সবুজদেশ ডেক্সঃ শেষ কবে রাজধানীর রাস্তায় স্বয়ংক্রিয় সংকেতবাতি অনুসরণ করে গাড়ি চলেছে, তা ভুলতে বসেছে মানুষ। সংকেতবাতির দিকে ট্রাফিক পুলিশ কিংবা গাড়িচালক—কেউ ফিরেও তাকান না। ‘হাতের ইশারা’ পদ্ধতিতেই গাড়ি চলে আর থামে। ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের ঠেলাঠেলিতে গত ১০ বছরে স্বয়ংক্রিয় সংকেতবাতি চালু করা যায়নি।
রাজধানীর ট্রাফিক-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের সরঞ্জাম সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। পরিবহন-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতার কারণে সংকেতব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। তাঁরা বলছেন, একটি শহরের ট্রাফিক-ব্যবস্থা বছরের পর বছর হাতের ইশরায়ায় চলতে পারে না।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর রাজধানীর রাস্তায় সংকেতব্যবস্থা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণপদ্ধতির বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের ট্রাফিক-ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে একটি কমিটি করে সরকার। এই কমিটি গত ২৭ আগস্ট প্রথম সভা করে। এতে সিদ্ধান্ত হয়, সিটি করপোরেশন ১৫ সেপ্টেম্বরের (গত শনিবার) মধ্যে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশকে স্থানান্তর করবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা পুলিশের কাছে স্থানান্তরে সিটি করপোরেশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সংকেতবাতির অধিকাংশ নষ্ট। সংকেতব্যবস্থা শতভাগ সচল না হলে পুলিশ তা নিজেদের দায়িত্বে নিতে আগ্রহী না।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যবস্থাপনা, লোকবল—সব সিটি করপোরেশনের। হাতের ইশারার বদলে পুলিশ এসব বাতির ওপর নির্ভরশীল হতে চায়। কিন্তু হুট করে পুলিশের কাছে তা হস্তান্তর করলে হবে না। তিনি বলেন, রাজধানীর সংকেতবাতিগুলো সার্বক্ষণিক সচল রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। স্বয়ংক্রিয় বাতি এক দিন চলে তো পরের দিন বন্ধ থাকে।
তবে সংকেতব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে একটি কারিগরি বিভাগ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। এই বিভাগের জনবলকাঠামো নিয়ে একটি প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই বিভাগের মাধ্যমে পুলিশ সব ট্রাফিক সংকেতবাতির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে।
গত ১৮ বছরে রাজধানীর ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থার উন্নয়নে তিনটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ৭০টি জায়গায় আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানোর কাজ শুরু হয়। এটি শেষ হয় ২০০৮ সালে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহৃত না হওয়ায় অল্প দিনেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১০-১১ অর্থবছরে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস)’ নামে আরেকটি প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সরঞ্জাম কেনা হয়। এর আওতায় ৯২টি মোড় বা ইন্টারসেকশনে সোলার প্যানেল, টাইমার কাউন্টডাউন, কন্ট্রোলার ও কেব্ল স্থাপন করা হয়। এটিও এখন অকার্যকর।
অবশ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাধায়ক প্রকৌশলী ও কেইস প্রকল্পের পরিচালক শিহাবুল্লাহ দাবি করেন, সংকেতবাতির অধিকাংশ ঠিক আছে। সরকার চাইলে যেকোনো সময় সংকেতবাতি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
ট্রাফিক সিগন্যাল কীভাবে চলছে, তা দেখতে গত তিন দিন রাজধানীর মিরপুরের টেকনিক্যাল মোড়, কলেজ গেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, শাহবাগ, ফার্মগেট, আসাদগেট এলাকা ঘোরেন এই প্রতিবেদক। এসব এলাকার সড়কে থাকা বেশির ভাগ সংকেতবাতি জ্বলে না। আবার কিছু এলাকায় সংকেতবাতি ভাঙা ছিল।
গত শনিবার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্য যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের সামনে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। পাশে লাগানো স্বয়ংক্রিয় টাইমারটিও অকেজো। সেখানে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশের সদস্য শফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেষ কবে বাতিতে গাড়ি থেমেছে মনে নাই।’
ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানীতে সর্বশেষ স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৫ মে। কাকলি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে এসব সংকেতবাতি বসানো হয়। কিন্তু যানজট সামাল দিতে না পেরে চালুর তিন-চার দিনের মাথায় পুলিশ হাত ও বাঁশির ব্যবস্থায় ফিরে যায়। এরপর আর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ট্রাফিক-ব্যবস্থার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণে গঠিত কমিটি সূত্রে জানা যায়, ট্রাফিকের কারিগরি ইউনিটে জনবল নিয়োগ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের অনিষ্পন্ন প্রস্তাবটির সব সিদ্ধান্ত সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালককে (প্রশাসন)।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাফিক সংকেত পদ্ধতি নিয়ে অনেক পাগলামি হয়েছে। সিটি করপোরেশন বাতিগুলো চালু রাখেনি। পুলিশ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, তাই সংকেতব্যবস্থার দায়িত্ব পুলিশ নিলেই ভালো।