তিন লাখ টাকা না দেয়ায় ওসির রুমে যুবককে হত্যা!
সবুজদেশ ডেস্কঃ
তিন লাখ টাকা না দেয়াতেই বরগুনার আমতলী থানায় হত্যা মামলার সন্দেহভাজন শানু হাওলাদারকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
পরিবারের অভিযোগ, থানার ওসি আবুল বাশার ও পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির দাবিকৃত তিন লাখ টাকা না দেয়ায় শানুকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
এ ঘটনায় আমতলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
জানা গেছে, উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কলাগাছিয়া গ্রামে গত বছর ৩ নভেম্বরে ইব্রাহিম নামের একজন কৃষককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যা মামলায় শানু হাওলাদারের সৎ ভাই মিজানুর রহমান হাওলাদার এজাহারভুক্ত আসামি। ওই মামলায় শানু হাওলাদারকে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আমতলী থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, শানুকে আটকের তার পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন আমতলী থানার ওসি আবুল বাশার ও পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি। টাকা না পেয়ে শানু হাওলাদারকে থানা হাজতে রেখে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে। পরে নিহতের ছেলে সাকিব হোসেন মঙ্গলবার ওসি আবুল বাশারকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে আসে। কিন্তু তাতে তিনি তুষ্ট হননি।
বুধবার পরিবারের লোকজন শানু হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি।
এদিকে ওসি আবুল বাশার দাবি করেন, বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে শানু ওয়াস রুমে যাওয়ার কথা বললে পুলিশ তাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়। পরে এক ফাঁকে শানু হাওলাদার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
হাজতখানায় কোনো ফ্যান নেই সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি পূর্বের কথা পাল্টে বলেন, পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জনের কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
টাকা না দেয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান ওসি।
এদিকে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে পুলিশ। তারা নিহত স্বজনের পরিবার ও সংবাদ কর্মীদের থানার ভিতরে প্রবেশ করতে বাঁধা এবং থানা ফটকে তালা লাগিয়ে দেয়। পরে নিহতের স্বজনরা থানা ফটকের সামনে আহাজারি করে। আধা ঘণ্টা পরে পুলিশ ফটক খুলে দেয়।
খবর পেয়ে বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন পিপিএম আমতলী থানা আসেন। ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. তোফায়েল আহম্মেদকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বরগুনা সদর) মোঃ মহব্বত আলী ও সহকারী পুলিশ সুপার (আমতলী-তালতলী সার্কেল) সৈয়দ রবিউল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আসাদুজ্জামান ও আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শঙ্কর প্রসাদ অধিকারী নিহত শানু হাওলাদারের সুরাতহাল করেন।
এ ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার দায়ে তাৎক্ষনিক বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন আমতলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন।
নিহত শানু হাওলাদারের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য বরগুনা মর্গে প্রেরণ করেছে পুলিশ।
নিহত শানু হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন বলেন, বিনা অপরাধে আমার বাবাকে ওসি ধরে এনে তিন লাখ টাকা দাবি করেন। আমি ওসির দাবিকৃত ঘুষের টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমার বাবাকে নির্যাতন করেছে। বাবার নির্যাতন সইতে না পেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে আমি ওসিকে ১০ হাজার টাকা দিই। কিন্তু ১০ হাজার টাকায় ওসি তুষ্ট হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘বুধবার সকালে আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে থানায় আসি কিন্তু আমাকে দেখা করতে না দিয়ে ওসি আবুল বাশার ও পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়। সারা দিনে আমাকে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। ওসি বলেন টাকা নিয়ে আস তারপর দেখা করতে দেব।’
নিহত শানু হাওলাদারের শ্যালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, দুলাভাইকে ধরে আনার পর থেকে আমি থানায় প্রাঙ্গণে ছিলাম। পুলিশ তাকে টাকার জন্য বেধরক মারধর করেছে। তার চিৎকার শুনেছি। বহুবার চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু পুলিশ দেয়া করতে দেয়নি। উল্টো আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে।
নিহত শানু হাওলাদারের স্ত্রী মোসা. ঝরনা বেগম বলেন, ৫ জন পুলিশ সোমবার রাতে আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। নেয়ার সময় আমার কাছে টাকা চায়। আমি টাকা দেতে রাজি না হওয়ায় আমার স্বামীকে পুলিশে পিটিয়ে মেরেছে।
গুলিশালালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম বলেন, শানু হাওলাদারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্যাতন করেছে। আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের সাজানো।
আমতলী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান বলেন, থানার ওসি মো. আবুল বাশার টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি।
আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে শানুকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করছি।
আমতলী থানার ওসি মো. আবুল বাশার বলেন, আসামী শানু হাওলাদার বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬ টার দিকে ওয়াশ রুমে যাওয়ার জন্য বলে। সে ওয়াশ রুম থেকে ফিরে এসে এক ফাঁকে হাজতখানার ফ্যানের সাথে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শঙ্কর প্রসাদ অধিকারী বলেন, নিহত শানু হাওলাদারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছ। তবে ময়নাতদন্ত ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে না।
এ ঘটনার তদন্তকারী দলের প্রধান বরগুনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশাসন ও অপরাধ মো. তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, দায়িত্ব অবহেলার দায়ে পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই মো. আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি আরও বলেন,অপরাধী যেই হোক নিরপেক্ষ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।