ভারতে সংশোধিত ওয়াকফ আইনে উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবাংলায় বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।
বিশেষ করে অশান্ত হয়ে উঠেছিল রাজ্যটির মুর্শিদাবাদ জেলা। সব মিলিয়ে এখনও বাংলাজুড়ে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। সবর্ত্রই বিভাজনের রাজনীতির হাতছানি। আর সেই পরিস্থিতির জন্য সরাসরি বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে (আরএসএস) দায়ী করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে রাজ্যবাসীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী, যা নজিরবিহিন। কারণ ১৫ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রীর পদে থেকে এটাই তার প্রথম খোলা চিঠি। সেই চিঠিতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, বিজেপি ও তাদের সঙ্গীরা পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ করে খুব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। এই সঙ্গীদের মধ্যে আরএসএস’ও আছে।
মুখ্যমন্ত্রী চিঠিতে বলেছেন, ‘আমি এর আগে আরএসএসের নাম নিইনি, কিন্তু এবার বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে যে, রাজ্যে যে কুশ্রী মিথ্যার প্রচার চলছে তার মূলে তারাও রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে ডিভাইড অ্যান্ড রুলের খেলা খেলতে চাইছে বিজেপি এবং আরএসএস। এ খেলা বিপজ্জনক।
চার পাতার খোলা চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, বাংলায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিভাজনের রাজনীতির কৌশল নিয়েছে বিজেপি। প্রথমে ঠিক করেছিল রাম নবমীকে (শ্রীরামের জন্মতিথি) কেন্দ্র করে অশান্তি পাকাবে। কিন্তু রাম নবমী শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। তাই এবার ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু বিষয়কে ব্যবহার করতে চাইছে।
ভারতের বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যের নাম নিয়ে মমতা লিখেছেন, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান—এসব রাজ্যে তো প্রতিবাদ, মিছিল করতেই দেওয়া হয় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো এমন সংবিধানবিরোধী ব্যবস্থার কায়েম নেই।
এর পরই উত্তরপ্রদেশকে আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, উত্তরপ্রদেশে ওরা বুলডোজার চালায়, জন্ম হয় যন্ত্রণার। বিপরীতে আমাদের দেখুন, যে কেউ যখন উৎপীড়িত বোধ করেন, আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই।
মমতা দেশ ও রাজ্যকে ভালোবাসা জানিয়ে লিখেছেন, আমার আবেদন হলো, দয়া করে ধীর ও শান্ত থাকুন। আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নিন্দা করি এবং তাদের রুখবই। দাঙ্গার পেছনে যে দুর্বৃত্তরা আছে, তাদের কড়া হাতে দমন করা হচ্ছে। কিন্তু, সেই সঙ্গে পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণও আমাদের এড়িতে চলতে হবে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, পরস্পরের ব্যাপারে সহমর্মী ও যত্নশীল হতে হবে।
চিঠির শেষে শান্তির আবেদন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ধীর থাকুন, শান্ত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন। মিথ্যা সাম্প্রদায়িক প্রচারে বিপথগামী হবেন না। আসুন আমরা মিলেমিশে একজোট হয়ে থাকি এবং ওদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়ি। ওদের গুন্ডামি ও মিথ্যার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগের জবাব আরএসএস এখনও দেয়নি। তবে বিজেপি নেতা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পুরো চিঠির ছত্রে ছত্রে বিভাজনের রাজনীতি। উস্কানি প্রথম কে দিয়েছিল?
পাল্টা অভিযোগ করে জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের নামে সমাজের একটা অংশকে আগুন নিয়ে খেলতে দিয়েছে তৃণমূল সরকারই। মুর্শিদাবাদে হিন্দুরা সে কারণেই বিপন্ন হয়েছে। রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় শেষমেশ কেন্দ্রীয় বাহিনী নামাতে হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী এবং সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও। দুজনেরই বক্তব্য, বাংলায় আরএসএস এবং বিজেপিকে কে জায়গা করে দিয়েছিল। ঢুকিয়েছেন তো মমতাই। যে বিপজ্জনক খেলার কথা উনি বলছেন, তার বীজ বপন করেছেন উনি নিজেই।
প্রসঙ্গত, একটানা ১৫ বছর সরকারে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তার কিছুটা আঁচ দেখা গিয়েছিল আরজি কর আন্দোলনের সময়ে। এর ওপর তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণ। তার ওপর বছর শেষ হলেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যতে কোনদিকে মোড় নেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
সার্বিক এই পরিস্থিতিতে মেরুকরণ ঠেকিয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে রাখতে চেষ্টা করছে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক ক্ষমতাসীন দল সিপিআইএমও। রোববার তাদের ব্রিগেডে সভা রয়েছে। এর পাশাপাশি আগামী ২৬ এপ্রিল সংশোধিত ওয়াকফ আইন বাতিলের দাবিতে ব্রিগেডে প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ। যদিও মুসলিমদের এসব করতে বারণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নতুন ওয়াকফ আইন চালু হবে না। তাই শান্তি বজায় রাখুন।
তারপরও মুখ্যমন্ত্রী কথা উপেক্ষা করে এক হচ্ছে মুসলিম সমাজ। আর এই আবহে, দীর্ঘ ১৫ বছরের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে প্রথম খোলা চিঠি লিখেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
সবুজদেশ/এসইউ