সড়ক পরিবহন আইনটিকে হালনাগাদ করার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘকাল ধরে অনুভূত হচ্ছিল। দুই শিক্ষার্থীর অপঘাতে মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে জেগে ওঠা অভাবনীয় ছাত্র আন্দোলনের কারণেই সরকার হিমঘরে থাকা আইনটির খসড়া সোমবার মন্ত্রিসভায় তুলেছে। এই আইন মূলত চালকদের অনিয়ম ও এর শাস্তির বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই করা হয়েছে। কিন্তু পরিবহন খাতের সমস্যা শুধু এখানেই নয়। ফলে এই আইন কতটুকু ফল দেবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে দীর্ঘ অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত বাংলায় তৈরি প্রথম একটি পরিবহন আইন হতে যাচ্ছে, তাকে একটা অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে।

তবে এটি যে নির্বাহী বিভাগের একটি প্রস্তাবমাত্র, তা যেন সরকারের সরব মহলগুলো অংশীজনদের মনে করিয়ে দেয়। সংসদীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আইনটির আরও উন্নতি সাধন করা সম্ভব। তবে এই খাতে অবকাঠামো ও জনশক্তি বাড়ানোর মতো কতগুলো বিষয় আছে, এসবের দিকে উদাসীন থেকে আইন কার্যকর করতে চাইলেও তা তেমন সুফল দেবে না। যেমন প্রায় ৩৬ লাখ মোটরযানের ফিটনেস দেখতে সরকার বছরে গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নেওয়ার বিপরীতে অনধিক ১০ কোটি টাকা খরচসাপেক্ষ একটি পরিদর্শন (৩৬ হাজার গাড়িপ্রতি একজন পরিদর্শক) ব্যবস্থা চলমান রেখেছে। সরকারকে এই মানসিকতা আমূল পাল্টাতে হবে।

প্রস্তাবিত আইনের বড় দুর্বলতা এটি চালকসহ পরিবহনশ্রমিক এবং যাত্রীসাধারণের বৈধ স্বার্থ রক্ষায় খুব সতর্ক বা সংবেদনশীল থাকেনি। বরং অনেক বেশি পরিবহনমালিক ও সড়ক পরিবহনসংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার প্রবণতা বেশি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে তহবিল গঠন ও ট্রাস্ট গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সরকারের নিয়োগ করা চেয়ারম্যানসহ অর্ধ ডজন যুগ্ম সচিবনির্ভর কোনো ট্রাস্টি বোর্ড কীভাবে ‘স্বশাসিত’ হতে পারে, তা বোধগম্য নয়।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো পরিবহনচালকই রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটাতে চাইবেন না। কিন্তু বাস্তবে সড়কে অনুকূল অবস্থা বিরাজ না করা, গাড়িগুলোর ফিটনেস না থাকা এবং সর্বোপরি নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টার পরিবর্তে মালিকেরা তাঁদের চাপ দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার কারণে চালক ও তাঁর সহকারীরা সব সময় একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে থাকেন। এখন নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলনের মুখে বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানো থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত বা নিহত হলে তিন বছরের কারাদণ্ড বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। পরিহাস হলো, জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসনামলে শ্রমিকনেতাদের চাপে এ ক্ষেত্রে সাত বছরের কারাদণ্ড কমিয়ে তিন বছর করেছিলেন। এক-এগারোর সরকারের আমলে গঠিত সরকারি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আমরা আর সাত বছরের বিধান ফেরাতেই পারলাম না। এখন আবার উল্টো সরকার দুই বছর বাড়িয়ে তাতে ‘সাফল্য’ দাবি করছে। অথচ প্রতিবেশী ও উন্নত দেশে এখানে ১০ থেকে ১৪ বছরের জেলের বিধান আছে। আবার এসব সত্ত্বেও বড় সত্যি হলো, তিন বছরের সাজা বাস্তবে কেউ খেটেছেন, এ রকম নজির একেবারেই বিরল।

বিদ্যমান আইনে সপ্তাহে অনধিক ৪৮ ঘণ্টা কাজ করানোর বিধান আছে। বাস্তবে এর চরম লঙ্ঘন ঘটছে। কারণ, মালিকেরা নানা কূটকৌশলে শ্রমিকদের মাত্রাতিরিক্ত খাটাতে বাধ্য করছেন, যা সড়ককে দুর্ঘটনাপ্রবণ করার অন্যতম মুখ্য কারণ। অথচ এই বিধান বিলোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকার এটা প্রজ্ঞাপন দিয়ে ঠিক করবে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।

সড়কে যে নৈরাজ্য চলছে, সেটা অবশ্যই প্রধানত আইনের ঘাটতি থাকার কারণে নয়। তাই আইন পাসের চেয়ে সরকার আইন বাস্তবায়নে কতটা বিশ্বস্ততা দেখাতে পারে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here