ঢাকা ০৪:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামে কুরবানীর বিধান

Reporter Name

ফারুক নোমানীঃ

ইসলামের অন্যতম একটি ইবাদত কুরবানী। সক্ষম ব্যক্তির ওপর আল্লাহ কুরবানীকে আবশ্যক করেছেন। কুরবানীতে রয়েছে সকল মানুষের জন্য উপকার। ধনীরা নিজেদের অর্থ দিয়ে পশু কিনে তার গোস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেন গবীরদের ভেতরে। এতে ধনীদের যেমন ত্যাগ ও বিসর্জনের দীক্ষা রয়েছে, তেমনি রয়েছে গরীবদের খাবারেরও ব্যবস্থা। মাঝখানে দেশের পশু খামারী ও ব্যবসায়ীদের জন্যও রয়েছে হালাল জীবিকার উপকরণ। কুরবানীর দানকৃত চামদা থেকে আসে এতিমখানার দুঃস্থ ও এতিম বাচ্চাদের খাবার ও লেখাপড়ার একটি খরচ। সাথে সাথে দেশের চামড়া শিল্পে যোগ্য তত্ত¡াবধান ও পৃষ্ঠপোষকাতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল বৈদেশিক মূদ্রাও অর্জন হওয়া সম্ভব। সর্বোপরি আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজের মনোবৃত্তিকে বিসর্জন দেয়ার এক অনন্য শিক্ষা রয়েছে কুরবানীতে।

কুরবানী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-‘অতএব আপনি আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন ও কুরবানী করুন।’ (সূরা কাউসার ২)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই।’ (সূরা হজ ৩৭)

কুরবানী সম্পর্কে নবীজী সা. ইরশাদ করেন- ‘কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। জবাইয়ের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও।’ (তিরমিযী ১৫৬৭, ইবনে মাজাহ ৩১২৬)

কুরবানীর সক্ষমতার পরও যে কুরবানী করলো না, তার ব্যাপারে আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসে আছে- নবীজী সা. বলেছেন-‘যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম ৩৫১৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫)

কার ওপর কুরবানী ওয়াজিব?
মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম, তখন আমি শুনলাম তিনি বলছেন- ‘হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রত্যেক বছর কুরবানী আবশ্যক।’ (জামে তিরমিযী ১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ ২৭৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২৪৭৮৬)

তবে যেই ঘরে নেসাবের মালিক একাধিক ব্যক্তি থাকে, সেই ঘরে প্রত্যেক নেসাবওয়ালাকে কুরবানী করতে হবে।

এই হাদীসের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যদি আমরা যাই, তাহলে বলবো- প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)
বর্তমান বাজার অনুপাতে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার দাম ৪৯০০০/ (উনপঞ্চাশ হাজার) টাকা। তাই এই পরিমাণ নগদ টাকা বা এ মূল্যের ব্যবসায়িক মাল, সোনা, রূপা কুরবানীর তিনদিনের মধ্যে কারো মালিকানায় আসে, তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।

করোনার কারণে কুরবানী করতে না পারলে করণীয়:
করোনা প্রদুর্ভাবের কারণে অনেক মানুষ ঘরে আটকা পড়ে আছেন। অর্থবিত্ত থাকার পরও কোয়ারান্টাইনে থাকার কারণে বের হতে পারছেন না, তাদের জন্য করণীয় হলো তারা অন্য কারো মাধ্যমে কুরবানী করাবেন।

তবে এরপরও কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারেন তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করা হয়ে থাকে, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবেন। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫)

কুরবানী করা যাবে কোন কোন পশুতে?
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)

কত বয়স হতে হবে কুরবানীর পশুর?
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘তোমরা কুরবানীতে ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছ’মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে।’ (মুছিন্না হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু, মহিষ এবং ১ বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা -শরহুন নববী)। (সহীহ মুসলিম ১৯৬৩; সুনানে আবু দাউদ ২৭৯৭; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৭৯)

তাই উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬

অংশীদারিতে কুরবানী:
উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোন অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ- যেমন, দেড় ভাগ, আড়াই ভাগ, সাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

এ সম্পর্কে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন- আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন, যেন আমরা প্রতিটি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮)

অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- ‘একটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে (কুরবানী করা হবে)।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান ৪০০৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা ২৯০১; জামে তিরমিযী ৯০৪; সুনানে আবু দাউদ ২৮০৮)

অসুস্থ ও ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী:
বারা ইবনে আযিব রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সা. হাত দিয়ে ইশারা করেছেন -আমার হাত তাঁর হাত থেকে ছোট- তিনি ইশারা করে বলছিলেন, ‘চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না; যে পশুর চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ন, যে পশু সম্পূর্ণ খোঁড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৯১৯; জামে তিরমিযী ১৪৯৭; সুনানে আবু দাউদ ২৮০২; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৮২)

অন্য এক হাদীসে আছে, আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানীর পশুর) চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি। (জামে তিরমিযী ১৪৯৮; সুনানে আবু দাউদ ২৮০৪; সুনানে নাসায়ী ৪৩৭৩; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৮০)

আরেকটি হাদীসে আছে, আলী রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে শিং ভাঙ্গা এবং কান কাটা পশু দ্বারা কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। (জামে তিরমিযী ১৫০৪; সুনানে আবু দাউদ ২৮০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৮৩)

মোটকথা: এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (আলমগীরী ৫/২৯৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪)

গরু-ছাগলের অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কুরবানী সহীহ। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে না পারে তবে ঐ পশু কুরবানী করা যাবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫; ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৯৮)

যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙ্গার কারণে মস্তিষ্কে যদি আঘাত না পৌঁছে তাহলে সেই পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয। তাই যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি, সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। (সুনানে আবু দাউদ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪; আলমগীরী ৫/২৯৭)
যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। (ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫২; আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮)

মূলত কুরবানীর ক্ষেত্রে ভালো পশুটাই নির্বাচন করা আল্লাহার ভালোবাসার দাবী। আর আল্লাহর জন্য যা উৎসর্গ কার হবে তা উত্তম হতে হবে মর্মে কুরআনের আয়াতও রয়েছে। আল্লাহ বলেন-‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের স্তরে উপনীত হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (আলে ইমরান ৯২)

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী:
মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫; ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; কাযীখান ৩/৩৫২)

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

About Author Information
আপডেট সময় : ০৮:৪৮:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জুলাই ২০২০
৬৬৭ Time View

ইসলামে কুরবানীর বিধান

আপডেট সময় : ০৮:৪৮:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জুলাই ২০২০

ফারুক নোমানীঃ

ইসলামের অন্যতম একটি ইবাদত কুরবানী। সক্ষম ব্যক্তির ওপর আল্লাহ কুরবানীকে আবশ্যক করেছেন। কুরবানীতে রয়েছে সকল মানুষের জন্য উপকার। ধনীরা নিজেদের অর্থ দিয়ে পশু কিনে তার গোস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেন গবীরদের ভেতরে। এতে ধনীদের যেমন ত্যাগ ও বিসর্জনের দীক্ষা রয়েছে, তেমনি রয়েছে গরীবদের খাবারেরও ব্যবস্থা। মাঝখানে দেশের পশু খামারী ও ব্যবসায়ীদের জন্যও রয়েছে হালাল জীবিকার উপকরণ। কুরবানীর দানকৃত চামদা থেকে আসে এতিমখানার দুঃস্থ ও এতিম বাচ্চাদের খাবার ও লেখাপড়ার একটি খরচ। সাথে সাথে দেশের চামড়া শিল্পে যোগ্য তত্ত¡াবধান ও পৃষ্ঠপোষকাতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল বৈদেশিক মূদ্রাও অর্জন হওয়া সম্ভব। সর্বোপরি আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজের মনোবৃত্তিকে বিসর্জন দেয়ার এক অনন্য শিক্ষা রয়েছে কুরবানীতে।

কুরবানী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-‘অতএব আপনি আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন ও কুরবানী করুন।’ (সূরা কাউসার ২)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই।’ (সূরা হজ ৩৭)

কুরবানী সম্পর্কে নবীজী সা. ইরশাদ করেন- ‘কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। জবাইয়ের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও।’ (তিরমিযী ১৫৬৭, ইবনে মাজাহ ৩১২৬)

কুরবানীর সক্ষমতার পরও যে কুরবানী করলো না, তার ব্যাপারে আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসে আছে- নবীজী সা. বলেছেন-‘যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম ৩৫১৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫)

কার ওপর কুরবানী ওয়াজিব?
মিখনাফ ইবনে সুলাইম রা. বলেন-আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে আরাফায় অবস্থান করছিলাম, তখন আমি শুনলাম তিনি বলছেন- ‘হে লোকসকল! প্রত্যেক ঘরওয়ালার উপর প্রত্যেক বছর কুরবানী আবশ্যক।’ (জামে তিরমিযী ১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ ২৭৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২৪৭৮৬)

তবে যেই ঘরে নেসাবের মালিক একাধিক ব্যক্তি থাকে, সেই ঘরে প্রত্যেক নেসাবওয়ালাকে কুরবানী করতে হবে।

এই হাদীসের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যদি আমরা যাই, তাহলে বলবো- প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)
বর্তমান বাজার অনুপাতে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার দাম ৪৯০০০/ (উনপঞ্চাশ হাজার) টাকা। তাই এই পরিমাণ নগদ টাকা বা এ মূল্যের ব্যবসায়িক মাল, সোনা, রূপা কুরবানীর তিনদিনের মধ্যে কারো মালিকানায় আসে, তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।

করোনার কারণে কুরবানী করতে না পারলে করণীয়:
করোনা প্রদুর্ভাবের কারণে অনেক মানুষ ঘরে আটকা পড়ে আছেন। অর্থবিত্ত থাকার পরও কোয়ারান্টাইনে থাকার কারণে বের হতে পারছেন না, তাদের জন্য করণীয় হলো তারা অন্য কারো মাধ্যমে কুরবানী করাবেন।

তবে এরপরও কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারেন তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করা হয়ে থাকে, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবেন। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫)

কুরবানী করা যাবে কোন কোন পশুতে?
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)

কত বয়স হতে হবে কুরবানীর পশুর?
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘তোমরা কুরবানীতে ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছ’মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে।’ (মুছিন্না হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু, মহিষ এবং ১ বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা -শরহুন নববী)। (সহীহ মুসলিম ১৯৬৩; সুনানে আবু দাউদ ২৭৯৭; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৭৯)

তাই উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬

অংশীদারিতে কুরবানী:
উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোন অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ- যেমন, দেড় ভাগ, আড়াই ভাগ, সাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

এ সম্পর্কে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন- আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন, যেন আমরা প্রতিটি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮)

অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- ‘একটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে (কুরবানী করা হবে)।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান ৪০০৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা ২৯০১; জামে তিরমিযী ৯০৪; সুনানে আবু দাউদ ২৮০৮)

অসুস্থ ও ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী:
বারা ইবনে আযিব রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সা. হাত দিয়ে ইশারা করেছেন -আমার হাত তাঁর হাত থেকে ছোট- তিনি ইশারা করে বলছিলেন, ‘চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না; যে পশুর চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ন, যে পশু সম্পূর্ণ খোঁড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৯১৯; জামে তিরমিযী ১৪৯৭; সুনানে আবু দাউদ ২৮০২; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৮২)

অন্য এক হাদীসে আছে, আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানীর পশুর) চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি। (জামে তিরমিযী ১৪৯৮; সুনানে আবু দাউদ ২৮০৪; সুনানে নাসায়ী ৪৩৭৩; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৮০)

আরেকটি হাদীসে আছে, আলী রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে শিং ভাঙ্গা এবং কান কাটা পশু দ্বারা কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। (জামে তিরমিযী ১৫০৪; সুনানে আবু দাউদ ২৮০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৮৩)

মোটকথা: এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (আলমগীরী ৫/২৯৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪)

গরু-ছাগলের অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কুরবানী সহীহ। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে না পারে তবে ঐ পশু কুরবানী করা যাবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫; ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৯৮)

যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙ্গার কারণে মস্তিষ্কে যদি আঘাত না পৌঁছে তাহলে সেই পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয। তাই যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি, সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। (সুনানে আবু দাউদ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪; আলমগীরী ৫/২৯৭)
যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। (ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫২; আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮)

মূলত কুরবানীর ক্ষেত্রে ভালো পশুটাই নির্বাচন করা আল্লাহার ভালোবাসার দাবী। আর আল্লাহর জন্য যা উৎসর্গ কার হবে তা উত্তম হতে হবে মর্মে কুরআনের আয়াতও রয়েছে। আল্লাহ বলেন-‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের স্তরে উপনীত হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (আলে ইমরান ৯২)

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী:
মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫; ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; কাযীখান ৩/৩৫২)

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।