‘জ্ঞানের তরে শহীদ’ উপাধি পাওয়া এবং বিশ্ববিশ্রুত হাদিস গ্রন্থ ‘সহিহ্ মুসলিম’ রচয়িতা ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজের খ্যাতি জগতজোড়া। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে হাদিস শাস্ত্রে যোগ হয়েছে অসামান্য সব প্রামাণ্য। আজকের অবসরে সংক্ষেপে এ মহান মনীষীর জীবন নিয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব।
তাঁর পূর্ণ নাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ বিন মুসলিম বিন ওয়ারদ আল কুশাইরি নিশাপুরি। তৎকালীন খোরাসানের সমৃদ্ধ শহর ‘নিশাপুর’–এ ২০৪ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম মুসলিম ছিলেন সুগঠিত দেহ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী। সব সময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। স্বভাবে খানিকটা কঠোরতা ছিল। অনেকটা একরোখা ও জেদি ছিলেন। এ জেদই তাঁকে জ্ঞানের জগতে এগিয়ে যেতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে।
শিক্ষা–দীক্ষা
প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন একেবারে শৈশবেই। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে হাদিস শিক্ষায় হাতেখড়ি হয়। তাঁর প্রথম হাদিসের শিক্ষক ছিলেন ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া আত তামিমি। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি হজে যান। হজ সমাপ্ত করে সেখানকার শিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক ছিলেন ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মাসলামা আল কা ‘নাবি। এরপর তিনি হাদিস শেখার উদ্দেশ্যে মদিনা, কুফা, বসরা ও মিসরে ভ্রমণ করেন। তাঁর শিক্ষক অসংখ্য। ইমাম বুখারি, ইমাম যুহলি ও ইসহাক বিন রাহুয়াহ তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে জগদ্বিখ্যাত। ছাত্রজীবনে তিনি ৩ লাখ হাদিস মুখস্থ করেন।
কর্মজীবন
কর্মজীবনও তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের প্রচার–প্রসারে। তাঁর ছাত্রের সংখ্যার কোনো সীমা নেই! ছাত্রদের মধ্যে ইমাম আবু ইসা তিরমিজি, সালিহ বিন মুহাম্মাদ জাযারাহ, আহমাদ বিন মোবারক আল মুসতামলি পৃথিবী বিখ্যাত। তাঁর সমকালীন মনীষী প্রায় সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। হাদিস শাস্ত্রের দুই বিখ্যাত দিকপাল ইমাম আবুযুরআ ও আবুহাতিম তাঁকে সমকালীন মুহাদ্দিসদের থেকে এগিয়ে রাখতেন।
তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম—তাঁর সুবিখ্যাত সংকলন ‘সহিহ্ মুসলিম’। ৩ লাখ হাদিস থেকে বাছাই করে এ গ্রন্থটি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবির মতে মুসলিম শরিফের মোট হাদিস সংখ্যা ১২ হাজার। ইমাম মুসলিম এ গ্রন্থটি সংকলন করতে পনেরো বছর সময় ব্যয় করেছিলেন। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ছোট ছোট গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন।
সামগ্রিক বিচারে ইমাম মুসলিমের সংকলিত ‘সহিহ্ মুসলিমের’ তুলনায় ‘সহিহ্ বুখারি’কে এগিয়ে রাখেন শাস্ত্রজ্ঞরা। তবে প্রায় সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে যে, সহিহ্ মুসলিম বিন্যাসের সৌন্দর্যে সহিহ্ বুখারি থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। এমনকি ইমাম আবু আলি নিশাপুরি মন্তব্য করেছেন, ‘আকাশের নিচে এ তল্লাটে কোরআনের পর সহিহ্ মুসলিম থেকে বিশুদ্ধ কোনো গ্রন্থ নেই।’ সহিহ্ মুসলিম অধ্যয়নকারী যে কেউ বিষয়টি সহজে উপলব্ধি করতে পারবেন।
মৃত্যু
ইমাম মুসলিম (রহ.) প্রচণ্ড মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন বিপুল পরিশ্রমীও। তাঁর মনোবল ছিল আকাশচুম্বী। একবার রাতের বেলায় দরসে হাদিসের আসর বসেছে। একজন একটি হাদিস জিজ্ঞেস করলেন ইমাম মুসলিমকে। ঘটনাক্রমে তাৎক্ষণিক তাঁর হাদিসটি মোটেও মনে পড়ছিল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফিরে এলেন। ঘরে আলো জ্বালালেন। একাকী বসে শুরু করলেন হাদিসটির সন্ধান। ঘরের লোকেরা বাটিভর্তি খেজুর রাখলেন তাঁর সামনে। তিনি হাদিসটির সন্ধানও চালিয়ে যেতে থাকলেন পাশাপাশি খেজুরও খাচ্ছিলেন। রাতভর তিনি হাদিসটির সন্ধানে ব্যাপৃত থাকার পর ঠিক ভোরের সময় হাদিসটি পাওয়া গেল। এদিকে বাটিতে থাকা খেজুরও সমাপ্ত হয়ে গেল। বলাবাহুল্য, এতগুলো খেজুর খাওয়ার পর স্থির থাকা কঠিন ব্যাপার। এ ঘটনায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ পীড়ায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন। (তাহযিবুত তাহযিব)
মৃত্যুকালে তাঁর বয়েস হয়েছিল মাত্র ৫৭ বছর। ২৬১ হিজরির রজব মাসে নিশাপুরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। আজও মানুষ ভক্তি সহকারে তাঁর কবর জিয়ারত করে।
সবুজদেশ/এসইউ