ঢাকা ১২:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কালীগঞ্জে আমন ক্ষেতে কারেন্ট পোকা ও পঁচারোগের বেপরোয়া আক্রমন

 

যারা মাঠের দিকে যাচ্ছেন অথবা ফিরছেন তাদের অধিকাংশের পিঠে ঝোলানো কীটনাশক স্প্রে করার মেশিন। সকল মাঠের চিত্র প্রায় একই রকম। কৃষকদের এমন দৃশ্যে মনে হচ্ছে ধানের মাঠগুলোতে হয়তো বালাইনাশক স্প্রের প্রশিক্ষন চলছে। কিন্ত তা সঠিক নয়। কারন তারা নিজেদের ক্ষেতের পোকা দমনে ব্যস্ত। কেননা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মাঠের পর মাঠের আমন ধান ক্ষেতে কারেন্ট পোকা (সবুজ গাছ ফড়িং) ও পঁচা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যা এখন কৃষকদের বড় চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমন ঠেকাতে ধানক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ছিটিয়েও নিয়ন্ত্রনে আসছেনা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন যে, বিকেলে ভাল খেত দেখে এসে পরের দিন সকালে গেলে দেখা যাচ্ছে ধানগাছগুলো মরে শুকিয়ে গেছে।

জমিতে কীটনাশক স্প্রে করছেন এক চাষী। ছবিটি কালীগঞ্জে আলাইপুর গ্রাম থেকে সম্প্রতি তোলা।

কাজেই ধানক্ষেতে পোকার আক্রমনের তীব্রতায় কৃষকেরা খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অথচ কৃষি কর্মকর্তারা এটাকে দেখছেন বিচ্ছিন্ন আক্রমন হিসেবে। কৃষকদের অভিযোগ, তাদের এমন বিপদ মূহুর্তে পরামর্শের জন্য কৃষি বিভাগের মাঠকর্মিদের ঠিকমত পাশে পাচ্ছেন না। তবে কৃষকদের কল্যানে বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানীর পক্ষ থেকে এমন অবস্থায় কি করনীয় তার পরামর্শ দিতে প্রচার মাইক বের করে হাটে মাঠে কৃষকদেরকে সচেতন করে চলেছে।

অপরদিকে মাঠে অত্যাধিক পরিমানে কীটনাশক ছেটানোর কারনে নিরাপদ খাদ্য ও নির্মল পরিবেশের উপরে বিরুপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কার বিষয়টি অনেকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাষীরা। ছবি: সবুজদেশ নিউজ

সরেজমিনে, মঙ্গলবার দিনভর উপজেলার ঈশ্বরবা,পাঁচ শ্রীরামপুর, আলাইপুর, সিংদহ, কমলাপুর, শ্রীরামপুর, নরেন্দ্রপুর, নিয়ামতপুর, বারোপাখিয়া, বলরামপুর, ভোলপাড়া, বিনোদপুর, কামালহাটসহ আরও বেশ কিছু গ্রামের মাঠে ঘুরে দেখা গেছে কৃষকেরা তাদের ধান ক্ষেত বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা কীটনাশক স্প্রে করার মেশিন পিঠে ঝুলিয়ে জমিতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করছেন। এদিকে পোকার আক্রমনের তীব্রতায় দিশেহারা কৃষকদের কল্যানে বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানীর পক্ষ থেকে পরামর্শ প্রচার করতে দেখা গেছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলাটিতে আমণ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১৮ হাজার ৭’শ ৩৪ হেক্টোর জমিতে আমন করা হয়েছে।

একাধিক কৃষক জানান, বাদামী রঙের এক ধরনের ছোট ছোট পোকা ধানগাছের নরম কান্ডে বসে ছিদ্র করে কান্ডরস চুষে নিচ্ছে। এরপর ওই কান্ড শুকিয়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত ক্ষেত থেকে আশপাশের ক্ষেতগুলোতে এ পোকা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এবং মাঠের পর মাঠের ধানক্ষেত এভাবে আক্রমনের শিকার হচ্ছে। তারা বলেন, বিগত দিনেও এ রোগের আক্রমন দেখা গেছে। তখন কীটনাশক স্প্রে করলে নিয়ন্ত্রন করা গেছে। কিন্ত এ বছর সপ্তাহে ১ বারের স্থলে ৩ বার স্প্রে করেও নিয়ন্ত্রনে আনতে কষ্ট হচ্ছে।

পঁচারোগে আক্রান্ত ধান গাছ। ছবিটি আলাইপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: সবুজদেশ নিউজ

উপজেলার আলাইপুর গ্রামের কৃষক রেকবুল ইসলাম জানান, চলতি আমন মৌসুমের প্রথম দিকে মাঠে মাজরা পোকার আক্রমন দেখা দিয়েছিল। এটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এখন কারেন্ট পোকায় ধরেছে। যা মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। বিকালে ভালো ক্ষেত দেখে বাড়ি এসে পরের দিন গেলে দেখা যাচ্ছে ধানগাছগুলো শুকিয়ে গেছে। সময় যত পার হচ্ছে এটা ভয়ঙ্কর রুপ ধারন করছে। ইতোমধ্যে তাদের মাঠের বেশ কিছু ক্ষেত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে।

কামালহাট গ্রামের কৃষক স্বরজিত বিশ্বাস জানান, ধানক্ষেত গুলোতে প্রতিবছর কিছু কীটপতঙ্গের আক্রমন থাকেই। কিন্ত এ বছর বাদামী গাছ ফড়িং (কারেন্ট পোকা) ও পঁচারোগের প্রাদুর্ভাব অনেকগুন বেশি। যে কারনে ক্ষেত বাঁচাতে কৃষকদের এখন খাওয়া ঘুম থাকছে না। সকলের নজর এখন নিজের ক্ষেতের দিকে। কৃষকেরা আক্রান্ত ক্ষেতে যেমন স্প্রে করছেন তেমন আক্রান্ত হওয়ার আগেও ক্ষেত বাঁচাতে কীটনাশক স্প্রে করছেন। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছেনা।

শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক মোজাহারুল ইসলাম জানান, পোকা দমনে এ বছর স্প্রে করেও ভরসা পাওয়া যাচ্ছেনা। কারন কীটনাশকে মনে হচ্ছে বেশি একটা কাজ করছে না। ফলে একটু বেশি করেই ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করছেন। তারপরও কি হবে জানি না।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনির সঙ্গে সরাসরি কথা বললে তিনি জানান, চলতি আমন মৌসুমের প্রথম দিকে মাজরা পোকার আক্রমন দেখা দেয়। সে সময়ে কৃষকেরা অতিরিক্ত কীটনাশক স্প্রে করেছেন। এর সঙ্গে বাদামী গাছ ফড়িং বা কারেন্ট পোকা আসার ব্যাপারটা বেশ সম্পর্কযুক্ত। রোগ বালাইয়ের প্রশ্নে তিনি বিচ্ছিন্ন কিছু আক্রমন দেখা দিয়েছে বলে জানান।

মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশকের ব্যবহার ও পরিবেশের প্রশ্নে তিনি বলেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার অবশ্যই নির্মল পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ে। সে কারনে প্রাথমিকভাবে তারা ফেরোমন ট্রাপ (যা পোকা মারার ফাঁদ) ব্যবহারের কথা বলে থাকেন। এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।

সবুজদেশ/এসএইচ/এসএএস

Tag :
জনপ্রিয়

নভেম্বরেই দেশে ফিরছেন তারেক রহমান, বিএনপি তারিখ জানাবে শিগগিরই

কালীগঞ্জে আমন ক্ষেতে কারেন্ট পোকা ও পঁচারোগের বেপরোয়া আক্রমন

Update Time : ০৮:১২:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

 

যারা মাঠের দিকে যাচ্ছেন অথবা ফিরছেন তাদের অধিকাংশের পিঠে ঝোলানো কীটনাশক স্প্রে করার মেশিন। সকল মাঠের চিত্র প্রায় একই রকম। কৃষকদের এমন দৃশ্যে মনে হচ্ছে ধানের মাঠগুলোতে হয়তো বালাইনাশক স্প্রের প্রশিক্ষন চলছে। কিন্ত তা সঠিক নয়। কারন তারা নিজেদের ক্ষেতের পোকা দমনে ব্যস্ত। কেননা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মাঠের পর মাঠের আমন ধান ক্ষেতে কারেন্ট পোকা (সবুজ গাছ ফড়িং) ও পঁচা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যা এখন কৃষকদের বড় চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমন ঠেকাতে ধানক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ছিটিয়েও নিয়ন্ত্রনে আসছেনা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন যে, বিকেলে ভাল খেত দেখে এসে পরের দিন সকালে গেলে দেখা যাচ্ছে ধানগাছগুলো মরে শুকিয়ে গেছে।

জমিতে কীটনাশক স্প্রে করছেন এক চাষী। ছবিটি কালীগঞ্জে আলাইপুর গ্রাম থেকে সম্প্রতি তোলা।

কাজেই ধানক্ষেতে পোকার আক্রমনের তীব্রতায় কৃষকেরা খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অথচ কৃষি কর্মকর্তারা এটাকে দেখছেন বিচ্ছিন্ন আক্রমন হিসেবে। কৃষকদের অভিযোগ, তাদের এমন বিপদ মূহুর্তে পরামর্শের জন্য কৃষি বিভাগের মাঠকর্মিদের ঠিকমত পাশে পাচ্ছেন না। তবে কৃষকদের কল্যানে বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানীর পক্ষ থেকে এমন অবস্থায় কি করনীয় তার পরামর্শ দিতে প্রচার মাইক বের করে হাটে মাঠে কৃষকদেরকে সচেতন করে চলেছে।

অপরদিকে মাঠে অত্যাধিক পরিমানে কীটনাশক ছেটানোর কারনে নিরাপদ খাদ্য ও নির্মল পরিবেশের উপরে বিরুপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কার বিষয়টি অনেকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাষীরা। ছবি: সবুজদেশ নিউজ

সরেজমিনে, মঙ্গলবার দিনভর উপজেলার ঈশ্বরবা,পাঁচ শ্রীরামপুর, আলাইপুর, সিংদহ, কমলাপুর, শ্রীরামপুর, নরেন্দ্রপুর, নিয়ামতপুর, বারোপাখিয়া, বলরামপুর, ভোলপাড়া, বিনোদপুর, কামালহাটসহ আরও বেশ কিছু গ্রামের মাঠে ঘুরে দেখা গেছে কৃষকেরা তাদের ধান ক্ষেত বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা কীটনাশক স্প্রে করার মেশিন পিঠে ঝুলিয়ে জমিতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করছেন। এদিকে পোকার আক্রমনের তীব্রতায় দিশেহারা কৃষকদের কল্যানে বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানীর পক্ষ থেকে পরামর্শ প্রচার করতে দেখা গেছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলাটিতে আমণ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১৮ হাজার ৭’শ ৩৪ হেক্টোর জমিতে আমন করা হয়েছে।

একাধিক কৃষক জানান, বাদামী রঙের এক ধরনের ছোট ছোট পোকা ধানগাছের নরম কান্ডে বসে ছিদ্র করে কান্ডরস চুষে নিচ্ছে। এরপর ওই কান্ড শুকিয়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত ক্ষেত থেকে আশপাশের ক্ষেতগুলোতে এ পোকা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এবং মাঠের পর মাঠের ধানক্ষেত এভাবে আক্রমনের শিকার হচ্ছে। তারা বলেন, বিগত দিনেও এ রোগের আক্রমন দেখা গেছে। তখন কীটনাশক স্প্রে করলে নিয়ন্ত্রন করা গেছে। কিন্ত এ বছর সপ্তাহে ১ বারের স্থলে ৩ বার স্প্রে করেও নিয়ন্ত্রনে আনতে কষ্ট হচ্ছে।

পঁচারোগে আক্রান্ত ধান গাছ। ছবিটি আলাইপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: সবুজদেশ নিউজ

উপজেলার আলাইপুর গ্রামের কৃষক রেকবুল ইসলাম জানান, চলতি আমন মৌসুমের প্রথম দিকে মাঠে মাজরা পোকার আক্রমন দেখা দিয়েছিল। এটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এখন কারেন্ট পোকায় ধরেছে। যা মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। বিকালে ভালো ক্ষেত দেখে বাড়ি এসে পরের দিন গেলে দেখা যাচ্ছে ধানগাছগুলো শুকিয়ে গেছে। সময় যত পার হচ্ছে এটা ভয়ঙ্কর রুপ ধারন করছে। ইতোমধ্যে তাদের মাঠের বেশ কিছু ক্ষেত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে।

কামালহাট গ্রামের কৃষক স্বরজিত বিশ্বাস জানান, ধানক্ষেত গুলোতে প্রতিবছর কিছু কীটপতঙ্গের আক্রমন থাকেই। কিন্ত এ বছর বাদামী গাছ ফড়িং (কারেন্ট পোকা) ও পঁচারোগের প্রাদুর্ভাব অনেকগুন বেশি। যে কারনে ক্ষেত বাঁচাতে কৃষকদের এখন খাওয়া ঘুম থাকছে না। সকলের নজর এখন নিজের ক্ষেতের দিকে। কৃষকেরা আক্রান্ত ক্ষেতে যেমন স্প্রে করছেন তেমন আক্রান্ত হওয়ার আগেও ক্ষেত বাঁচাতে কীটনাশক স্প্রে করছেন। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছেনা।

শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক মোজাহারুল ইসলাম জানান, পোকা দমনে এ বছর স্প্রে করেও ভরসা পাওয়া যাচ্ছেনা। কারন কীটনাশকে মনে হচ্ছে বেশি একটা কাজ করছে না। ফলে একটু বেশি করেই ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করছেন। তারপরও কি হবে জানি না।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনির সঙ্গে সরাসরি কথা বললে তিনি জানান, চলতি আমন মৌসুমের প্রথম দিকে মাজরা পোকার আক্রমন দেখা দেয়। সে সময়ে কৃষকেরা অতিরিক্ত কীটনাশক স্প্রে করেছেন। এর সঙ্গে বাদামী গাছ ফড়িং বা কারেন্ট পোকা আসার ব্যাপারটা বেশ সম্পর্কযুক্ত। রোগ বালাইয়ের প্রশ্নে তিনি বিচ্ছিন্ন কিছু আক্রমন দেখা দিয়েছে বলে জানান।

মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশকের ব্যবহার ও পরিবেশের প্রশ্নে তিনি বলেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার অবশ্যই নির্মল পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ে। সে কারনে প্রাথমিকভাবে তারা ফেরোমন ট্রাপ (যা পোকা মারার ফাঁদ) ব্যবহারের কথা বলে থাকেন। এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।

সবুজদেশ/এসএইচ/এসএএস