ঢাকাঃ

সিটি কর্পোরেশন মশা নিধনে কেন কার্যকর ওষুধ ছিটাতে পারছে না- এই প্রশ্ন তুলে হাইকোর্ট বলেছেন, ওষুধ কার্যকর কিনা সে পরীক্ষা আগে কেন করা হয়নি?

সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, গত বছর ওষুধ ছিটানোর পর ঘরে বসেই তার ঝাঁজ পেতাম, এবার গন্ধও পাওয়া যায় না।

মানুষের ধারণা এবারের ওষুধে কাজ হচ্ছে না। আদালত বলেন, দিনের পর দিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে এখন মহামারী আকার ধারণ করছে। অথচ জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ওষুধ আমদানি হচ্ছে না। আমরা চাই মশা মরুক।

সিটি কর্পোরেশনের আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলছেন, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তাতে কাজ হচ্ছে না।

আর আপনারা বলছেন ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিলে মশা নির্মূল হবে। কোনটা সত্যি? এদিকে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে এডিস মশা নির্মূল করতে চায় দুই সিটি কর্পোরেশন- এই মর্মে আদালতে দুই সিটির দেয়া হলফনামায় বলা হয়েছে, এখন যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তাতে স্নায়ু দুর্বল হয়ে মশা নিন্তেজ হয়ে পড়ছে।

কিন্তু নির্মূল হচ্ছে না। ফলে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিলে মশা নির্মূল হবে। একই সঙ্গে মশা নির্মূলে দুই সিটি কর্পোরেশন তিন দিন সমন্বিতভাবে অভিযান পরিচালনা করতে চায়।

আইনজীবীদের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রগতি জানাতে বলে আগামী মঙ্গলবার পরবর্তী আদেশের দিন রেখেছেন বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীর হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এদিকে ডেঙ্গু ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ায় আদালতের ক্ষোভের মুখে মশার ওষুধ বদলে ফেলার কথা জানান দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা। তার আগ পর্যন্ত বর্তমান ওষুধই ব্যবহার হবে মাত্রা বাড়িয়ে।

একই সঙ্গে মশা নির্মূলে আগামী ৪ দিন সমন্বিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ।

দুই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় হাজির হতে গত ২২ জুলাই নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে অনুসারে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা হাইকোর্টে হাজির হন।

আদালত তাদের বক্তব্য শোনেন এবং এডিস মশা নির্মূলে এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর ওষুধ আনার প্রক্রিয়া জানতে চান হাইকোর্ট। দুপুর ২টার মধ্যে তাদের তথ্য জানাতে বলা হয়। পরে দুপুর ২টায় আদালতের শুনানিতে দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আইনজীবীরা এডিস মশা নির্মূলে ওষুধের মাত্রা বাড়ানোর কথা বলেন।

আদালতে ঢাকা উত্তর সিটির পক্ষে আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু ও দক্ষিণ সিটির পক্ষে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান।

আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, ‘এ বছর অ্যালার্মিং সিচ্যুয়েশন কেন হলো? এ ক্ষেত্রে কী সমস্যা, তা কি চিহ্নিত করেছেন?’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, চিন্তা করতে হবে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি সবার হেলথ কনসার্ন। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনই বলুক, সেটাই ভালো হয়।

এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, আমার এই সিটি কর্পোরেশনে এক কোটির বেশি লোক। আর ১০টি জোনে ৭৫টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রমে জনবল মাত্র ৪২৯। তখন আদালত বলেন, এ বছর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এত কেন? তিনি বলেন, এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা।

ক্লাইমেট সেনসেটিভ ডিজিজ। আর এ বছর আমাদের দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত, সর্বোচ্চ আর্দ্রতা ও সর্বোচ্চ উষ্ণতা ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এর ভয়াবহ প্রভাব চলছে। সব দেশেই তো ডেঙ্গু আছে। এ সময় তিনি কয়েকটি দেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা তুলে ধরেন।

আদালত বলেন, ‘ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না কেন? গত বছর ওষুধ ছিটালে ঘরেও তার ঝাঁজ পেতাম। এবার গন্ধও পাওয়া যায় না। টিভিতে দেখলাম সড়কমন্ত্রী বললেন, এবারের ওষুধ কাজ করছে না।

এর আগে তো কেউ স্বীকারই করেনি।’ তখন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, আমরা যখনই ওষুধ আনি তখনই সরকারি দুটি ল্যাবে টেস্ট করে পজেটিভ সার্টিফিকেট পেলেই ব্যবহার করি।

অর্থাৎ, ল্যাব পরীক্ষায় সন্তোষজনক বললে ব্যবহার করি। তখন আদালত বলেন, ‘যখন দেখলেন ওষুধ কাজ করছে না তখন অন্য জায়গায় দ্রুত টেস্ট করবেন না? এসব কি আমাদের বলে দিতে হবে? হোয়াট ইজ দ্য প্রবলেম? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সারা দেশের স্বাস্থ্য দেখবে। এগুলো আমরা দেখতে চাই না। অবস্থা যেরকম যাচ্ছে এটা কেবল সিটি কর্পোরেশনের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। বিষয়টা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেখতে হবে।’ জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন তৃতীয় ল্যাবে টেস্ট করতে দিয়েছি। কৃষি গবেষণাতে।

এরপর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. মোমিনুর রহমান বলেন, আমরা পুরো ওষুধই চেঞ্জ করব। এজন্য একটি কারিগরি কমিটি করেছি। সমস্যা হচ্ছে, পিপিপির (পাবলিক প্রাইভেট প্রকিউরমেন্ট) মাধ্যমে এটা করতে হয়। সেখানে অনেক সময় লাগে।

তবে ডিপিএমর মাধ্যমে কিনলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব। একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে ওষুধ আনবেন। আমরা আদেশ দেব। আমরা ওষুধ চাই। কী প্রক্রিয়ায় আনবেন সেটা হলফনামা আকারে আপনার আইনজীবীকে দিতে বলেন। সারা দেশের মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত। ঘরে ঘরে মানুষ আক্রান্ত। সবাই যদি হাসপাতালে যেত তাহলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হতো।’ এরপর আদালত দুপুরের মধ্যে কোন প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ওষুধ আনা হবে তা হলফনামা আকারে জানাতে বলেন।

শুনানিতে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তা অকার্যকর নয়। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এখন এডিস মশারা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে গেছে। এজন্য ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে তা ছিটানো হলে মশা নির্মূল হবে। তিনি বলেন, সমন্বিতভাবে অভিযান না চালানোয় দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ সিটিতে মশা মারার ওষুধ ছিটালে সেই মশা উড়ে উত্তরে চলে যায়। আদালত বলেন, এটা কি সম্ভব?

সদরঘাটের মশা কিভাবে উড়ে উত্তরায় চলে যায়? আইনজীবী বলেন, আমরা ওষুধ ছিটানোর ডোজ বাড়িয়ে দিনে ৫-৬ বার স্প্রে করতে চাই। কারণ এই একই ওষুধ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ৫-৬ বার ছিটানোয় সেখানে মশা নেই। আদালত বলেন, আপনারা দিনে ৩ বা ৬ বার ফায়ার করুন তা দেখা আমাদের বিষয় না। আমরা চাই মশা মরুক। উত্তর সিটির আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু বলেন, আমরা একটি সমন্বিত কর্মসূচিতে যাব। দুই সিটিতে এ কর্মসূচি চলবে। তিনি বলেন, নতুন ওষুধ ছিটালে তা পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশেষ করে ইঁদুর বা কীটপতঙ্গ মারা যেতে পারে। আদালত বলেন, ইঁদুর মারা গেলে কি হবে? মানুষের জীবন তো বাঁচাতে হবে।

মশাবাহিত রোগ ছড়ানো নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে গত ১৪ জুলাই হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নির্মূলে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা এক সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা আকারে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মাধ্যমে বিবাদীদের জানাতে বলা হয়েছিল।

তারই ধারাবাহিকতায় ২২ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফায়রোজ দুই সিটি কর্পোরেশনের পদক্ষেপ সম্পর্কিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এই প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হননি হাইকোর্ট। তাই এ কার্যক্রমের বিষয়ে জানাতে দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে কিনা : এদিকে হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চে ডেঙ্গু পরীক্ষায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে কিনা এবং সরকারি হাসপাতাল ফ্রি করাচ্ছে কিনা তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ মৌখিকভাবে আগামী সোমবারের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কাছে এ তথ্য জানতে চেয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির কাছ থেকে জানবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here