবং নির্গুণ সবারই বাঁচার অধিকার সমান। ভালো ফল পেত বলে, বা জানিনা ৫ বেলা নামাজ পড়তো বলেই কিনা, তার জন্য চোখের জল একটু বেশিই ফেলছে মানুষ।

ঠিক যেমন সুন্দরী একটি মেয়ে আহত হলে তার জন্য মানুষের আবেগ উথলে ওঠে, অসুন্দরী মেয়ে আহত হলে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। আমার নাকি ভক্ত তারা, আমার লেখা নাকি ছোটকাল থেকে পড়ে আসছেন। এতো পড়ছেন, কিন্তু আমাকে বিন্দুমাত্র জানেন না, বোঝেন না। আমার আজকের একটি লেখা পড়ে তাদের মনে হলো আমি খুনকে সমর্থন করছি। যদিও খুনের বিচার আমি চেয়েছি, তার পরও মনে হলো।

যেহেতু আমি লিখেছি খুন করার উদ্দেশে, আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আরবাব নামের ছাত্রটিকে পেটায়নি — এই মত নাকি খুনকে সমর্থন করে। না এই মত খুনকে মোটেও সমর্থন করে না। আজ যদি ভাড়া করা খুনি দ্বারা আরবাবকে মারা হতো, তাহলে নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য খুনের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশ বছর বয়সী ছাত্ররা কোনো এক ফেসবুক পোস্টের জন্য তাদের এক সহপাঠীকে পিটিয়েছে। খুন করলে তাদের ছাত্রজীবনের অবসান হবে, তাদের বাকি জীবন জেলে পচতে হবে, এটা এতগুলো ছেলের একজনও জানে নি? খুনের উদ্দেশ্য না থাকলেও যেহেতু পিটিয়েছে, যেহেতু খুন ঘটেছে, সেহেতু শাস্তি হওয়া জরুরি। এ কথাটা স্পষ্ট করে আমি লিখলেও আমার বিরুদ্ধে কুৎসিত গালি গালাজ বন্ধ হচ্ছে না।

একজন তো নাকি আমার বহুকালের ফ্যান, তিনি বললেন, আমি নাকি কাউকে তেল দেয়ার উদ্দেশে লেখাটা লিখেছি, বোঝাতে চাইছেন, আমি হাসিনাকে তেল দিচ্ছি, দেশে ফেরার জন্য। হায় মনুষ্য মস্তিস্ক! ধিক এইসব ফ্যানদের। এরা আমার বন্ধু তালিকা থেকে বিদেয় হলেই বাঁচি। আরেকজন বললেন, আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আমার মাথার ঠিক নেই, তাই আমি এইসব লিখছি। এরা আমার বন্ধু তালিকায় ছিলেন। বন্ধু নামের কলংক। যারা বন্ধু তালিকায় নেই, তারা, মানে নারীবিদ্বেষী মোল্লা মুন্সি শেয়ার করছেন আমার লেখা, আর পতিতা বলে মনের সুখে গালি দিয়ে যাচ্ছেন। এই হচ্ছে বাংলাদেশি আবেগ। যখন উথলে ওঠে, সুনামি লেগে যায়। চিন্তাশক্তি বিচারশক্তি সব লোপ পায়।’

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here