আ.লীগে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ
এত দিন ছিল বিষোদ্গার ও মারামারিতে সীমাবদ্ধ, এখন শুরু হয়েছে নির্বাচনী এলাকায় সাংসদদের অবাঞ্ছিত করার প্রবণতা। গত ১২ দিনে আওয়ামী লীগের তিন সাংসদকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন নিজ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বিভেদ ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগে ফেলেছে।
মন্ত্রী-সাংসদদের অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাশাপাশি দলের এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ, গডফাদার আখ্যা দিয়ে এবং গুরুতর অভিযোগ সামনে এনে একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। এসব ঠেকাতে কিছু নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান, সতর্ক করে দেওয়া, এমনকি দল থেকে কাউকে কাউকে বহিষ্কারেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল মনোনয়ন নিয়ে দলের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের বিষয়টি। বৈঠকে রাজশাহী, দিনাজপুর ও বরগুনার কয়েকজন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি যেসব এলাকায় দ্বন্দ্ব প্রকট, সেসব স্থানে বিনা নোটিশে সফর করার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে ছিলেন এমন একাধিক নেতা এ তথ্য জানান।
সম্প্রতি বরগুনা সদরের সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও কাহারোল আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপাল এবং রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুরের সাংসদ আবদুল ওয়াদুদ ওরফে দারাকে দলের একাংশ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বারবার বলছেন, এবার মনোনয়ন পাবেন সমীক্ষায় এগিয়ে থাকা ব্যক্তিরা। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা দিয়ে ছয় মাস পরপর সমীক্ষা চালাচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা করা হয়েছে। তবে তা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু অনেক নেতা নিজেকে সম্ভাব্য প্রার্থী এবং ‘নেত্রীর সবুজ সংকেত’ পাওয়ার কথা এলাকায় প্রচার শুরু করে দিয়েছেন, যা দলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি আসনে গড়ে ১০ জন করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ নিয়ে অনেক আসনেই দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা যেভাবে দলের মন্ত্রী-সাংসদদের ‘পচানোর’ মিশন নিয়ে নেমেছেন, তাতে ভোটের সময় বিরোধী দলকে আর কোনো প্রচার চালানোর দরকার হবে না।
ওই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করছেন, ২০১৪ সালের মতোই আরেকটি ভোট হবে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার অর্থই হলো সাংসদ বনে যাওয়া। এ কারণে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে গেছে।
এর আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের সময়ও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনেকটা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে রূপ নেয়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরপরই উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন শুরু হয়। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রায় ২০০ নেতা, কর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছেন নিজেদের মধ্যে সংঘাতে। এর বেশির ভাগই নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দলে বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না। কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শৃঙ্খলাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের যে কেউ মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে কাদা-ছোড়াছুড়ি করা যাবে না। তিনি বলেন, সব দল নির্বাচনের মাঠে নেমে গেলে প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হবে। তখন আওয়ামী লীগের নেতারাও এক হয়ে যাবেন।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে যখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক চলছিল, এর এক দিন আগে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ-কাহারোল আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীলকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ওই আসনে বর্তমান সাংসদ ছাড়াও অন্তত চারজন প্রার্থী মাঠে আছেন। এর মধ্যে স্থানীয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদও রয়েছেন।
৪ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে স্থানীয় সাংসদ ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তাঁরা সাংসদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও মাদক-বাণিজ্যের মতো গুরুতর অভিযোগ আনেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, সাংসদের বাইরে এই আসনে আরও চার-পাঁচজন মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। এর মধ্যে সাবেক সাংসদ ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনও আছেন।
গত ২৮ আগস্ট রাজশাহীর দুর্গাপুরে শোক দিবসের এক আলোচনায় সাংসদ আবদুল ওয়াদুদকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে ওয়াদুদের বাইরে জেলা ও উপজেলার সাতজন নেতার নাম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাতজনের যে কাউকে মনোনয়ন দিলে সবাই তাঁর পেছনে কাজ করার ঘোষণা দেন দলের নেতারা। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশ্য সমাবেশ করে আবদুল ওয়াদুদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, তিনি পেটোয়া বাহিনী গঠন করে জমি ও পুকুর দখল, চাঁদাবাজি করেন। নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেন না।
শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদের হুইপ আতিউর রহমান (আতিক)। তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে শেরপুরের নকলা-নালিতাবাড়ী আসনের সাংসদ ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। গত মে মাসে মতিয়া চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ার সুপারিশ করে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী আসনের সাংসদ এ কে এম ফজলুল হকসহ পাঁচজনকে জেলা কমিটি থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়।
এর আগে গত বছর অক্টোবরে নাটোরের গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম আসনের সাংসদ আবদুল কুদ্দুসকে বয়কট করার ঘোষণা দেন দলের একাংশ। গত বছর জুলাইয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সাংসদ রুহুল হককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির জটিল হিসাব এখনো শুরুই হয়নি। এখনই নিজেদের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে যে যুদ্ধংদেহী অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা ঠেকানো না গেলে বড় সংকটেই পড়তে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ হওয়া মানে যেন যা খুশি তা করার অধিকার অর্জন করা। এ জন্য বর্তমান সাংসদদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ-ক্ষোভ আছে। আবার যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরা সাংসদ হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার লক্ষ্যে মরিয়া। তাই ভোট যত এগিয়ে আসবে, এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব আরও বাড়বে।