রাজধানীর গুলশানে সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার আবদুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে পাকা ভবন তৈরি করা হচ্ছে। প্রায় তিন মাস আগে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। কয়েকদিন আগে দেওয়া হয়েছে ছাদ ঢালাই।
সোমবার (২৮ জুলাই) রিয়াদের গ্রামে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন ছাত্রের বাড়িতে হঠাৎ পাকা ভবন নির্মাণ নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা চলছে। এতে নতুন মাত্রা পেয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগে তার গ্রেপ্তারের ঘটনা।
তবে রিয়াদের পরিবারের দাবি, বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ, জমানো টাকা এবং ধারদেনা করে ঘর তুলছেন তারা। এখানে রিয়াদ কোনো টাকা দেয়নি।
আবু রায়হান ও রিজিয়া বেগম দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট রিয়াদ। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে। সেখানেই পাকা ভবন তোলা হচ্ছে। রিয়াদের বাবা এক সময় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে, এখন আর চালান না।
নবীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ঘিঞ্জি পরিবেশে কয়েকটা জরাজীর্ণ ঘর। সবগুলো রিয়াদের চাচা ও ফুফুদের। কারোরই পাকা ঘর নেই। রিয়াদের চাচারা কেউ রিকশা চালিয়ে বা কেউ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ফুফুরা সবাই গৃহিণী। তাদের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো না। এর মাঝে শুধু রিয়াদদের ভিটায় তৈরি হচ্ছে একটি পাকা ভবন। এতে চার-পাঁচটি কক্ষ আছে। এর আগে, রিয়াদদের ঘরও তাদের মতোই ছিল।
স্থানীয়রা জানান, রিয়াদকে এলাকায় সবাই নম্র-ভদ্র হিসেবে জানে। তিনি যখন ঢাকায় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন, তখন এলাকার মানুষ তাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর যেন রিয়াদের ভাগ্য বদলে যায়। তার এমন অর্থনৈতিক উত্থানে বিস্মিত সবাই।
রিয়াদের চাচা জসীম উদ্দিন বলেন, ‘‘প্রায় তিন মাস আগে রিয়াদ পাকা ভবন নির্মাণের কাজে হাত দেয়। আগে ভাঙাচোরা একটি টিনের ঘর ছিল। ওই ঘরের জায়গায় নতুন ভবন করা হচ্ছে। রিয়াদের মা-বাবা এখন বাড়ির প্রবেশপথের পাশের একটি কক্ষ ভাড়া করে থাকেন।’’
রিয়াদের এক চাচি বলেন, ‘‘রিয়াদের বাবা ও বড় ভাই দুজনই রিকশা চালাত। এক বছর ধরে আরা চালায় না। রিয়াদ ঢাকায় পড়ালেখা করে। তবে, কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ে, তা জানি না। শুনেছি, সে সমন্বয়ক হয়েছে। এর পরেই যেন তার ভাগ্য বদলে গেছে।’’
নবীপুর গ্রামের বাসিন্দা জোবায়ের হোসেন বলেন, ‘‘আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, রিয়াদ ঢাকার প্রেসিডেন্সি নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে, কোন ডিপার্টমেন্টে তা জানি না। সে এমনিতে ভদ্র ছেলে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সে নিজেকে সমন্বয়ক হিসেবে জাহির করে বলে জানতে পারি। বছর না ঘুরতেই বাড়িতে পাকা ভবন নির্মাণ করছে। এসব নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা চলছে।’’
সোহেল নামের আরেকজন বলেন, ‘‘শুনেছি, রিয়াদ নাকি বেশ টাকার মালিক হয়েছে। বাড়িতে পাকা ভবন করছে, দামি বাইক কিনেছে। গুলশানেও তার ফ্ল্যাট আছে। এবার ১ লাখ টাকার গরু কোরবানি দিয়েছে। কীভাবে সম্ভব?’’
রবিউল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, ‘‘রিয়াদকে ছোট থেকেই চিনি। তার পরিবারের সবার আয়-রোজগার সম্পর্কে জানি। হঠাৎ রিয়াদ এত টাকা কোথায় পেল?’’
রিয়াদের মা রেজিয়া বেগম বলেন, ‘‘আমার চার সন্তান। বড় ছেলে ফুটপাতে ব্যবসা করে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আর ছোট ছেলে রিয়াদ ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাকে আমার স্বামীর টাকা ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করি। এরপর আমরা যতটুকু পেরেছি টাকা-পয়সা দিয়েছি, বাকিটা সে টিউশনি করে জোগাড় করত।’’
বাড়িতে পাকা ভবন নির্মাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ, স্বামীর জমানো টাকা ও ধারদেনা করে বাড়ি করছি।’’
কোন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এমনকি ঋণ নিয়েছেন, সে-সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্টও দেখাতে পারেননি রেজিয়া বেগম।
আবদুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত ফেব্রুয়ারিতে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছিল, সেই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছিল রাজ্জাককে। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে ছাত্রসংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। রাজ্জাক এই ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাজ্জাককে দল থেকে বহিষ্কার করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ।
গত শনিবার চাঁদাবাজির অভিযোগে রিয়াদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন (মুন্না) এবং সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারা দেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সবুজদেশ/এসএএস