প্রায় ১১ মাস পর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে বিএনপি। ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বরের জনসভায় দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি ছিলেন। দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় আজকের জনসভায় প্রধান অতিথির চেয়ারটি খালি রাখে বিএনপি। জনসভায় বিএনপির ৭ দফা দাবি ও ১২ লক্ষ্য ঘোষণা করে। আজকের জনসভা থেকে দলটি ৩ অক্টোবর সব জেলা শহরে ও ৪ অক্টোবর সব মহানগরে সমাবেশ করে জেলা ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি দিয়েছে।

আজ রোববার বিএনপির জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতারা বক্তব্য দেন। জনসভায় মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা এবং ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকেও নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। বেলা দুইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই জনসভা শুরু হয়। বেলা দুইটায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও দুপুর ১২টা থেকে জনসভাস্থলে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আসতে শুরু করেন। বেলা দুইটা পর্যন্ত কয়েক হাজার নেতা-কর্মী সেখানে জড়ো হন।

জনসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সরকার কোথাও রেহাই পাবে না। সরকার যেভাবে চুরি, লুটপাট করেছে, তাতে সরকারের রক্ষা নেই। সরকার কয়লাকে ধুলা আর সোনাকে তামা বানিয়ে লুটপাট করেছে, তবুও সরকারের আশা মেটে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় পেয়েছে, মারাত্মক ভয় পেয়েছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা ছাড়া সরকারের কোনো উপায় নেই।

সরকার বিএনপিকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে, দাবি করে ফখরুল ইসলাম বলেন, অনেকে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন। সরকারও দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্ন দেখে সরকার বিএনপি-বিএনপি, খালেদা জিয়া-খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান বলে চিৎকার করে ওঠে। এই দুঃস্বপ্নের কারণ, সরকার জানে তাদের রেহাই নেই। এ কারণে সরকার আতঙ্কে আছে। এ সময় তিনি সরকারকে দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান।

আগামী নির্বাচন বিষয়ে বিএনপির ১২টি লক্ষ্য ও ৭টি দাবির কথা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। বিএনপির দাবিগুলো হলো: ১. তফসিল ঘোষণার আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, ২. জাতীয় সংসদ বাতিল করা, ৩. সরকারের পদত্যাগ ও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা, ৪. সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভোটকেন্দ্রে বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ, ৫. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, ৬. নির্বাচনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও তাদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ না করা, ৭. ক. বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, খ. তফসিল ও নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক মামলা স্থগিত, নতুন মামলা না দেওয়া এবং পুরোনো মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার না করা, গ. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীদের এবং সাংবাদিকদের আন্দোলন ও মতপ্রকাশের কারণে দেওয়া মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসভায় আসা নেতা-কর্মীরা। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী কী পরিবর্তন আনবে, সে বিষয়ে দলটি ১২টি লক্ষ্য তুলে ধরে। লক্ষ্যের মধ্যে আছে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিচার, প্রশাসন ও নির্বাহী বিভাগ গড়ে তোলা; স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে আরও আধুনিক শক্তিশালী ও কার্যকর করা; গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া; সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়-এই নীতি অনুসরণ; কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয় না দেওয়া; নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা; বেকার ভাতা চালু করা; স্বাস্থ্য ও কৃষিবিমা চালু করা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা; স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা; নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা; স্থানীয় সরকারকে আধুনিক ও যুগোপযোগীভাবে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া; প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা।

‘মাদার অব ডেমোক্রেসি খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে থাকা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের’ দাবিতে জনসভা করে বিএনপি। সরকারবিরোধী একটি বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিএনপি এই জনসভা করছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ ১ অক্টোবর থেকে নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।

ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে বিএনপির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকলেও বিএনপির সমাবেশে অন্য কোনো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এই জনসভা বিএনপি একাই করেছে।

এদিকে বিএনপির জনসভা চলাকালীন রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। জনসভা থেকে ফেরার পথে শাহবাগ এলাকা থেকে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এ কারণে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘জনসভা থেকে ফেরার সময় কেউ একা একা যাবেন না। সবাই দলবদ্ধভাবে ফিরবেন।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জনসভার প্রধান বক্তা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারের সাহস থাকলে সাত দিন সময় দিয়ে সমাবেশ করতে দিক, ঢাকা অচল হয়ে যাবে। আজকের জনসভার কোথাও নাশকতা, বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। তাহলে সরকার বিএনপির কোনো সভা-সমাবেশের কথা শুনলে বিশৃঙ্খলার অজুহাত দেয় কেন? তিনি অভিযোগ করেন, সরকার রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ধ্বংস করে দিয়েছে। লুটপাট করার জন্য কোনো কিছু বাকি রাখেনি সরকার। জনগণ এই সরকারকে দেখতে চায় না। আজ খালেদা জিয়ার দাবিগুলোর সঙ্গে একমত হয়ে বিভিন্ন দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন ধর্ম, দল, ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ঐকমত্যে এসেছে।

প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিতরা আওয়ামী লীগের না, জনগণের সেবক। আপনারা আওয়ামী লীগের কথা শুনবেন না। যদি আওয়ামী লীগের কথা শোনেন, তাহলে জনগণ আপনাদের আদালতের কাঠগড়ায় তুলবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরপেক্ষ হয়ে যান। এখনো সময় আছে।’ তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে বলেছেন, তিনি প্রতিশোধের রাজনীতি করেন না। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে সংখ্যালঘুসহ সবার জন্য কাজ করবে বলেও তিনি জানান।

জনসভার কারণে শাহবাগ এলাকায় যানজটে পড়ে ভোগান্তিতে পড়েন অনেক যাত্রী। জনসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সরকার নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করছে। সরকার জানে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের জয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মাঠ দখলের কথা বলেছে। আমরা মাঠে নামলে আমাদের প্রতিহত করার কথা বলেছে। আমাদের প্রতিহত করলে আমরাও প্রতিহত করব, মাঠ দখল করলে আমরাও মাঠ দখল করব—ছেড়ে দেব না। আমরা বাড়িতে বসে থাকব, এটা ভাবলে বোকামি হবে।’

বিএনপি পুলিশের অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ করবে, জানিয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, এরপর থেকে বিএনপি আর পুলিশের অনুমতি নিয়ে সভা-সমাবেশ করবে না। কোনো সভার আগে বিএনপি পুলিশকে বলবে যে দলের সভা আছে, পুলিশের অনুমতির জন্য বিএনপি বসে থাকবে না। এ সময় তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সাত দিনের মধ্যে এই আইন বাতিল করে দেওয়া হবে বলেও জানান।

দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। এই সরকার নির্বাচন করলে জিততে পারবে না। এ কারণে সরকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভয় পায় এবং হামলা, মামলা দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যস্ত রাখতে চায়। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এখানে নেই। তিনি দৃশ্যের আড়ালে থাকলেও তিনি মনের আড়ালে নন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে আছে।

জনসভাস্থলের আশপাশের এলাকা থেকে কয়েকজন যুবককে আটক করে পুলিশ জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, ‘বিএনপি সব সময় জাতীয় ঐক্য চায়। বিএনপি সব সময় জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রস্তুত আছে। ঐক্যের বিষয়টি দুর্বলতা ভাববেন না। ভোট নেই, জন নেই—চাপ সৃষ্টি করবেন না।’ গণতন্ত্রের জন্য যাঁরা এক হবেন, তাঁদের না করা হবে না বলেও তিনি জানান।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শামসুজ্জামান দুদু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শওকত মাহমুদ, আমান উল্লাহ আমান, জয়নুল আবেদীন, জয়নুল আবদিন ফারুখ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান, হাবিবুর রহমান, ফজুলর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন, মজিবর রহমান সরোয়ার, খায়রুল কবির, মোয়াজ্জেম হোসেনসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর বিএনপির নেতারা জনসভায় বক্তব্য দেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here