ঢাকা ১০:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কালীগঞ্জে মানসিক প্রতিবন্ধি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আশ্রয় দিলেন দিনমজুর

Reporter Name

বিশেষ প্রতিনিধিঃ

গ্রামের পাশেই কোলা বাজার। সকাল বিকেল যখনই বাজারে যাই দেখা মেলে আনুমানিক ২২/২৩ বছরের এক মানষিক প্রতিবন্ধি মহিলার। কখনও ময়লা কাপড় চোপড় শরীরে জড়িয়ে আবার কখনও অর্ধলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় সে। আর মুখে বিড় বিড় করে কি যেন বলে যা বোঝার উপায় নেই। কেউ কিছু বললে কখনও তেড়ে আসে। আবার কখনও দেখা যায় ঠান্ডা মেজাজে। কিন্ত গত ৫ দিন আগে পরিচয়হীন এই প্রতিবন্ধি অসুস্থ হয়ে বিকেল হতে আমাদের গ্রামের রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। সে চোখ মেলিয়ে তাকাতে পারলেও তার ছিলনা কোন নড়াচড়া। তাকে দেখতে বিকেল থেকেই লোকজনের ভীড় ছিল। এরপর রাত গভীর হলে উৎসুক জনতা ও পথচারীদের ভীড় কমতে থাকে। কিন্ত সেও তো একটা মানুষ। কারও না কারও সন্তান বা বোন। এটা ভেবে বিবেকের তাড়নায় আমি আর চলে আসতে পারিনি। ওই রাতেই গ্রামের আরও কয়েক জনকে সাথে করে অসুস্থ পাগলীকে নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। কিন্ত কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগী দেখেই বললেন মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। এখন তার পর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়া আর বিশ্রাম দরকার। দেয়া হলো প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা। এরপর বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠতেই বেডে শুয়েই সে শুরু করে অসহ্য পাগলামী। অস্থির করে তোলে গোটা হাসপাতাল এলাকা। বাধ্য হয়ে গাড়ি ভাড়া করেই আবার তাকে নিয়ে বাজারে ফিরি। কিন্ত পোহাবে পাগলীর যন্ত্রনা। এলাকার সবাই ঝামেলা এড়াতে পারলেও আমি পারিনি। অসুস্থ পাগলীকে বিবেকের তাড়নায় আর বাজারে ছেড়ে দিতে পারিনি। প্রতিবন্ধির গর্ভের সন্তানের কথা চিন্তা করে আমার অভাবের সংসার হলেও নিজের বাড়িতে এনে রেখেছি। শত অভাবের মধ্যেও সে এখন আমার পরিবারের আরেক সদস্যের মত। কথাগুলো বললেন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ময়ধরপুর গ্রামের মৃত সালামত আলীর ছেলে আমজাদ আলী।

রবিবার বিকেলে সরেজমিনে আমজাদ আলীর বাড়িতে গেলে দেখা যায়, মাটির উপর টিনের ছাউনির একটি ঘরের বারান্দায় স্থির হয়ে বসা রয়েছে এই প্রতিবন্ধি। পাশেই রয়েছে খাবারের একটি থালা। মানুষ সামনে গেলেই শুধু মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকছে। আর মুখে হালকা শব্দ করে কি যেন বলছে। যা বোঝা যাচ্ছে না।

আমজাদ আলী জানান, আমি একজন গরীব মানুষ। মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি নেই। সারা বছর পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করে সংসার চালাই। এক মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে মেয়ে লাবনীর বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে সালমান শাহ রাজমিস্ত্রির কাজ করে। কিন্ত সে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রায় ৬ মাস ধরে শয্যাশায়ী। ফলে এখন শুধু একার রোজগারে সংসার চালাতে হচ্ছে। অভাব তো সারাবছরের জন্য রয়েইছে। তারপরও নিজেরা যেভাবে থাকি খাই সেটা না হয় পাগলির সাথে ভাগাভাগি করে খাবো।

তিনি বলেন, এমনটা যদি আমার মেয়ের হতো তাহলে তো আমাকেই দেখতে হতো। পথে পড়ে থাকা অসুস্থ পাগলীকে অনেকে দেখেছে যাদের সামর্থও আছে। কিন্ত কেউ যখন তাকে নিয়ে ভাবেনি তখন আমি তার গর্ভের সন্তানের কথা ভেবে রাস্তায় ছেড়ে দিতে পারিনি। শনিবার তার আলট্রা সনোগ্রাফী করা হয়েছে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক বলেছেন মেয়েটি ৮ মাস গর্ভবতী। চিকিসকের পরামর্শ অনুযায়ী পাগলীর ব্যবস্থাপত্র দেয়া হচ্ছে।

আমজাদ হোসেনের স্ত্রী ছাকিরন নেছা জানান, মেয়েদের গর্ভপাতের সময়টা অত্যন্ত কষ্টের। এমন অবস্থায় মেয়েটি পথে পথে ঘুরে বেড়াবে ভাবতেও খারাপ লাগছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পাগলীর থাকার জন্য নিজেদের মত করে ঘর নির্মান করা হচ্ছে। নিজেদেরকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে । তারপরও একজন মা হিসেবে একজন মেয়ের জন্য যা করা দরকার শত অভাবের মধ্যদিয়েও সামর্থ অনুযায়ী তা করছেন।

প্রতিবেশি পল্লী চিকিৎসক অশ্বিনী বিশ্বাস জানান, তাদের গ্রামের আমজাদ নিতান্তই একজন গরীব মানুষ। তারপরও সমাজের একজন মানুষ হিসেবে একজন অসহায় মানষিক প্রতিবন্ধিকে আপন করে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি প্রতিদিনই আমজাদের বাড়িতে গিয়ে ওই পাগলীর খবর নিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, পরিচয়হীন পথে ঘাটে ঘোরা ওই মানষিক প্রতিবন্ধি হয়তোবা কোন পশুবৃত্তির মানুষ দ্বারা এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে তার গর্ভের সন্তান তো কোন অপরাধ করেনি।

কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ূব হোসেন জানান, বাজারে ওই পাগলী বেশ কিছুদিন ঘোরাফেরা করছে। কিন্ত সে অসুস্থ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকার পর ওই গ্রামের আমজাদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন তাকে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন নিজের পরিবারের সদস্যের মত তারা সেবা করছেন। এটা শুনেও ভালো লাগছে।

তিনি বলেন, এক শ্রেণীর মানুষরুপী অমানুষদের পাশবিক নির্যাতনে এমনটি ঘটতে পারে বলে তার ধারনা। এখন পাগলীকে ছেড়ে দিলে সে হয়তো ঘুরে বেড়াতে পারবে কিন্ত পথে ঘাটে সন্তান প্রসব করলে ওই সন্তানকে কে দেখবে। আবার নবজাতকের জন্ম যদি পথে ঘাটে হয় । সভ্য সমাজের কোন মানুষ যদি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে না আসে। সেটাও দুঃখজনক। পাগলীর যে কোন প্রয়োজনে তিনি আমজাদকে সাহায্য করবেন। সব মিলিয়ে আমজাদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যেভাবে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন সে জন্য ওই পরিবারকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

About Author Information
আপডেট সময় : ০৬:৫৫:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর ২০২০
৯২৫ Time View

কালীগঞ্জে মানসিক প্রতিবন্ধি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আশ্রয় দিলেন দিনমজুর

আপডেট সময় : ০৬:৫৫:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর ২০২০

বিশেষ প্রতিনিধিঃ

গ্রামের পাশেই কোলা বাজার। সকাল বিকেল যখনই বাজারে যাই দেখা মেলে আনুমানিক ২২/২৩ বছরের এক মানষিক প্রতিবন্ধি মহিলার। কখনও ময়লা কাপড় চোপড় শরীরে জড়িয়ে আবার কখনও অর্ধলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় সে। আর মুখে বিড় বিড় করে কি যেন বলে যা বোঝার উপায় নেই। কেউ কিছু বললে কখনও তেড়ে আসে। আবার কখনও দেখা যায় ঠান্ডা মেজাজে। কিন্ত গত ৫ দিন আগে পরিচয়হীন এই প্রতিবন্ধি অসুস্থ হয়ে বিকেল হতে আমাদের গ্রামের রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। সে চোখ মেলিয়ে তাকাতে পারলেও তার ছিলনা কোন নড়াচড়া। তাকে দেখতে বিকেল থেকেই লোকজনের ভীড় ছিল। এরপর রাত গভীর হলে উৎসুক জনতা ও পথচারীদের ভীড় কমতে থাকে। কিন্ত সেও তো একটা মানুষ। কারও না কারও সন্তান বা বোন। এটা ভেবে বিবেকের তাড়নায় আমি আর চলে আসতে পারিনি। ওই রাতেই গ্রামের আরও কয়েক জনকে সাথে করে অসুস্থ পাগলীকে নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। কিন্ত কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগী দেখেই বললেন মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। এখন তার পর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়া আর বিশ্রাম দরকার। দেয়া হলো প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা। এরপর বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠতেই বেডে শুয়েই সে শুরু করে অসহ্য পাগলামী। অস্থির করে তোলে গোটা হাসপাতাল এলাকা। বাধ্য হয়ে গাড়ি ভাড়া করেই আবার তাকে নিয়ে বাজারে ফিরি। কিন্ত পোহাবে পাগলীর যন্ত্রনা। এলাকার সবাই ঝামেলা এড়াতে পারলেও আমি পারিনি। অসুস্থ পাগলীকে বিবেকের তাড়নায় আর বাজারে ছেড়ে দিতে পারিনি। প্রতিবন্ধির গর্ভের সন্তানের কথা চিন্তা করে আমার অভাবের সংসার হলেও নিজের বাড়িতে এনে রেখেছি। শত অভাবের মধ্যেও সে এখন আমার পরিবারের আরেক সদস্যের মত। কথাগুলো বললেন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ময়ধরপুর গ্রামের মৃত সালামত আলীর ছেলে আমজাদ আলী।

রবিবার বিকেলে সরেজমিনে আমজাদ আলীর বাড়িতে গেলে দেখা যায়, মাটির উপর টিনের ছাউনির একটি ঘরের বারান্দায় স্থির হয়ে বসা রয়েছে এই প্রতিবন্ধি। পাশেই রয়েছে খাবারের একটি থালা। মানুষ সামনে গেলেই শুধু মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকছে। আর মুখে হালকা শব্দ করে কি যেন বলছে। যা বোঝা যাচ্ছে না।

আমজাদ আলী জানান, আমি একজন গরীব মানুষ। মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি নেই। সারা বছর পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করে সংসার চালাই। এক মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে মেয়ে লাবনীর বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে সালমান শাহ রাজমিস্ত্রির কাজ করে। কিন্ত সে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রায় ৬ মাস ধরে শয্যাশায়ী। ফলে এখন শুধু একার রোজগারে সংসার চালাতে হচ্ছে। অভাব তো সারাবছরের জন্য রয়েইছে। তারপরও নিজেরা যেভাবে থাকি খাই সেটা না হয় পাগলির সাথে ভাগাভাগি করে খাবো।

তিনি বলেন, এমনটা যদি আমার মেয়ের হতো তাহলে তো আমাকেই দেখতে হতো। পথে পড়ে থাকা অসুস্থ পাগলীকে অনেকে দেখেছে যাদের সামর্থও আছে। কিন্ত কেউ যখন তাকে নিয়ে ভাবেনি তখন আমি তার গর্ভের সন্তানের কথা ভেবে রাস্তায় ছেড়ে দিতে পারিনি। শনিবার তার আলট্রা সনোগ্রাফী করা হয়েছে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক বলেছেন মেয়েটি ৮ মাস গর্ভবতী। চিকিসকের পরামর্শ অনুযায়ী পাগলীর ব্যবস্থাপত্র দেয়া হচ্ছে।

আমজাদ হোসেনের স্ত্রী ছাকিরন নেছা জানান, মেয়েদের গর্ভপাতের সময়টা অত্যন্ত কষ্টের। এমন অবস্থায় মেয়েটি পথে পথে ঘুরে বেড়াবে ভাবতেও খারাপ লাগছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পাগলীর থাকার জন্য নিজেদের মত করে ঘর নির্মান করা হচ্ছে। নিজেদেরকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে । তারপরও একজন মা হিসেবে একজন মেয়ের জন্য যা করা দরকার শত অভাবের মধ্যদিয়েও সামর্থ অনুযায়ী তা করছেন।

প্রতিবেশি পল্লী চিকিৎসক অশ্বিনী বিশ্বাস জানান, তাদের গ্রামের আমজাদ নিতান্তই একজন গরীব মানুষ। তারপরও সমাজের একজন মানুষ হিসেবে একজন অসহায় মানষিক প্রতিবন্ধিকে আপন করে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি প্রতিদিনই আমজাদের বাড়িতে গিয়ে ওই পাগলীর খবর নিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, পরিচয়হীন পথে ঘাটে ঘোরা ওই মানষিক প্রতিবন্ধি হয়তোবা কোন পশুবৃত্তির মানুষ দ্বারা এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে তার গর্ভের সন্তান তো কোন অপরাধ করেনি।

কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ূব হোসেন জানান, বাজারে ওই পাগলী বেশ কিছুদিন ঘোরাফেরা করছে। কিন্ত সে অসুস্থ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকার পর ওই গ্রামের আমজাদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন তাকে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন নিজের পরিবারের সদস্যের মত তারা সেবা করছেন। এটা শুনেও ভালো লাগছে।

তিনি বলেন, এক শ্রেণীর মানুষরুপী অমানুষদের পাশবিক নির্যাতনে এমনটি ঘটতে পারে বলে তার ধারনা। এখন পাগলীকে ছেড়ে দিলে সে হয়তো ঘুরে বেড়াতে পারবে কিন্ত পথে ঘাটে সন্তান প্রসব করলে ওই সন্তানকে কে দেখবে। আবার নবজাতকের জন্ম যদি পথে ঘাটে হয় । সভ্য সমাজের কোন মানুষ যদি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে না আসে। সেটাও দুঃখজনক। পাগলীর যে কোন প্রয়োজনে তিনি আমজাদকে সাহায্য করবেন। সব মিলিয়ে আমজাদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যেভাবে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন সে জন্য ওই পরিবারকে ধন্যবাদ দিতে হয়।