ওবায়দুল কাদের সত্যিই স্বাগত জানালেন?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ধন্যবাদ। কারণ, তিনি গণফোরাম আর যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের ধারণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। যদি তিনি একে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখতেন, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক হতো। এখন তবু তিনি ‘শুভকামনা’ জানিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত এই জোট টেকে কি না।
তবে জনগণ আশা করতে পারে, এই জোট টিকে থাক। কারণ, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে। এর প্রমাণ হলো তারা নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। নৌকার পক্ষে জনমত গড়তে নানা চেষ্টা চালাচ্ছে।
সুতরাং বিরোধীদলীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানানোর ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিশেষ করে যাঁরা পুলিশে আছেন, তাঁরা এখন একটি দীক্ষা নেবেন। তাঁরা বিবেচনায় নেবেন, দেশে নির্বাচন আসছে। আগে যেভাবে সরকারের সমালোচনা হতো, তার চেয়ে এখন বেশি হবে। আগে যা জনসভা হতো, তার থেকে বেশি হবে। সেখানে যুক্তিসংগত বা কখনো ত্রুটিবিচ্যুতিপূর্ণভাবে, কখনো যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য দিয়ে বলা হবে, এই সরকার নানা কারণ ব্যর্থ হয়েছে, তাই এই সরকার চাই না।
এমনকি জনসভায় এই কথাও বলা হতে পারে: ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীরা তাঁদের সাফল্যের পক্ষে যা যা বলছেন, তা অসত্য নয়। এমনকি মহাসত্য। আমরা তাঁদের দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের (বর্তমান লেখক বিশ্বাস করেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের মতো কিছু বিষয়ে সরকারের সাফল্য অসাধারণ) জন্য অভিনন্দন জানাই। তারপরও অনেকে বলবেন, ‘আপনাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা একাধিকক্রমে তৃতীয় মেয়াদে কোনো সরকারকে ভোট দেবেন না। এখন আপনারা পরিবর্তন আনুন।’ সুতরাং কোনো কারণ ছাড়াই একজন নাগরিক সরকারের পরিবর্তন কামনা করতে পারেন। কারণ, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। যোগ্যতর লোককে ভোট থেকে বঞ্চিত করাও আমার নাগরিক অধিকার।
গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা ক্ষমতাসীন দলকে সবচেয়ে বেশি মনে রাখতে হবে। যে হয়তো সত্যিই বেশি অযোগ্য কিংবা বিপজ্জনক, মানুষ হয়তো তাকেই ভোট দিতে পারে।
এখন শিশু ও পাগলেও অবিশ্বাস করবে না যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবর্তে হিলারি ক্লিনটন জয়ী হলে আমেরিকার ভালো হতো। কিন্তু গণতন্ত্রই সেরা। কারণ, ট্রাম্প সাহেবের জবাবদিহি একরকম উঠতে-বসতে উশুল হচ্ছে এবং অব্যাহত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই তাঁকে একদিন পথে বসাবে।
দেশের কথায় ফিরি। ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে, যদি দলটি আমাদের আশ্বস্ত করে যে তারা শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা জরুরি মনে করে। সংসদীয় গণতন্ত্র বিরোধী দল ছাড়া অচল। অচল গণতন্ত্রে বাঁচা কাঁহাতক। ব্রিটেনে রওশন এরশাদের মতো অপোজিশনকে হার মাজেস্টির লয়্যাল অপোজিশন বলে না। রওশনের অপোজিশন ফেক অপোজিশন।
আমরা লক্ষ করি, আওয়ামী লীগ বাক্স্বাধীনতার নামে সর্বদা প্রতিপক্ষকে আঘাত দিয়ে চলতেই যেন বেশি পছন্দ করছে। এটা এখন তারা সহজে বাদ দিতে পারে। তারা বরং ঘন ঘন বলতে পারে যে তারা ভিন্নমত আশা করে। অতীতের সামরিক শাসকেরা ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ আশা করতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে কাজেকর্মে দেখাতে হবে, তারা সেটা আশা করে না। কারণ, ভিন্নমত কখন কেমন হবে, তা কমান্ড দিয়ে হবে না। সমালোচনা ভুল হতে পারে, অন্যায্য হতে পারে, কিন্তু সরকার তাতে সাধারণভাবে অসহিষ্ণু মনোভাব দেখাবে না। নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা দেখতে চাই, সরকারি দল ও জনপ্রশাসন তার কথাবার্তায় পরিবর্তন আনছে।
বিশেষ করে আমরা ওবায়দুল কাদেরের মতো শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বাক্স্বাধীনতার অনুশীলনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী।
গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনায় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচন এলে নতুন নতুন মেরুকরণ হয়। নতুন নতুন ঐক্য হবে, এটাই স্বাভাবিক। যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম যে ঐক্য গড়েছে, তা ইতিবাচক বিষয়।’ তিনি এখানেই থামলে ভালো করতেন। নির্বাচন পর্যন্ত টেকে কি না, সে বিষয়ে খোলাখুলি সংশয় প্রকাশ করেছেন। তবে বলেই যখন ফেলেছেন, তখন আমরা জানতে চাই, এই জোটের নির্বাচন পর্যন্ত টিকে থাকাটাকে তিনি গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য মঙ্গলজনক মনে করেন কি না।
তবে তাঁর উদ্বেগের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন যখন তিনি বলেন, ‘নতুন জোট করে আন্দোলনের নামে কেউ যদি ২০১৪ সালের মতো আগুন-সন্ত্রাসের পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহলে জনগণ কঠোরভাবে প্রতিরোধ করবে।’ ওই নিন্দনীয় চরমপন্থার পর্বটি বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে আছে। কিন্তু যারা ঘটাল, তাদের কতজন ‘দোষী সাব্যস্ত’ হয়ে জেলের ঘানি টানছে, তা জানা হলো না। এই তথ্য আমরা জানতে চাই। অনুমান করি, পুলিশ এসবের তদন্তে অগ্রগতি কম করতে পেরেছে।
নির্বাচন এলে অনেক পেশাজীবীর সুদিন আসে। যেমন ছাপাখানার লোকেরা পোস্টার ছাপানোর উৎসবে মেতে উঠবে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে ভাবব এখন আমরা আরও দৃঢ়তায় সমালোচনামূলক মন্তব্য করতে পারব।
জনাব কাদেরের মতে, ইভিএম বিশ্বে ‘প্রশংসিত’। গণতান্ত্রিক বা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর কী কী ‘প্রশংসিত’, তার একটি তালিকা প্রকাশ করার দাবি তোলা কি অসমীচীন হবে?
ব্রিটেনের ইতিহাসে কবে, কখন সংসদ বহাল রেখে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, তা জানতে গবেষণা দরকার হবে। স্মরণকালের ইতিহাসে কোনো নজির নেই। ভারতের ৭০ বছরের ইতিহাসে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কখনো লোকসভা না ভেঙে নির্বাচন হয়নি। তাই সংসদ ভেঙে নির্বাচন দেওয়া হলে তা প্রশংসিত সিদ্ধান্ত হবে।
জনাব কাদের সম্প্রতি বিশিষ্ট বাম নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। সমমনা বাম দলগুলোকে নিয়ে জনাব সেলিম একটি নির্বাচনী মোর্চা করেছেন। তারাও মনে করে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। স্বাভাবিক মিত্র গণ্য না করলে সেলিমের শরণ তিনি নিতেন না। কিন্তু সেলিম গত বুধবার সাফ বলেছেন, নির্বাচনী তফসিলের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এখন কি আমরা এটুকু আশা করতে পারি যে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ মেনে সরকার পদত্যাগ করবে না, কিন্তু সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে।
একটি সাধারণ নির্বাচন করা হবে। কিন্তু বিরোধী দলের তরফের কোনো অভিপ্রায় মানা হবে না, এটা কি বিশ্বে প্রশংসিত হবে? ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী—এই দুটি পদে এক ব্যক্তির থাকা বিশ্বে প্রশংসিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশে দুই বড় দলকে কে আটকাচ্ছে?
ওবায়দুল কাদের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের দুদিন পরে বলেছিলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন মিস করে বিএনপি যে বোকামি করেছে, অচিরেই সেটা টের পাবে।’ এখন আমরা শুনছি, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির নয়, বিএনপির একাংশের অংশগ্রহণ আশা করছে। সুতরাং ‘যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম যে ঐক্য গড়েছে, তা ইতিবাচক বিষয়’ হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের গণ্য করাটাকে আমরা ঠিক ভরসা করতে পারি না। কারণ, কিছুদিন আগেই যাঁরা ঐক্য করেছেন, তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ করার ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত বলে অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়নি।
সরকারের সমালোচনা করা এবং সরকারের পরিবর্তন চাওয়া যে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সেটা যে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে, আমাদের তা বিশ্বাস করতে দিন।