করোনায় আমাদের করণীয়
ফারুক নোমানীঃ
বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে চরম আতঙ্কের নাম করোনা। করোনা ভাইরাস যেমন দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর নানা দেশে, একই সাথে বাড়ছে তাতে আক্রান্তদের পরিমাণও। মৃত্যুর তালিকাও হচ্ছে ক্রমেই দীর্ঘ। জাতীয় ও আন্তুর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রধান খবরই এখন করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জনসাধারণের ভেতর চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে এই মহামারী নিয়ে। সাথে সাথে বাঙালির ‘চিরাচরিত রীতি’ অনুপাতে করোনা নিয়েও চলছে নানা গুজব। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে নানা কথা। সমাজের প্রতিটি স্তরে এখন একটাই আলোচ্যবিষয়-করোনা। কেউ কেউ বলছে, এটা পাপী মানুষদের জন্য, ভালোদের কোন কিছুই হবে না করোনায়। তাই আক্রান্তদেরকে বড় ঘৃণার চোখে দেখছে অনেকে। প্রকৃত বিষয়টি আমরা কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে পরখ করে দেখব। সাথে সাথে মহামারীতে ইসলামে নির্দেশনা কী তাও আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
মহামারী নতুন নয়:
মহামারী পৃথিবীতে এই নতুন নয়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনপদ মহামারীতে শূন্য হয়েছে। সেই ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করা বড় কঠিন। মহামারী যেমন কোন নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না, তেমনি তা থাকে না তা কোন নির্দিষ্ট জনপদেও। বরং ছড়িয়ে পড়ে তা নানা জায়গায়, নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে। আমরা মূলত দেখব ইসলামের ইতিহাসে মহামারীর কোন দৃষ্টান্ত আছে কিনা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ও তাঁর নিকটতম যুগে তেমন মহামারী না হলেও পরবর্তীতে এর বড় বেদনাদায়ক ইতিহাস রয়েছে। মুসলিমদের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর শাসনামলে হয়েছিল ভয়াবহ মহামারী। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর ১৮ হিজরী সনে শামে ‘আমওয়াস’ নামক এক মাহামারী দেখা দিল। যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন পঁচিশ হাজার মুসলিম, অন্য বর্ণনায় ত্রিশ হাজারের কথাও উল্লেখ আছে। এমনকি বিখ্যাত সাহাবীদের অনেকেই ইন্তেকাল করেছেন এই মহামারীতে। প্রখ্যাত সাহাবী আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, মুআয ইবনু জাবাল, ইয়াযিদ ইবনু আবি সুফইয়ান, সুহাইল ইবনু আমর, যেরার ইবনুল আযওয়ার, আবু জানদাল ইবনু সাহাইল রাযিআল্লাহু আনহুম ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে যেসব ভয়াবহ মহামারী মুসলিম সভ্যতাকে বিপর্যস্ত করেছে, তন্মধ্যে সবচে’ ভয়ংকর মহামারীটি ছিল ‘তাউনে জারিফ’ বা সর্ববিধ্বংসী মহামারী। সময়টা ছিল হিজরী ৬৯ সন। মুসলিম সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বসরা শহর ছিল তখন আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়ের রা. এর শাসনাধীন। অসংখ্য সাহাবি ও তাবেয়ীনের এই শহরে হঠাৎ করেই যেন নীরব কেয়ামত নেমে এসেছিল। মাত্র চারদিনের মাথায় আক্ষরিক অর্থেই মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছিল শহরটি। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে ভয়ংকর এক মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় আড়াই লাখ মুসলিম। মাত্র চারদিন স্থায়ী হয়েছিল এ মহামারী। যার প্রথম দিনে প্রাণ হারান প্রায় সত্তর হাজার মানুষ। দ্বিতীয় দিনে মারা যান আরও একাত্তর হাজার। তৃতীয় দিনে সেই সংখ্যার সাথে যোগ হয় আরও তেহাত্তর হাজার। এভাবে চারদিনে পুরো বসরা পরিণত হয় উন্মুক্ত গোরস্থানে। এছাড়াও হিজরী ৮৭ সনে বসরাতেই হয়েছিল আরেক মহামারী। যার নাম ‘তাউনে ফাতায়াত’।
৩৯৫ হিজরীতে আফ্রিকাতে এক ব্যাপক মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপকহারে মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে কাইরাওয়ান শহরের মসজিদগুলো মুসল্লীশূন্য হয়ে পড়ে। নামাযবিহীন থাকে তা। (আল-বায়ানুল মুগরিব ১/২৫৭)
৪৪৮ হিজরীতে মিসর ও আন্দালুসে ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয়। মসজিদগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে পড়ে মহামারীতে। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৮/৩১১)
আমরা যদি মহামারী সংক্রান্ত গ্রন্থের সন্ধান করি তাহলে দেখব-ইসলামের ইতিহাসে মহামারী নিয়ে সর্বপ্রথম আলাদা গ্রন্থ রচনা করেন ইমাম ইবনু আবিদ দুনয়া, ২৮১ হিজরীতে। গ্রন্থটির নাম ‘কিতাবুত্ত¡াওয়াগীন’। এরপর ছোট বড় অসংখ্য স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হতে থাকে। তারপর ৮১৯ হিজরীর দিকে সেকালের লোকজন ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. কে এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি গ্রন্থ লিখতে অনুরোধ জানান। তিনি শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বযলুল মাউন ফী ফযলিত তাউন’ লেখা। দুঃখজনকভাবে সে বছরই এক মহামারিতে তার দুই মেয়ে ফাতেমা ও আলিয়া ইন্তেকাল করেন। ইবনে হাজার রহ. সে বছর গ্রন্থটি শেষ না করে রেখে দেন। পাÐুলিপিটি চূড়ান্ত করে প্রকাশ করেন ৮৩৩ হিজরীতে এবং সে বছরও মহামারিতে তার বড় মেয়ে জাইন খাতুন গর্ভবতী অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এতটুকু আলোচনাই আমাদের জন্য বুঝতে যথেষ্ট হবে যে, মহামারী এই সময়ের নতুন কোন ব্যাধি নয়, তা আগেও ছিল, আছে এখনও।
কেন হয় মহামারী?
প্রথমত আমরা বলতে পারি, সৃষ্টিজীবের প্রতি রোগব্যাধি যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘য়ালা যাকে চান, যখন চান, যেভাবে চান, রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। তেমনি মহামারীও একটি পরীক্ষা। কুরআনুল কারীমে তিনি বলেছেন- ‘আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আম্বিয়া :৩৫)
অন্যত্র বলেন-‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫)
সুতরাং সাওয়াবের নিয়তে যে ধৈর্যধারণ করবে, সে সাওয়াব পাবে। আল্লাহ তা‘য়ালা তার পাপরাশী মাফ করে দিবেন, মার্জনা করবেন তার অপরাধসমূহ। বৃদ্ধি করবেন তার সম্মান ও মর্যাদা। তাঁর করুণা ও অনুগ্রহ থাকবে তার সাথে।
সাহবী আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা রা.বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘মুসলিমের প্রতি যখন কোন বিপদ, কোন রোগ , কোন ভাবনা, কোন চিন্তা, কোন কষ্ট বা কোন দুঃখ পৌঁছে, এমনকি তার শরীরে কোন কাঁটা ফুটলেও তাদ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৪২, সহীহ মুসলিম ২৫৭২, তিরমিযী ২৯৯১,৩০৩৮, আহমাদ ৮০২৭)
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ যার ভালো চান তাকে বিপদগ্রস্ত করেন।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৪৫, মালেক ২৭১৩, আহমাদ ৭২৩৫ ) তাই ব্যাপকভাবে এটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা ধরে নিতে পারি আমরা।
দ্বিতীয়ত: মহামারী দ্বারা তিনি মানুষকে সতর্ক করতে চান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন-‘আমি ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই নিদর্শন প্রেরণ করি।’ (সুরা বনী ইসরাইল: ৫৯)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কাতাদা রহ. বলেন ‘আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে নিজ ইচ্ছানুযায়ী নিদর্শন পাঠিয়ে ভীতি প্রদর্শন করেন এবং সতর্ক করেন। যাতে করে তারা শিক্ষাগ্রহণ করে এবং আল্লাহর কথা স্মরণ করে। আমাদের মনে পড়ে, আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) এর সময়ে কুফা প্রকম্পিত হয়েছিল। তখন ইবনু মাসউদ (রা.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে তিরস্কার করছেন। তাই তোমরা তার কাছে তওবা করো।’ (তাফসীরে ইবনে কাসির)
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন- ‘জলে স্থলে যে বিপর্যয় তা মানুষের হাতের কামাই।’ (সূরা রোম: ৪১)
এ সকল নিদর্শন দেখে পাপীদের মনে ভয় সৃষ্টি হবে। ফলে তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে ফিরে আসবে সত্যের পথে। আর মুমিনগণ এ দেখে আল্লাহর অভিমুখী হবেন এবং অধিক ক্ষমাপ্রার্থনা ও কান্নাকাটির মাধ্যমে তাদের ঈমানকে করবেন আরো মজবুত। শুধরে নিবেন তাদের ভুলগুলো।
তৃতীয় কথা হলো, মহামারী আসে অন্যায়-অপরাধ, জুলুম-নির্যাতন, অশ্লীলতা নির্লজ্জতা ব্যাপক হলে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন- ‘হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোন জাতি ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন। (ইবনু মাজাহ ৪০১৯)
অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি এসে সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রা. কে মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তখন উসামা ইবনু যায়েদ রা. বললেন, আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘মহামারী হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে শাস্তি অথবা ধমকস্বরূপ। আল্লাহ বনী ইসরাইল একটি দলের উপর অথবা তোমাদের পূর্ববর্তী কিছু লোকের উপর এমন শাস্তি পাঠিয়ে ছিলেন। তাই যখন কোনো স্থানে মহামারীর কথা শুনতে পাবে সেখানে তোমরা যাবে না। আর যদি তা তোমাদের কাছে চলে আসে তবে তা থেকে পালিয়ে যাবে না।’ (সহীহ মুসলিম ২২১৮)
তাই সকল অন্যায় অপরাধ ও অশ্লীলতা থেকে আমাদেরকে মুক্ত হতে হবে। কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ফিরে আসতে হবে।
চতুর্থ কারণ হলো, মহামারী ছড়ানো কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন: কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর একটি হলো মহামারী। আউফ ইবনু মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, এরপর তোমাদের মধ্যে বকরির পালের মহামারীর মতো মহামারী ছড়িয়ে পড়বে। সম্পদের প্রাচুর্য হবে, এমনকি এক ব্যক্তিকে ১০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) দেওয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে। অতঃপর এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে। অতঃপর যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য।’ (সহীহ বুখারী ৩১৭৬)
এ হাদীসের সারকথা একদম স্পষ্ট যে, মহামারীটা কিয়ামতের অন্যতম আলামত।
মহামারীতে মৃত ব্যক্তি শহীদঃ
মহামারী যে কারণেই হোক না কেন, তাতে কোন ঈমানদার ব্যক্তি মারা গেলে হাদীসে তাকে শহীদ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত মুমিন ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামি মনে করা যাবে না। এ সম্পর্কেই আছে আবু হুরায়রা রা. হতে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ: মহামারীতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো। (সহীহ বুখারী ২৬৩০)
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত অন্য আরেকটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘মহামারীর কারণে মারা যাওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত।’ (সহীহ বুখারী ২৬৩১)
মহামারী দেখা দিলে করণীয়ঃ
বেশির ভাগ মহামারীই সংক্রামক। তাই রাসুল সা. মহামারীতে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। মুমিন বান্দার করণীয় হলো ঈমান ও ইখলাসের সঙ্গে ধৈর্য ধারণ করবে। উসামা ইবনু যায়েদ বর্ণনা করেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘কোথাও মহামারী দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে চলে এসো না। আবার কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করে থাকলে, সে জায়গায় গমন করো না।’ (তিরমিযি ১০৬৫)
হযরত উমর রা. এর শাসনামলে শামে মহামারী দেখা দিলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফরও বাতিল করেছিলেন। (সহীহ বুখারী ৫৭২৯)
তাই যেখানে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে, সেখানে যাতায়াত উচিত নয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র সরকারীভাবে করোনা মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলোতে যাতায়াতে সতর্কতা ও কড়া আইন জারি করেছে।
তাছাড়া রোগাক্রান্ত উটগুলোকে নবীজী সা. ভালো উটের থেকে আলাদা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। যা মহামারীতে আক্রান্ত লোককে আলাদা রেখে চিকিৎসা করানোর প্রতি ঈঙ্গিত বহন করে।
করোনা ভাইরাস কী?
করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস- যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। সারাবিশ্বে এরই মধ্যে ১৫০টির বেশি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস, বিশ্বব্যাপী প্রাণহানি হয়েছে ৭ হাজারের বেশি মানুষের।
ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯ -এনসিওভি বা নভেল করোনা ভাইরাস। এটি এক ধরনের করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ছয়টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরনের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি।
করোনার লক্ষণ :
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ জ্বর। এছাড়াও শুকনো কাশি/ গলা ব্যথা ও শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত এর প্রধান লক্ষণ। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে।
যে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী:
ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং টাকা নাড়াচাড়া করলে অবশ্যই হাত ধুবেন (অন্তত ২০ সেকেন্ড যাবৎ)।
অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না।
ইতোমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
হাঁচি/কাশির সময় বাহু/টিস্যু/ কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন।
অসুস্থ পশু/পাখির সংস্পর্শ পরিহার করুন।
মাছ-মাংস ভালোভাবে রান্না করুন।
অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন, বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নাক মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন।
অন্যের সাথে আলাপ আলোচনার সময় অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন।
জরুরী প্রয়োজন ছাড়া সকল প্রকার (দেশে/বিদেশে) ভ্রমণ বন্ধ রাখুন।
যে আমলগুলো আবশ্যক:
আমরা আগে আলোচনা করেছি যে, মহামারী আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা বা সতর্কতার জন্য। তাই আমাদের এ সময়ে বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা আবশ্যক। সাথে সাথে নবীজী সা. মহামারী ও দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে রক্ষার জন্য যে দুআ শিখিয়েছেন তা নিয়মিত আমল করা প্রয়োজন।
১ . সহীহ হাদীসে বর্ণিত সকাল সন্ধ্যার দুআসমূহ গুরুত্বের সাথে পড়–ন।
২ . সাধারণভাবে যে দুআটি পড়লে যে কোন দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়-
আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিনাল বারাসি ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি, ওয়া মিন সাইয়িইল আসকাম। (আবু দাউদ ১৫৫৪)
৩. বাসা থেকে বের হবার সময় এই দুআটি পড়লে তাকে (অদৃশ্যভাবে) বলা হয়, তুমি হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছো, রক্ষা পেয়েছো ও
নিরাপত্তা লাভ করেছো।
বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ । (আবু দাউদ ৫০৯৫)
৪. যে কোন স্থানে গিয়ে অবতরণ ও প্রবেশের সময় এ দুআ পড়লে সে স্থান থেকে তাকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করতে পারে না।
আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক। (সহীহ ইবনু হিব্বান ২৭০০)
৫. নবীজী সা. যখন কোন বিষয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে এই দ্আু পড়তেন।
ইয়া হাইয়ু ইয়া কাইয়ুম বিরহমাতিকা আসতাগীছ (তিরমিযি ৩৫২৪)
পাঠক,
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা মানবজাতি সৃষ্টি করে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ভূষিত করেছেন। আর এ সৃষ্টির সেরা জীব যদি তার আসল মালিককে ভুলে যায় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, তাহলে তার মালিক তার প্রতি শুধু অসন্তুষ্টই হন না, বরং তাকে শাস্তিও দেন। তাই এই মুহূর্তে আমাদের সবার উচিত, অশ্লীলতা, নাফরামানি ও পাপাচার ত্যাগ করা। ঘরে ঘরে কোরআন তিলাওয়াত করা। বেশি বেশি সদকা করা। নবীজীর বর্ণিত দুআর আমল করা। সব সময় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকা। নামাযের মাধ্যমে বেশি বেশি বিপদ থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা করা। এ ছাড়া আরো বহু হাদিসে সার্বক্ষণিক অজু অবস্থায় থাকার প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী বেশি বেশি সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি দিয়ে হাত ধোয়ার পাশাপাশি ঘন ঘন অজু করি, তাহলে একদিকে যেমন অযুর ফজিলত পাওয়া যাবে অন্যদিকে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার পদক্ষেপ গ্রহণ হবে।
লেখক: ইমাম, বাইতুল আমান জামে মসজিদ মেইন বাসস্ট্যান্ড কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।