অস্তিত্ব সংকটে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্পের কারিগররা
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প। আগের মতো নেই এই শিল্পের জৌলুস। তবে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন উপকরণকে জীবিকার প্রধান বাহন হিসেবে আঁকড়ে ধরে আছেন উপজেলার ৫নং এলাঙ্গী ইউনিয়নের দাস পরিবারের মানুষ। এই বাঁশই বর্তমানে তাদের জীবিকার প্রধান বাহন। বর্তমান বাজারে প্লাস্টিকপণ্য, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিলসহ বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে এককালের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প।
অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অভাব-অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বাঁশ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছেন। ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্মটি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় গ্রামীণ জনপদে বাঁশ দিয়ে তৈরি হতো গৃহস্থালী ও নিত্য-নৈমত্তিক ব্যবহার্য জিনিসপত্র। বাড়ির পাশের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ কেটে গৃহিনীরা তৈরি করতেন হরেক রকমের পণ্য। তখনকার সময় কদরও ছিল আকাশচুম্বী। বাঁশ আর বেতের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলেন এখানকার কারিগররা। কালের পরিবর্তনে প্লাস্টিক আর কাঠের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিলুপ্তির পথে এক সময়ের ঐতিহ্যের বাঁশ-বেতের শিল্প।
জানা গেছে, উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের ফাজিলপুর গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়নে এ শিল্পীদের ব্যস্ততা ছিল প্রাচীনকাল থেকে। অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। বেতের পাটি, বাঁশের খাঁচা, মাচা, চাটাই, গোলা, সুড়ি, চাই, মোড়া, ভালা, কুচা, টুরকি, কাপি, ছালুনিসহ নানা ধরনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করেতা এক সময়। এসব জিনিস বানানোর দৃশ্য এখন খুব বেশি একটা চোখে পড়ে না। এই ইউনিয়নের কয়েকটি পরিবার এ পেশাকে আঁকড়ে ধরলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প।
ফাজিলপুর গ্রামের বাসিন্দা সুমন কুমার দাস বলেন, “বাবার থেকে শিখে ঐতিহ্য ধারণ করে বংশানুক্রমে চলে আসছে তাদের এ পেশা। শিল্পের দুর্দিনে হাতেগোনা কিছু সংখ্যক পরিবার শিল্পটিকে আঁকড়ে ধরে আছেন। নানাবিধ সংকটের ফলে মুখ থুবড়ে পড়ছে এ পেশার সঙ্গে জড়িত প্রায় শতাধিক পরিবার। ফলে বিলুপ্তির পথে এক সময়ের ঐতিহ্যের বাঁশ-বেতের শিল্প। অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও পূর্বপুরুষের হাতেখড়ি এই পেশাকে কিছুতেই ছাড়তে পারেননি তারা”।
স্থানীয় বাসিন্দা বকুল কুমার দাস এ পেশাকে আকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বহুদিন ধরে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এ পেশায়। বাজারে চাহিদা কম থাকা ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি না পাওয়ায় তেমন লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না তারা। তিনি প্রতিটি কাপি ১৫০, টেপারী ১৪০, চ্যাঙারী ২০০- ২৪০, পেতে ১০০, চালন ১৩০, পলো ৫০০, চাটাই পাইকারি ৪৫০ টাকা দামে কোটচাঁদপুর হাঁটে বিক্রি করছেন।
আরেক বাসিন্দা রবিন দাস বলেন, “বর্তমানে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের তৈরী পণ্যেরও দাম বেশি নিতে হচ্ছে। প্রতিটি বাঁশ কিনতে হচ্ছে ১০০-১২০ টাকায়। পরিবারের সদস্যরা বাড়ির কাজের পাশাপাশি এ কাজে সহযোগিতা করছে। প্রতিহাটে যা বিক্রি হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে”।
সুনীল কুমার দাস বলেন, “তাদের তৈরী কিছু পণ্য কোটচাঁদপুর ও কালিগঞ্জ বাজারে সপ্তাহের দুই ই- টসহ গ্রামে-গঞ্জে ফেরি করলে কিছু সৌখিন মানুষ আছে তাদের পণ্য কিনে নেন। বেলা শেষে যা বিক্রি হয় তা দিয়ে তরিতরকারি কিনে বাড়ি ফেরেন তারা। এভাবেই তাদের জীবন-জীবিকা চলে”।
এ বিষয়ে কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার উছেন-মে জানান, “বাঁশ-বেত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। এটিকে টিকিয়ে রাখা জরুরি। এ শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, তারা যোগাযোগ করলে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করব। বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে”।
সবুজদেশ/এসএএস