ঢাকা ০৫:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কালীগঞ্জের যে গ্রামে শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক জেনেও পান করছে অধিবাসীরা

Reporter Name

ঝিনাইদহঃ

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নের মাঝদিয়া গ্রামের শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক বিষ (আসেনিকোসিস) রয়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে। এ গ্রামে প্রায় চার হাজার নারী পুরুষের বসবাস। এর মধ্যে আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত রোগী সংখ্যা ১৬৭। এরমধ্যে মারা গেছেন প্রায় ১১ জন। যাদের মধ্যে সর্বশেষ ২০১৮ সালে মারা যান লক্ষণ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি আর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে মারা যান মোক্তার আলী নামের একজন।

এছাড়া ইজ্জত আলী ও জয়দেব নামক দুইজন রোগী মারা যান প্রায় এক যুগ আগে। আর্সেনিক নিয়ে কাজ করা এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের রেকর্ডে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে, এসব বিষয়ে সরকারের সেবা প্রতিষ্ঠানে কোন তথ্য নেই। সর্বশেষ ২০০৩ সালের পর কোন তথ্য নেই উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে। সরকারী এসব প্রতিষ্ঠানের দাবি আর্সেনিক বিষে এ উপজেলায় কেউ মারা যায়নি।

মাঝদিয়া গ্রামে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী সংস্থা থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করা হলেও তা মোট জনসংখ্যাার থেকে অপ্রতুল। এ গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত প্লান্ট করা হলেও বর্তমানে সেগুলো ব্যবহার করা হয়না। ফলে সেগুলোর অবস্থা এবেকারেই নাজুক হয়ে পড়েছে।

তবে, মাঝদিয়া গ্রামের অধিবাসিরা বলছে, এক সময় তারা পানির আর্সেনিক নিয়ে চিন্তা করতো। এখন আর ভাবে না। নলকূপে আসের্নিক আছে জেনেও পান করছেন। তাদের ভাষ্য, আমরা ভেবে কি করবো। সৃষ্টিকর্তা যেটা করবেন সেটাই মেনে নেওয়া ছাড়াতো আমাদের কিছু করার নেই।

এদিকে প্রায় ১০ বছর আগে মাঝদিয়া গ্রামে সরকারীভাবে স্থাপিত গভির নলকূপের পানি পরীক্ষা করে আর্সেনিক পাওয়া যায়। যে কারনে গভীর নলকূপ স্থাপন করাও এখানে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নয় বলে সে সময় জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। যে কারনে সে সময় ওই গ্রামের একটি পুকুর থেকে পানি শোধন প্লান্ট স্থাপন করে একটি দাতা সংস্থা। যে প্লান্টের পানি এখনো গ্রামের মানুষ পান করছেন।

২০০৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বার উপজেলার আলাইপুর গ্রামে ইছাহক নামে এক ব্যাক্তি আর্সেনিক বিষে মারা যান। তবে এসব বিষয়ে সরকারের কোন সেবা প্রতিষ্ঠানে কোন তথ্য নেই। উল্টো তাদের দাবি, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে এ উপজেলায় কেউ মারা যায়নি।

কালীগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অফিস জানিয়েছে, উপজেলার পৌর এলাকা ও ১১ ইউনিয়নে ২৩০ গ্রামে ২৯ হাজার ৫৬৩ সচল টিউবওয়েল রয়েছে। যারমধ্যে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে ২ হাজার ৯৫০ টি টিউবওয়েলে। এরমধ্যে বারোবাজার ইউনিয়নে ৩ হাজার ৪৪৩ সচল টিউবওয়েলের মধ্যে ৯৪৮ টি উিবওয়েলে আর্সেনিক বিষ রয়েছে।

২০০৩ সালে করা ওই জরিপে উপজেলায় মাত্র ২৯ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর তথ্য উঠে আসে। এরমধ্যে জামাল ইউনিয়নে একজন, মালিয়াট দুইজন, বারোবাজার ২৪ ও রাখালগাছি ইউনিয়নে দুইজন রোগী রয়েছে। এরপরে আর কোন তথ্য নেই খোদ সরকারী এই সেবা প্রতিষ্ঠানে।

এদিকে শতভাগ আর্সেনিকযুক্ত মাঝদিয়া গ্রামে কত জনসংখ্যা, কতটি নলকূপ, এতে কি পারমান আর্সেনিক এবং কতজন রোগী তার কোন হিসাব নেই স্থানীয় উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্য্যালয় ও পরিসংখ্যান অফিসে। তবে এতটুকু জানান বারোবাজার ইউনিয়নের নলকূপে ২৭.৩০% আর্সেনিক রয়েছে যা উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্য্যালয় থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাও আবার ২০০৩ সালে তৈরি করা রিপোর্ট। সবর্শেষ গত ১৭ বছরের কোন তথ্য নেই তাদের কাছে।

বর্তমানে মাঝদিয়া গ্রামের আর্সেনিক নিয়ে কাজ করছেন এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের মাঠকর্মী আব্দুর রাজ্জাক। তার ভাষ্য, বর্তমানে মাঝদিয়া গ্রামের ১৬৭ জন আর্সেনিকোসিস রোগী রয়েছে। এরমধ্যে বেশি রোগী রয়েছে ওই গ্রামের ঘোষপাড়ায়। এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের এই কর্মীর দাবি এই গ্রামে আর্সেনিক রোগীদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১১ জন মারা গেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে মারা যান লক্ষণ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি আর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে মারা যান মোক্তার আলী নামের একজন।

মাঝদিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান জানান, আমাদের গ্রামে একশত ভাগ নলকূপেই আর্সেনিক রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা করে জানিয়েছে। এক সময় ভাবতাম, এখন আর ভাবি না। আমরাতো আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি খাচ্ছি। কোন সমস্য হচ্ছে না বলে জানান এই কৃষক।

তবে, কালীগঞ্জ থানা আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার সুলতান আহমেদ জানান, আমাদের কাছে আর্সেনিকে কোন তথ্য নেই। আর্সেনিকোসিস বিষক্রিয়ায় কেউ মারা গেছে কিনা এমন তথ্যও আমার জানা নেই। আমি দু’বছর হলো কালীগঞ্জ হাসপাতালে এসেছি, সঠিক তথ্য নিতে হলে হাসপাতালের পরিসংখ্যান অফিসার নাঈমুল হকের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন এই ডাক্তার। কিন্তু গত দু’সপ্তাহ হলো কোন তথ্য না দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই পরিসংখ্যান কর্তা।

সর্বশেষ তিনি মুঠোফোনে জানান, ২০১৪ সালে দুইজন আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে এসেছিল। এরপর আর কোন তথ্য নেই হাসপাতালে বলছিলেন ওই পরিসংখ্যান কর্মকর্তা।

এ ব্যপারে কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী জেসমিন আরা জানান, মাঝদিয়া গ্রামে শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক আছে তা আমরা শুনেছি তবে এর কোন জরিপ রিপোর্ট আমাদের হাতে নেই। তাছাড়া এ নিয়ে কোন বাজেট বা কার্যক্রম নেই। তবে, বেশ কয়েক বছর আগে সরকারীভাবে উপজেলায় মোট ৩৭১টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। সে সময় মাঝদিয়া গ্রামে ৭টি গভীর নলকুপ স্থাপন করা হয়েছিল বলে জানি।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে যশোর মহাসড়কের পূর্বদিকে কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নে মাঝদিয়া গ্রাম। সুদীর্ঘকাল ধরে এ গ্রামের মানুষ একে অপরের সাথে মিলে মিশে বসবাস করে আসলেও তারা জানতো না ভয়াবহ বিষ আর্সেনিকের কথা। আর্সেনিকের লক্ষন চর্মরোগ দেখা দেওয়ার পর তারা স্থানীয় হোমিও ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিত। প্রথম ১৯৯৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেল্থ এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (ডিপিএইচই) ৪টি নলকুপ পরীক্ষা করলে এই আর্সেনিক ধরা পড়ে। ১৯৯৯ সালের স্থানীয় বে-সরকারী সংস্থা গরীবের আশ্রয় মাঝদিয়া গ্রামে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ১২৩ জন আর্সেনিক রোগী চিহ্নত করে। এরমধ্যে ইজ্জত আলী ও জয়দেব কুমার নামের ২ জন রোগী মারা গেছে। সে সময় বে-সরকারী সংস্থা গরীবের আশ্রয় ২ জন আশংকাজন রোগীকে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

এরপর ওই গ্রামে আর্সেসিক নিয়ে কাজ করে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক, গরীবের আশ্রয়, পল্লী উন্নয়ন সংস্থা এবং ইউনিসেফ। তাদের দেওয়া তথ্যে মাঝদিয়া গ্রামে প্রায় ৩শ টি নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে ৫% নলকূপের প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক রয়েছে ০.৭ মিলিগ্রাম যা স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রার (০.০৫ মিলিগ্রাম) চেয়ে ১৫ গুন বেশি। এবং ৬০% নলকুপের প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক রয়েছে ০.৫ মিলিগ্রাম যা স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১০ গুন বেশি। এছাড়া অন্য ৩৫% নলকুপেও কমবেশি আর্সেনিক রয়েছে যা গ্রামবাসির জন্য ভয়ানক। তবে, বর্তমানে এ গ্রামে সরকারী বা বেসরকারী কোন সংস্থা সুপেয় পানি নিয়ে কাজ করছে না।

বে-সরকারী সংস্থা গরীবের আশ্রয়ের নির্বাহী পরিচালক জামাল হোসেন জানান, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সহযোগীতায় মাঝদিয়া গ্রামে আমরা ৯টি আর্সেনিক ও আইরন রিমোভাল পানির প্লান্ট তৈরি করেছিলাম। এখন আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

পল্লী উন্নয়ন সংস্থা নির্বাহী পরিচালক আতাউল হক জিহাদ বলেন, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সহযোগীতায় মাঝদিয়া গ্রামে ৩টি আর্সেনিক ও আইরন রিমোভাল পানির প্লান্ট এবং ৭টি ডিপ টিউবওয়েল তৈরি করা হয়েছে।

এক জরিপ থেকে জানা গেছে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে আর্সেনিক ধরা পড়লেও ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সরকারী বা বে-সরকারী সংস্থা গুলো তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবে ১৯৯৯ সালে কোলকাতার যাদবপুর ইউনির্ভাসিটির পরিচালক দিপঙ্কর চক্রবর্তী পরিচালিত ব্রিটিশ জিওলোজিক্যাল সার্ভে স্টেট নামের একটি সংস্থা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের নিকটে ভারতের বর্ডার এলাকায় প্রচুর পরিমানে আর্সেনিক রয়েছে। এরপরই মূলত আর্সেনিক নিয়ে কাজ শুরু করে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।

About Author Information
আপডেট সময় : ১০:২১:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০
৯১২ Time View

কালীগঞ্জের যে গ্রামে শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক জেনেও পান করছে অধিবাসীরা

আপডেট সময় : ১০:২১:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০

ঝিনাইদহঃ

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নের মাঝদিয়া গ্রামের শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক বিষ (আসেনিকোসিস) রয়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে। এ গ্রামে প্রায় চার হাজার নারী পুরুষের বসবাস। এর মধ্যে আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত রোগী সংখ্যা ১৬৭। এরমধ্যে মারা গেছেন প্রায় ১১ জন। যাদের মধ্যে সর্বশেষ ২০১৮ সালে মারা যান লক্ষণ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি আর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে মারা যান মোক্তার আলী নামের একজন।

এছাড়া ইজ্জত আলী ও জয়দেব নামক দুইজন রোগী মারা যান প্রায় এক যুগ আগে। আর্সেনিক নিয়ে কাজ করা এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের রেকর্ডে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে, এসব বিষয়ে সরকারের সেবা প্রতিষ্ঠানে কোন তথ্য নেই। সর্বশেষ ২০০৩ সালের পর কোন তথ্য নেই উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে। সরকারী এসব প্রতিষ্ঠানের দাবি আর্সেনিক বিষে এ উপজেলায় কেউ মারা যায়নি।

মাঝদিয়া গ্রামে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী সংস্থা থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করা হলেও তা মোট জনসংখ্যাার থেকে অপ্রতুল। এ গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত প্লান্ট করা হলেও বর্তমানে সেগুলো ব্যবহার করা হয়না। ফলে সেগুলোর অবস্থা এবেকারেই নাজুক হয়ে পড়েছে।

তবে, মাঝদিয়া গ্রামের অধিবাসিরা বলছে, এক সময় তারা পানির আর্সেনিক নিয়ে চিন্তা করতো। এখন আর ভাবে না। নলকূপে আসের্নিক আছে জেনেও পান করছেন। তাদের ভাষ্য, আমরা ভেবে কি করবো। সৃষ্টিকর্তা যেটা করবেন সেটাই মেনে নেওয়া ছাড়াতো আমাদের কিছু করার নেই।

এদিকে প্রায় ১০ বছর আগে মাঝদিয়া গ্রামে সরকারীভাবে স্থাপিত গভির নলকূপের পানি পরীক্ষা করে আর্সেনিক পাওয়া যায়। যে কারনে গভীর নলকূপ স্থাপন করাও এখানে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নয় বলে সে সময় জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। যে কারনে সে সময় ওই গ্রামের একটি পুকুর থেকে পানি শোধন প্লান্ট স্থাপন করে একটি দাতা সংস্থা। যে প্লান্টের পানি এখনো গ্রামের মানুষ পান করছেন।

২০০৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বার উপজেলার আলাইপুর গ্রামে ইছাহক নামে এক ব্যাক্তি আর্সেনিক বিষে মারা যান। তবে এসব বিষয়ে সরকারের কোন সেবা প্রতিষ্ঠানে কোন তথ্য নেই। উল্টো তাদের দাবি, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে এ উপজেলায় কেউ মারা যায়নি।

কালীগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অফিস জানিয়েছে, উপজেলার পৌর এলাকা ও ১১ ইউনিয়নে ২৩০ গ্রামে ২৯ হাজার ৫৬৩ সচল টিউবওয়েল রয়েছে। যারমধ্যে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে ২ হাজার ৯৫০ টি টিউবওয়েলে। এরমধ্যে বারোবাজার ইউনিয়নে ৩ হাজার ৪৪৩ সচল টিউবওয়েলের মধ্যে ৯৪৮ টি উিবওয়েলে আর্সেনিক বিষ রয়েছে।

২০০৩ সালে করা ওই জরিপে উপজেলায় মাত্র ২৯ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর তথ্য উঠে আসে। এরমধ্যে জামাল ইউনিয়নে একজন, মালিয়াট দুইজন, বারোবাজার ২৪ ও রাখালগাছি ইউনিয়নে দুইজন রোগী রয়েছে। এরপরে আর কোন তথ্য নেই খোদ সরকারী এই সেবা প্রতিষ্ঠানে।

এদিকে শতভাগ আর্সেনিকযুক্ত মাঝদিয়া গ্রামে কত জনসংখ্যা, কতটি নলকূপ, এতে কি পারমান আর্সেনিক এবং কতজন রোগী তার কোন হিসাব নেই স্থানীয় উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্য্যালয় ও পরিসংখ্যান অফিসে। তবে এতটুকু জানান বারোবাজার ইউনিয়নের নলকূপে ২৭.৩০% আর্সেনিক রয়েছে যা উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্য্যালয় থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাও আবার ২০০৩ সালে তৈরি করা রিপোর্ট। সবর্শেষ গত ১৭ বছরের কোন তথ্য নেই তাদের কাছে।

বর্তমানে মাঝদিয়া গ্রামের আর্সেনিক নিয়ে কাজ করছেন এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের মাঠকর্মী আব্দুর রাজ্জাক। তার ভাষ্য, বর্তমানে মাঝদিয়া গ্রামের ১৬৭ জন আর্সেনিকোসিস রোগী রয়েছে। এরমধ্যে বেশি রোগী রয়েছে ওই গ্রামের ঘোষপাড়ায়। এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের এই কর্মীর দাবি এই গ্রামে আর্সেনিক রোগীদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১১ জন মারা গেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে মারা যান লক্ষণ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি আর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে মারা যান মোক্তার আলী নামের একজন।

মাঝদিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান জানান, আমাদের গ্রামে একশত ভাগ নলকূপেই আর্সেনিক রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা করে জানিয়েছে। এক সময় ভাবতাম, এখন আর ভাবি না। আমরাতো আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি খাচ্ছি। কোন সমস্য হচ্ছে না বলে জানান এই কৃষক।

তবে, কালীগঞ্জ থানা আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার সুলতান আহমেদ জানান, আমাদের কাছে আর্সেনিকে কোন তথ্য নেই। আর্সেনিকোসিস বিষক্রিয়ায় কেউ মারা গেছে কিনা এমন তথ্যও আমার জানা নেই। আমি দু’বছর হলো কালীগঞ্জ হাসপাতালে এসেছি, সঠিক তথ্য নিতে হলে হাসপাতালের পরিসংখ্যান অফিসার নাঈমুল হকের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন এই ডাক্তার। কিন্তু গত দু’সপ্তাহ হলো কোন তথ্য না দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই পরিসংখ্যান কর্তা।

সর্বশেষ তিনি মুঠোফোনে জানান, ২০১৪ সালে দুইজন আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে এসেছিল। এরপর আর কোন তথ্য নেই হাসপাতালে বলছিলেন ওই পরিসংখ্যান কর্মকর্তা।

এ ব্যপারে কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী জেসমিন আরা জানান, মাঝদিয়া গ্রামে শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক আছে তা আমরা শুনেছি তবে এর কোন জরিপ রিপোর্ট আমাদের হাতে নেই। তাছাড়া এ নিয়ে কোন বাজেট বা কার্যক্রম নেই। তবে, বেশ কয়েক বছর আগে সরকারীভাবে উপজেলায় মোট ৩৭১টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। সে সময় মাঝদিয়া গ্রামে ৭টি গভীর নলকুপ স্থাপন করা হয়েছিল বলে জানি।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে যশোর মহাসড়কের পূর্বদিকে কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নে মাঝদিয়া গ্রাম। সুদীর্ঘকাল ধরে এ গ্রামের মানুষ একে অপরের সাথে মিলে মিশে বসবাস করে আসলেও তারা জানতো না ভয়াবহ বিষ আর্সেনিকের কথা। আর্সেনিকের লক্ষন চর্মরোগ দেখা দেওয়ার পর তারা স্থানীয় হোমিও ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিত। প্রথম ১৯৯৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেল্থ এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (ডিপিএইচই) ৪টি নলকুপ পরীক্ষা করলে এই আর্সেনিক ধরা পড়ে। ১৯৯৯ সালের স্থানীয় বে-সরকারী সংস্থা গরীবের আশ্রয় মাঝদিয়া গ্রামে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ১২৩ জন আর্সেনিক রোগী চিহ্নত করে। এরমধ্যে ইজ্জত আলী ও জয়দেব কুমার নামের ২ জন রোগী মারা গেছে। সে সময় বে-সরকারী সংস্থা গরীবের আশ্রয় ২ জন আশংকাজন রোগীকে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

এরপর ওই গ্রামে আর্সেসিক নিয়ে কাজ করে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক, গরীবের আশ্রয়, পল্লী উন্নয়ন সংস্থা এবং ইউনিসেফ। তাদের দেওয়া তথ্যে মাঝদিয়া গ্রামে প্রায় ৩শ টি নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে ৫% নলকূপের প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক রয়েছে ০.৭ মিলিগ্রাম যা স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রার (০.০৫ মিলিগ্রাম) চেয়ে ১৫ গুন বেশি। এবং ৬০% নলকুপের প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক রয়েছে ০.৫ মিলিগ্রাম যা স্বাভাবিক সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১০ গুন বেশি। এছাড়া অন্য ৩৫% নলকুপেও কমবেশি আর্সেনিক রয়েছে যা গ্রামবাসির জন্য ভয়ানক। তবে, বর্তমানে এ গ্রামে সরকারী বা বেসরকারী কোন সংস্থা সুপেয় পানি নিয়ে কাজ করছে না।

বে-সরকারী সংস্থা গরীবের আশ্রয়ের নির্বাহী পরিচালক জামাল হোসেন জানান, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সহযোগীতায় মাঝদিয়া গ্রামে আমরা ৯টি আর্সেনিক ও আইরন রিমোভাল পানির প্লান্ট তৈরি করেছিলাম। এখন আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

পল্লী উন্নয়ন সংস্থা নির্বাহী পরিচালক আতাউল হক জিহাদ বলেন, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সহযোগীতায় মাঝদিয়া গ্রামে ৩টি আর্সেনিক ও আইরন রিমোভাল পানির প্লান্ট এবং ৭টি ডিপ টিউবওয়েল তৈরি করা হয়েছে।

এক জরিপ থেকে জানা গেছে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে আর্সেনিক ধরা পড়লেও ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সরকারী বা বে-সরকারী সংস্থা গুলো তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবে ১৯৯৯ সালে কোলকাতার যাদবপুর ইউনির্ভাসিটির পরিচালক দিপঙ্কর চক্রবর্তী পরিচালিত ব্রিটিশ জিওলোজিক্যাল সার্ভে স্টেট নামের একটি সংস্থা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের নিকটে ভারতের বর্ডার এলাকায় প্রচুর পরিমানে আর্সেনিক রয়েছে। এরপরই মূলত আর্সেনিক নিয়ে কাজ শুরু করে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।