মাহফুজ আনামঃ

গত ১ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ প্রতিবেদনটি আমাদের সরকার পরিচালনার কিছু দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, যেখানে যোগ্যতা বিবেচনা না করে ব্যক্তিগত পছন্দ বা সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগের প্রসঙ্গ এসেছে। সেই সঙ্গে প্রকাশ করেছে আমাদের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন, সেই বিষয়টিও।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমত, ইসরায়েলের নাম গোপন করে দেশটির একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার অভিযোগ এসেছে, যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কই নেই। দ্বিতীয়ত, দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধানের ক্ষমতা অপব্যবহার করে তার ভাইকে ছদ্ম নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ভুয়া পাসপোর্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তার ভাই হাঙ্গেরিতে থাকতে পারে এবং ব্যবসা করতে পারে। প্রতিবেদন থেকে আরও একটি প্রশ্ন উঠেছে। সেটি হলো— স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি এই পলাতক ভাইয়েরা কীভাবে পুলিশের অজান্তে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছে, যোগ দিচ্ছে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠানে? এর প্রত্যেকটিই ফৌজদারি অপরাধ। এর মধ্যে যেকোনো একটি অপরাধ করলেই যেকোনো সাধারণ মানুষের কারাগারে থাকার কথা। তবে যাদের নিয়ে এই প্রতিবেদন, তারা কোনো সাধারণ মানুষ নন।

ইসরায়েল থেকে নজরদারি করার যন্ত্র কেনার বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কাজেই এই বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার করে সবার সামনে তুলে ধরা দরকার। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) প্রতিবাদলিপিতে ইসরায়েল থেকে এ জাতীয় যন্ত্র কেনার কথা অস্বীকার করে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরি থেকে কেনা হয়েছে। হাঙ্গেরি থেকে কেন এই সরঞ্জাম কেনা হলো? এই জাতীয় সরঞ্জাম তৈরির জন্য হাঙ্গেরি কখনোই নির্ভরযোগ্য বলে জানা যায় না। আল জাজিরার প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আইএসপিআরের উচিত হাঙ্গেরির যে প্রতিষ্ঠান থেকে সরঞ্জাম কেনা হয়েছে তার নাম প্রকাশ করে নথিগুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা। যেহেতু আড়িপাতার যন্ত্রগুলো জাতিসংঘের মিশনের জন্য কেনা হয়েছিল, তাই এ সম্পর্কিত তথ্য সামনে আনা হলে দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার কথা না। তা না করে কেবলমাত্র প্রতিবাদলিপি দেওয়ার মাধ্যমে অস্বীকার করে অভিযোগের বরফ খুব বেশি গলানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

যতটুকু সরকার ও আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশি গণমাধ্যম যতটা প্রচার করছে, সেটাই এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। আমাদের হাজারো পাঠক জানতে চাইছেন আল জাজিরা কী বলেছে সেটা প্রকাশ না করে আমরা কীভাবে সরকার ও সামরিক বাহিনীর প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করছি? সাংবাদিকতার সাধারণ চর্চা এবং দ্য ডেইলি স্টারে যেটা অনুসরণ করি সেটা হলো— আমরা যদি মূল ঘটনা প্রকাশ না করি, তাহলে প্রতিবাদলিপিও প্রকাশ করি না। এক্ষেত্রে মূল ঘটনাটি আল জাজিরার প্রতিবেদন এবং প্রতিবাদলিপি দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনী। পাঠক জানতে চায়, কী কারণে আমরা প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু প্রকাশ করিনি।

গণমাধ্যম হিসেবে আজ আমরা মুক্ত হলে প্রতিবেদনটি নিয়ে আরও গভীর আলোচনা করতে পারতাম এবং এটি নিয়ে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করে এর পেছনের সত্যটা বের করতে পারতাম। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হিসেবে আল জাজিরার এই প্রতিবেদনকে সর্বোচ্চ মানের বলা যায় না। প্রতিবেদনটির শক্তিশালী কিছু দিক থাকলেও দুর্বলতা রয়েছে বিস্তর। আমি মনে করি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনুমান ও কটাক্ষ করে দাবি করার চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ তুলে ধরাটা বেশি জরুরি। প্রতিবেদনটিতে যত জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, তত তথ্য দিয়ে সব বিষয়ের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। তবে, এই প্রতিবেদনের শক্তিশালী দিক হলো— এটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ দিয়েছে। এ ছাড়াও কিছু শক্তিশালী ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ের তথ্য-প্রমাণও প্রতিবেদনে রয়েছে।

কিন্তু, সে কথা কে বলবে? আমরা যদি আরও ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারতাম, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারতাম এই প্রতিবেদনের দুর্বল দিকগুলো। আমরা কি সেটা করতে পারি? আমরা কি জনগণের কাছে নীতি নির্ধারকদের জবাবদিহি করাতে পারি? আমরা কি এটা প্রকাশ করতে পারি যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে কেন এত দেরি হয় এবং সেগুলোর খরচ কেন প্রাক্কলিক বাজেটের চেয়ে তিন-চার গুণ বেড়ে যায়? আমরা কি খুঁজে বের করতে পেরেছি যে কারা বিদেশে অর্থ পাচার করে? এমনকি পানামা পেপারসে যখন আমাদের দেশের কিছু মানুষের নাম প্রকাশ পেল তখনো কি আমরা বিষয়টি অনুসন্ধান করেছি? বছরের পর বছর যাদের কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের কি আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি? আমরা কি খুঁজে বের করতে পেরেছি যে কেন ঋণখেলাপিদের টাকা পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সুদ মওকুফ হচ্ছে? টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’য় যাদের বাড়ি আছে বা মালয়েশিয়ায় অবৈধ সেকেন্ড হোম যারা করেছেন, তাদের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? না, তাদের কারও বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করিনি। কারণ, তারা সবাই আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। আমরা তাদের নাড়ানোর সাহস পাইনি। কখনো কখনো আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করি। সেটা করতে পারি তখনই, যখন ঘটনার মূল হোতাকে সামনে না আনা হয়, কিংবা আসল অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় না থাকে কিংবা আমাদের প্রতিবেদন তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়।

তাহলে আমরা কেন ‘শুনব না, দেখব না, বলব না’ নীতি নিয়েছি?

কারণ একটাই।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর সর্বশেষ অনুসন্ধান (২০২০) অনুযায়ী তিনটি ক্ষেত্রের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। প্রথমটি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, দ্বিতীয়টি ডিজিটাল জগতের অধিকার এবং তৃতীয়টি ভিন্নমত পোষণের অধিকার।

তাদের প্রতিবেদন বলছে, গত বছর দুজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, ৭৮ জনকে গুরুতরভাবে আহত করা হয়েছে এবং ১৬৬ জনকে হত্যা, অপহরণ, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি করা বা তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ৫৮ জন সাংবাদিকের নামে মোট ৩৫টি মামলা করা হয়েছে। ২০ জন সাংবাদিকের নামে ১২টি ফৌজদারি মানহানির মামলা করা হয়েছে। ৩১ জন সাংবাদিকের ক্যামেরাসহ খবর সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম ভাঙচুর করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের কতটা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হয়, এই উদাহরণগুলো তা বোঝার জন্য মোটেই যথেষ্ট না। সাংবাদিকদের নামে ‘গুজব ছড়ানো’, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা’, ‘দেশের ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়। এমনকি কোনো ব্যক্তিকে ‘সামাজিক’ভাবে হেয় করা বা ‘সম্মানহানি’ করার অভিযোগগুলো ‘বিচারযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যদিও তারা সামাজিকভাবে হেয় করা বা সম্মানহানি বলতে কী বোঝাতে চায়, তার কোনো পরিষ্কার সংজ্ঞা দেওয়া হয় না বা এটাও বলা হয় না যে ওই সাংবাদিক আইনের কোন ধারাটি লঙ্ঘন করেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে শুধু পুলিশ না, ক্ষমতাসীনদের সবাইকে কতটা স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দেওয়া হয় তা কল্পনাও করতে পারবেন না। যখন জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের একজন সাংবাদিককে জেলা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দেখা করতে বলেন, কিংবা স্থানীয় পুলিশ খোঁজ নিতে থাকেন যে ‘আপনি এবং আপনার পরিবার কখন, কোথায়, কী করছে’, কিংবা বলা হয় ‘সাবধানে থাকবেন, আপনার ওপর আমাদের নজর আছে’, কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা কোনো স্থানীয় সন্ত্রাসী সাংবাদিকের বাড়িতে গিয়ে বলে ‘আপনার দিন ঘনিয়ে এসেছে’, তখন আমাদের সাংবাদিকরা কোন পরিস্থিতির মধ্যে থেকে কাজ করেন তা হয়তো খানিকটা ধারণা করতে পারবেন। এভাবেই আমাদের সাংবাদিকদের কাটাতে হয় দিন, মাস এমনি বছর। (এমনই এক পরিস্থিতিতে আমাদের একজন সংবাদদাতাকে উচ্চপর্যায়ের ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে বাঁচাতে অন্যত্র সরিয়ে রাখতে হয়েছিল।)

যখন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলা হয় গুজব ছড়ানো হচ্ছে; যখন সরকার পুরোপুরি লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পরও বাস মালিক রাস্তায় বাস নামিয়েছে, এমন প্রতিবেদন করা হলে বলা হয় বাস মালিকের ‘মানহানি’ হয়েছে। এর ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মানহানির মামলা হয়েছে, পুলিশ সেই মামলা গ্রহণ করেছে। প্রতিবেদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যখন করোনা মহামারিতে দরিদ্রদের জন্য সরকারের দেওয়া চাল চুরির প্রতিবেদন করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে একটি বৃহত্তর অনলাইন নিউজ পোর্টালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও একটি জাতীয় সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হতে পারে; যখন কোনো মৃত্যুর ঘটনায় কেবলমাত্র পুলিশের ভাষ্য প্রকাশ না করে ভিন্ন মত প্রকাশ করলে কোনো অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিউজ এডিটর ও স্টাফ রিপোর্টারের নামে মামলা ও তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে; তখন দেশের গণমাধ্যমগুলোর বাস্তব চিত্র সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর্টিকেল ১৯-এর প্রতিবেদনের মতোই এমন বাস্তব উদাহরণের শেষ নেই।

সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে— ভয়ংকর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মানহানির বিধানের সুস্পষ্ট অপব্যবহার। যাকে বর্তমানে প্রচলিত ‘গণমাধ্যম দমনকারী সব আইনের মূল’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। পুলিশ এই আইনের আওতায় আক্ষরিক অর্থেই যে কাউকে, যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এই আইনের ব্যাখ্যা অস্পষ্ট এবং যে কারো নামে মামলা করার ও গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য। জামিন অযোগ্য কোনো মামলার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের হাত অনেকটাই বাঁধা থাকে। ফলে, অভিযুক্তকে নিশ্চিতভাবেই কারাগারে পাঠানো হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি চাইলে অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে পারেন। তবে, তার জন্য লেগে যেতে পারে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত। (ফটো সাংবাদিক কাজলের জামিন পাওয়ার ঘটনাটি এক্ষেত্রে উত্তম উদাহরণ হতে পারে।)

কাজেই বাস্তবতা হলো— অভিযুক্ত হলেই গ্রেপ্তার হতে হবে এবং অপরাধী হোক বা নির্দোষ তাকে জেল খাটতে হবে। একটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলা দিয়েও একজনকে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস জেল খাটানো সম্ভব।

মানহানির মামলায় আইনে স্পষ্টভাবে দুটি জিনিস বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে— কেবলমাত্র ভুক্তভোগী, অর্থাৎ যার মানহানি হয়েছে তিনিই মামলা করতে পারবেন। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে— একটি মানহানির ঘটনার জন্য কেবলমাত্র একটি মামলা দায়ের করা যাবে। বাস্তবে যে কেউ অপমানিত ‘অনুভব’ করলেই মানহানির মামলা করতে পারছেন। এমনকি যদি সেই ব্যক্তির ঘটনার সঙ্গে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকে, তবুও তিনি মানহানির মামলা করছেন। আমরা যদি কোনো দুর্নীতিপরায়ণ ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে লিখি, তাহলে তার অনুসারীদের মধ্যেও কেউ ‘অপমানিত’ বোধ করে মানহানির মামলা করতে পারছেন। আমরা যদি কোনো রাজনীতিবিদ, স্থানীয় নেতা বা কোনো জনপ্রতিনিধির অপকর্ম সম্পর্কে লিখি, তাহলে তার অনুসারীদের মধ্যে যে কেউ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছেন।

আমরা প্রায়শই অবাক হই এটা ভেবে যে, বিচারকরা কেন এ ধরনের মামলা গ্রহণ করেন? কেননা আইনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র তিনিই মামলা করতে পারবেন যার মানহানি হয়েছে। এ ছাড়াও আইনে আছে, একই অপরাধে একাধিক মামলা করা যাবে না। ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকরা এমন সংগত কারণ দেখিয়ে এই জাতীয় সব মামলা খারিজ করে দিতে পারেন। তারা বলতে পারেন, যে ব্যক্তি অপমানিত হয়েছে তিনি মামলা দায়ের করেননি এবং ইতোমধ্যে অন্য আদালতে এই ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগকে মামলা হিসেবে গ্রহণের জন্য ‘আইনের বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে পূরণ করতে হয়’। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মানহানির মামলায় তা পূরণ করা হয় না। তবুও মামলাগুলো নেওয়া হয়, মামলার শুনানি হয় এবং বিচার কার্যক্রম চলতে থাকে। (এই লেখকের বিরুদ্ধে একই ঘটনায় ৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি বাদে ৮৩টি মামলা গ্রহণ করা হয়েছিল।)

সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হলো— বাংলাদেশ যখন পুরোপুরি অজানা এক মহামারির হুমকিতে, যখন পুরো বিশ্ব এই বিধ্বংসী নতুন রোগের অপ্রত্যাশিত পরিণতি থেকে মুক্তি পাওয়ার লড়াইয়ে এবং যখন সাধারণ মানুষ তথ্যের জন্য গণমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে। আর্টিকেল ১৯-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৪৫৭ জনের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৯৮টি মামলা করা হয়েছে। যেখানে ২০১৯ সালে ৬৩ জনের নামে করা হয়েছিল ৫৫টি মামলা। এর পাশাপাশি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করে যে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ। তথ্যের অবাধ প্রবাহ বন্ধের জন্য এত প্রচেষ্টা।

এর সবগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে যদি বলি তাহলে আইনের ব্যাপক পরিধি, ধারাগুলোর অস্পষ্টতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০টির মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য ধারা, পুলিশকে স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষমতা দেওয়া, ‘আইনের বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে পূরণ না হওয়ার পরও’ মামলা গ্রহণ করা, যার মানহানি করা হয়নি তাকেও মামলা দায়ের করার সুযোগ দেওয়া, একই ঘটনায় একাধিক মামলা গ্রহণ করা, উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ার কারণে নিরপরাধ হলেও একজন ব্যক্তিকে বেশ কয়েক দিন (সর্বনিম্ন) জেল খাটতে বাধ্য হওয়া, গুম, খুন, মারধোরের হুমকি, ভয় দেখানো এবং রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মুক্ত গণমাধ্যম বিরোধী মনোভাব (অন্যথায় এমন আইন কেন তৈরি হয় যা ব্যবহার করে তারা সহজেই সাংবাদিকদের হয়রানি করতে পারেন) বাংলাদেশে সাংবাদিকতার জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

আইন, আইনের ধারার অস্পষ্টতা এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়নের স্বেচ্ছাচারিতা সম্মিলিতভাবে সাংবাদিকতার একটি ‘ব্ল্যাকহোল’ তৈরি করেছে। যে ‘ব্ল্যাকহোলে’র মধ্যে পরিচালিত হতে আমরা বাধ্য হই।

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যে পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন এটা তার কিছু নমুনা মাত্র। এটা আমাদের যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো ঢাকার অজুহাত নয়, বরং আমরা যে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে চাই তার সাক্ষ্য। আমরা যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করি, তার পেছনে থাকে আমাদের প্রতিবেদকদের জীবনের ঝুঁকি। প্রতিটি প্রকাশিত সম্পাদকীয়র কী ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হবে, তা নিয়ে এক ধরনের সুপ্ত ভয় কাজ করে। এমনকি প্রতিটি শব্দ ব্যবহার করতেই আমাদের ভাবতে হয় যে, এটা নিয়ে আবার কার ক্রোধের মুখোমুখি হবো। (দ্য ডেইলি স্টারকে একটি শব্দ নিয়ে ভুগতে হয়েছে এবং ভুগতে হচ্ছে। কারণ, শব্দটি একটি সংস্থার পছন্দ নয়।)

আল জাজিরার প্রতিবেদনটি আমাদের গণমাধ্যমের মাঝে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভাবার বোধ তৈরি করুক, আমাদের শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করুক, আমাদেরকে আমাদের ভুলগুলো মোকাবিলা করতে বাধ্য করুক এবং আমাদের এই মহৎ পেশার মূল্যবোধগুলো সঙ্গে নিয়ে সংশোধনের পথে যাত্রা শুরু করার ক্ষেত্রে আলোর দিশারি হোক।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here