বিশেষ প্রতিনিধিঃ

গীতা দাস (৬০)। ঝুপড়ি ঘরে যার বসবাস। ১২ বছর ধরে এভাবেই তিনি রাস্তার পাশে ঘর বেঁধে বসবাস করছেন। বিভিন্ন ব্যানার আর খড়িকাঠি দিয়ে মনের মতো সাজিয়েছেন ঘর। যে ঘরে রান্না, সেই ঘরেই আবার নিশ্চিন্তে ঘুম। এ যেন তার নিত্য দিনের সঙ্গী। প্রতিদিন হাজারও মানুষের পদচারণা ঘটে এ রাস্তা দিয়ে। কৌতুহলী হয়ে অনেকেই গীতা দাসের ঘরখানা দেখে। আবার অনেকেই ছবি তোলে। কিন্তু সেই গীতা দাসের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি আজও। তারপরও জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছেন এই ঘরে থেকেই। এভাবেই প্রতিনিয়ত নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন ৬০ বছরের এই বৃদ্ধা। এ যেন কবির আসমানীকেই হার মানায়।

গীতা দাসের বাড়ি নলডাঙ্গা ইউনিয়নের শ্রীমন্তপুর গ্রামে। তার স্বামীর নাম ঠাকুর দাস। স্বামী মৃত্যুর পরেই গীতা দাসের এই করুণ পরিণতি। অনাহারে আর অর্ধাহারেই দিন কেটে যায় এই বৃদ্ধার।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে জানা যায়, গীতা দাস যে ঘরটিতে বসবাস করেন সেই জায়গাটি অন্যের, তবে ঘরটি নিজের। খড়িকাঠি আর ব্যানারের কাপড় দিয়ে যতœ করে সাজিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ঘরমালিক গীতা দাসের (৬০) মূল্যবান সব মালামাল। একপাশে রয়েছে একটি মাটির চুলা, যেখানে তিনি রান্না করেন। খাওয়া শেষে রাত হলেই পাশে একটি টিনের চালার নিচে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়েন। সব সময় মানুষ দেখলেই নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কথাও বলেন খুব কম। তবে হাত পেতে তিনি অন্যের নিকট ভিক্ষা করেন না। কেউ যদি সেচ্ছায় গীতা দাসকে কিছু দেয় সেটিই তিনি নেন এবং এটিই তার জীবন ধারনের মূল চাবি কাঠি।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা বাজারের দক্ষিণ প্রান্তে একটি রাইস মিলের সামনে এভাবেই বসতি গড়ে তুলেছেন গীতা দাস। সাত বছর ধরে তিনি এখানে থেকে সবার সঙ্গে মিশে চলেন। স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি সব আছে তাঁর, কখনো এলোমেলো চলতে দেখা যায়নি। মানুষের সাহায্যেই জীবন চলে। ছেলের সংসারে ফিরতে চান না তিনি। ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে আসেন। তাঁদের দাবি, মায়ের মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি বাড়ি যেতে চান না।

গীতা ও ঠাকুর দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে। মেয়ে কল্পনা দাসের (৪৩) বিয়ে দিয়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলার ছোট ভাটপাড়া গ্রামে। আর ছেলে নারায়ণ দাস (৪১) থাকেন শ্রীমন্তপুরেই। তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালান নারায়ণ। চার শতক জমির ওপর টিনের চালাঘর, সেখানেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেন তিনি।

নারায়ণ দাস জানান, ৩৯ বছর হয়েছে তাঁর বাবা মারা গেছেন। মা গীতা দাসই কঠোর পরিশ্রম করে তাঁদের বড় করে তুলেছেন। তাঁদের কোনো জায়গাজমি ছিল না। অন্যের জমিতে ঘর বেঁধে বসবাস করতেন। বর্তমানে ৪ শতক জমি কিনে সেখানে টিনের ঘর করে বাস করছেন। সংসারে অভাব রয়েছে, তবে আগের মতো না খেয়ে কাটাতে হয় না।

নলডাঙ্গা বাজারের একাধিক বাসিন্দা জানান, প্রায় ১২ বছর আগে এই বৃদ্ধা তাঁদের বাজারে বসতি গড়ে তুলেছেন। বাজারের দক্ষিণ প্রান্তে থাকা একটি রাইস মিলের সামনের ফাঁকা অংশে তিনি খড়িকাঠি দিয়ে ছোট ঘর বানিয়েছেন, যে ঘরের মধ্যে শোয়ার কোনো জায়গা নেই। আছে একটি চুলা, আর বৃদ্ধার কাপড় থেকে শুরু করে নানা মালামাল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সারা দিন বাজারের দোকানগুলোতে মানুষের কাছে সাহায্য চান, বিকেল হলেই ঘরে ফিরে আসেন। এসে রান্না শুরু করেন। রাতে এই রান্না করা খাবার খেয়ে রাইস মিলের চালার নিচে ঘুমিয়ে পড়েন। আর ঘরটির দরজা সুন্দরভাবে বন্ধ করে রাখেন। রাতের খাবার খেয়ে যেটুকু থাকে, সেটুকুই সকালে খান। দুপুরে কোথায় খান, সেটা ঠিক নেই। এভাবেই তিনি বেঁচে আছেন।

রাইস মিলের মালিক মাসুদ আলী বলেন, ‘বৃদ্ধা কথা কম বলেন। অনেকে তাঁকে পাগলি বলে জানলেও কখনো তাঁকে পাগলামি করতে দেখা যায়নি। তাঁর সবকিছুই ঠিক আছে। একজন যেভাবে সংসার গুছিয়ে রেখে চলেন, সেভাবেই তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর সন্তানেরা মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসেন। তারপরও কোথায় যেন একটা সমস্যা রয়ে গেছে, যেটা কেউ বুঝতে পারছেন না। বৃদ্ধাও কাউকে বুঝতে দেন না। তবে যেটা বুঝি, তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন এই অবস্থায় থাকায় শরীর শুকিয়ে গেছে। তাঁর মাথার কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসা হলে সেটাও ভালো হবে।’

বৃদ্ধার একমাত্র ছেলে নারায়ণ দাস জানান, ১২ বছর আগে হঠাৎ করে তাঁর মা এলোমেলো কথাবার্তা বলতে থাকেন। এ সময় তিনি কবিরাজ দেখিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অর্থের অভাবে ডাক্তারের কাছে নিতে পারেননি। এই অবস্থায় চলার পর একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বেশ কিছুদিন পর নলডাঙ্গা বাজারে আছেন, এমন খবর পেয়ে সেখানে দেখতে যান। মাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি আসতে চাননি। নারায়ণ দাসের দাবি, সব সময় তিনি মায়ের খোঁজ রাখছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here