সৈয়দ আশরাফ অভিমান ভুলে ফিরে আসুন ভোট উৎসবে
সবুজদেশ ডেক্সঃ প্রিয় মানুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের শরীরটা ভালো নেই। ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। জানি না এবারকার ভোট তিনি করতে পারবেন কিনা। ডাক্তাররা বলছেন, ভোট করার মতো শরীরের অবস্থা নেই তার। যেতেও পারবেন না নির্বাচনী এলাকায়। থাকতে হবে হাসপাতালে কত সময় কেউ জানেন না। বিশ্বাস করতে পারছি না। একজন প্রাণবন্ত মানুষের ঠিকানা দীর্ঘ সময়ের জন্য কেন হাসপাতাল হবে? পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি আশরাফ ভাইকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য। আশা করছি, তিনি আবারও আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। কথা বলবেন আবার আগের মতো। দেখা হবে রাতের আড্ডার আসরে। কথা হবে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। স্পষ্টবাদী সাদামাটা উদার মনের মানুষটির মাঝে আমি কোনো লোভ দেখিনি। জাগতিক চাওয়া-পাওয়া তাকে টানত না। অর্থবিত্তের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। এ কারণেই বুকের মাঝে সাহস ছিল। আর আদর্শিক অঙ্গীকার ছিল শেখ হাসিনার প্রতি। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল। অনেকের দাবি ছিল, তিনি যেন কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হন। সৈয়দ আশরাফ হননি। এ নিয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি বললেন, হাউস আমার পক্ষে ছিল। কিন্তু আমি শেখ হাসিনার পক্ষে। নেত্রী যেভাবে চাইবেন তা হবে। সৈয়দ আশরাফের পাশে ছিলেন মাহবুবুল হক শাকিল। কাউন্সিলের পরের দিন দুজনের সঙ্গে ঢাকা ক্লাবে দেখা। শাকিল আমাকে আরও কিছু বললেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় নরসিংদীর রাজিউদ্দিন রাজু ভাইর সঙ্গে ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত দুপুরের খাবারের সময় আমিও থাকতাম। আশরাফ ভাই আসতেন মাঝে মাঝে। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন তাজের বাসায় রাতে দেখা হতো আশরাফ ভাইর সঙ্গে। তিনি জানতেন ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ভালো সম্পর্ক। কিন্তু কোনো দিন এই হালকা বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাননি। মানুষকে আপন করতে জানতেন। তাজ ভাইর বাসায় এক রাতে আড্ডা আর শেষ হচ্ছে না। রাত ১টার দিকে আমি বিদায় নিতে গেলাম। আশরাফ ভাই বললেন, এখন যাবেন না। আরেকটু থাকেন। বাসায় ভাবীকে আমার কথা বলুন। ফরিদা ইয়াসমিনকে ফোন করলাম। বললাম, তাজ ভাইর বাসায় আছি। আশরাফ ভাই বলছেন, আরেকটু থাকতে। সেই থাকাটা ছিল ভোর রাত পর্যন্ত। আশরাফ ভাই তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার মাঝে কোনো অহমিকা দেখিনি। সব সময় মানুষের প্রতি দরদ দেখেছি। সুস্থধারার রাজনৈতিক চিন্তা দেখেছি। উন্নত দেশের চিন্তা দেখেছি। জাতির জনকের আদর্শকে লালন করে শেখ হাসিনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখেছি। কৃত্রিমতা ছিল না। তাজ ভাইর বাসায় ২০১৩ সালে একদিন তিনি আমাকে বললেন, সামনে ভোট। আওয়ামী লীগের পক্ষে আরও বেশি করে কাজ করতে হবে। অতি আবেগে আমি বললাম, আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি। শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে আছি। কিন্তু বিতর্কিত চোরদের পক্ষে থাকব না। তাদের বিরুদ্ধে বলব, লিখব। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর শেখ হাসিনার স্নেহের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। আশরাফ ভাই বললেন, আমার মনের কথা বলছেন। এই কারণে আপনাকে ভালো জানি। অবশ্যই যারা খারাপ কাজ করবে তাদের বিপক্ষে থাকবেন। একজন পেশাদার হিসেবে আপনাদের তাই থাকা উচিত। আরেকবার চ্যানেল আইতে আমি আশরাফ ভাইয়ের সমালোচনা করলাম মন্ত্রণালয়ে না যাওয়া নিয়ে। বাংলাদেশ প্রতিদিনেও লিড নিউজ করলাম। এর কিছুদিন পরই তাজ ভাইর বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা। আমি ভাবলাম, তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। অভিমান থাকাটাই স্বাভাবিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী। কিন্তু না আমার ধারণাকে বদলে দিলেন তিনি। কাছে টেনে কথা বললেন। গল্প করলেন। এটাই সৈয়দ আশরাফ। গত কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে বেশ কিছু সংবাদ প্রকাশ হয়। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছুটে এলেন তিনি। জড়িয়ে ধরে বললেন, কাগজটিকে নিয়ে আপনাদের এই সাফল্যর শুভ কামনা জানাতে এসেছি। আরও এগিয়ে যান। প্রিয় আশরাফ ভাই বাংলাদেশ প্রতিদিন এগিয়ে চলছে। আমাদের প্রচার সংখ্যা বেড়েই চলছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন থেকেও বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশিত হয়। দেশ বিদেশে রেকর্ড করতে চলছি আমরা। কিন্তু আপনি শুয়ে আছেন ব্যাংককের একটি হাসপাতালে। হাসপাতালের বেড আপনাকে মানায় না। প্লিজ ফিরে আসুন। আগের মতো হেঁটে চলুন আপনার মতো। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে ভোট উৎসবের দিকে। আশা করছি, এই নির্বাচনে আপনি অংশ নেবেন। মানুষের কাছে যাবেন আবার। আপনার এলাকাবাসী অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আপনাকে ভালোবাসে। সামাজিক গণমাধ্যম খুললেই দেখি সবাই বলছে আপনার কথা। আপনি ফিরে আসুন। দেশের মানুষকে জানান দিন আপনি সুস্থ আছেন, ভোটে আছেন।
প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। বললেন, তার বিরুদ্ধে একটি মহল কুৎসা রটাচ্ছে তিনি অসুস্থ। তারপর বললেন, বুঝতে পারছ কারা কুৎসা রটাচ্ছে? আমি জানতাম তিনি দারুণ অসুস্থ। যে কোনো দিন চলে যাবেন। তারপরও বললাম, এই মিথ্যা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বললেন, এই কারণে আমি সিলেটে যাচ্ছি। একটা বড় জনসভা করব। এই শো ডাউনের খবর এটিএন বাংলাতে দেখাবে। মারা যাওয়ার আগে আবদুস সামাদ আজাদের এটাই ছিল শেষ শোডাউন। মানুষের ঢল ছিল। আমিও ভালোবেসে খবরটি প্রকাশ করেছি। কিন্তু আবদুস সামাদ আজাদ আর থাকলেন না আমাদের মাঝে। এরপর ঢাকা ফিরে চলে গেলেন হাসপাতালে। সেই হাসপাতাল থেকে সিলেট গেলেন লাশ হয়ে। আর ফিরলেন না। সামাদ আজাদের সর্বশেষ বক্তব্য এখনো কানে বাজে। একটা সময় আমাদের জাতীয় নেতারা এমনই ছিলেন। সাদামাটা। এখনকার মতো কৃত্রিম নন। মানুষের জন্য ছিল তাদের রাজনীতি। এখন রাজনীতি অনেকের ব্যবসা। এমপি হয়ে সবাই নিজেকে আগের যুগের মতো জমিদার ঘোষণা দিয়ে লুটের রাজত্ব কায়েম করেন। মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই। আদর্শিক চিন্তা আর নেই। রাজনীতির আদর্শ পুরুষ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর দলের মন্ত্রী-এমপিদের কাছে এটা আশা করা যায় না। মানুষ স্বাভাবিক একটা পরিবেশ চায়। রাজনীতির নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কারও কাম্য নয়। বিতর্কিত খারাপ মানুষদের এমপি হিসেবে কেউই দেখতে চায় না। সৈয়দ আশরাফের মতো মানুষদের দরকার আমাদের সুস্থ রাজনীতির জন্য। রাজনীতির সুস্থতার জন্যই নিষ্ঠাবান নেতা-কর্মীদের সামনে আনতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ প্লিøজ বিতর্কিতদের বাদ দিন। মনোনয়ন দেবেন না যারা লুটের সঙ্গে জড়িত ছিল। সন্ত্রাস, চাদাঁবাজি আর মাদক ব্যবসাকে উৎসাহিত করেছিল। মামলা হামলা করেছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর। এমন জনপ্রতিনিধি দরকার নেই নৌকার মাঝি সেজে যারা অত্যাচার করেছিল দলের নেতা-কর্মীদের ওপর। হামলা মামলায় জর্জরিত করেছিল নিজের দলের কর্মীদের। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, একই অনুরোধ, অন্য দলগুলোর কাছেও। বিএনপি ভোটে যাবে কিনা স্পষ্ট করছে না। তবে আমার ধারণা তারাও ভোটে যাবে। কারণ গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার পরিবর্তনে ভোটের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ আর জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি দেখতে চায় না। জটিল হিসাব নিকাশ করতে চায় না। গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে যেতে চাইলে ভোটে যেতে হবে। ২০১৪ সালে ভোটে না যাওয়ার খেসারত বিএনপিকে এখন দিতে হচ্ছে। আগামীতে আরও দিতে হবে। এবার ভোটে না গেলে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে আর পারবে কিনা সন্দেহ। হয়তো মওলানা ভাসানীরও আপসহীন একটা ইমেজ ছিল। ভোট না করে তিনি শেষ মুহূর্তে দলীয় অস্তিত্বকে হুমকিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের পর বিএনপি তা কিছুটা টের পাচ্ছে। এবার বর্জনে গেলে কর্মী ধরে রাখতে পারবে না। সরকার ভোটের পর বিএনপিকে আর দাঁড়াতে দেবে না। ইতিহাস তাই বলে। বিএনপির এক নেতা বললেন, বিএনপি চেয়ারপারসনকে জেলে রেখে ভোটে যাবেন না। ভালো কথা। ভোটে না গেলে করবেনটা কী? ভোটের বিকল্প কী স্পষ্ট করবেন?
বাংলাদেশের মানুষ ভোট উৎসবকে ভালোবাসে। নতুন প্রজম্ম জেগে উঠেছে। তারা এবার ভোট দিতে চায়। এই প্রজম্ম কোনো খারাপ মানুষকে ভোট দেবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে তাদের ভোট যাবে না। আমরা একটা সুন্দর আগামী চাই। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চাই। শেখ হাসিনা মানুষের মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছেন। সেই আশার আলোকে জিইয়ে রাখতে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে আইনের শাসন নিয়ে। আর্থিক খাতের লুটেরাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশকে আর পেছনে নেওয়া যাবে না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির খলনায়কদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে আগামীতে। উন্নয়নে টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সেই দিন শুনলাম পানি উন্নয়ন বোর্ডে হাজার কোটি টাকার কাজে পাঁচগুণ বেশি বাজেটে টেন্ডার করা হয়েছে। এই ধরনের ভয়াবহ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে আগামীতে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা দরকার। কিন্তু অপশাসনের দরকার নেই। প্রশাসন ও বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা জরুরি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দলীয় করলে চলবে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের থাকতে হবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতায়। আদর্শিক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে আগাছা, পরগাছারা সবখানে ভর করে। হঠাৎ গজিয়ে ওঠারা নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক মনে করে। এই মানুষগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর দল। এই দলটি মানুষের কথা বলে। এই দলের নেত্রী মানুষের রাজনীতি করে। তাহলে কিছু সুবিধাভোগীর কথায় কান দেওয়ার কি দরকার? বরং সুবিধাভোগীরা কে কতটা কাজ করছে তার হিসাব-নিকাশ নিতে হবে। সার্বিক জনমতকে গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নয়ন ও ইতিবাচক কথাগুলো জানাতে হবে নতুন প্রজম্ম কে। এই প্রজম্ম মেধা মননে অনেক উচ্চতার। তাদেন চিন্তার প্রসার আমাদের আপ্লুত করে। ওরা মানুষকে জাগাতে পারে। এই জাগানো যেন ভুল পথে না যায়- চোখ খোলা রাখতে হবে। পাশাপাশি বিদেশে ভুল বার্তা যাতে না যায় সতর্ক থাকাটা জরুরি দেশের একটি সুন্দর আগামীর জন্য। সবাইকে খুশি করা যাবে না। তাই বলে নিজের লোকগুলোকে দূরে রাখার কী দরকার? ২০০৮ সালের আগে আওয়ামী লীগ যারা করেনি তাদের ওপর নির্ভরতা ভালো ফল আনবে না। ক্ষমতা আর মাঠের রাজনীতি আলাদা। ভোটের মাঠে ত্যাগীদের নিয়েই যেতে হবে। অন্যথায় সংকট তৈরি হবে মাঝপথে। যা সামলানো হবে কঠিন। সেই কাঠিন্যর আগামীর কথা চিন্তা করেই বর্তমানে থাকতে হবে ইতিবাচক ধারায়। তাহলে সৈয়দ আশরাফের মতো রাজনীতিবিদদের হৃদয় আবার জেগে উঠবে সকালের শিশিরধারায়। আপ্লুত হবে নতুন স্বপ্নের ঠিকানায়।