সমাজের সহায় সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো, প্রকৃত হতদরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগীতা প্রদান, নিরুপায় রোগীদের জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও রক্তদান, প্রতিবন্ধিদের হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ ভাবে থাকতে পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরী করে দেয়া, প্রতিযোগীতার মাধ্যমে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা খুঁজে বের করে তাদেরকে পুরষ্কৃত করা, এমন অসংখ্য মানবিক সহযোগীতায় এগিয়ে আসা প্রায় ৮৪ হাজার সদস্যের ফেসবুকভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা গ্রুপের ৭ বছর পার হলো। ৮ বছর পদার্পন উপলক্ষে রবিবার বিকেলে মেইন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন অস্থায়ী কার্যালয়ে কেক কাটা হয়। এ সময় একাধিক এডমিনসহ সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কালীগঞ্জ আঞ্চলিক ভাষা গ্রুপের একাধিক সদস্যদের সূত্রে জানাগেছে, কয় বন্ধু মিলে বিগত ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল গ্রুপটি খোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ভালো। তাদের ভাষ্য, প্রতিটি এলাকার বাসিন্দাদের আঞ্চলিক ভাষা আছে। অনুরুপভাবে এ অঞ্চলের মানুষেরও পৃথক আচার অনুষ্ঠান, ভাষা সংস্কৃতি রয়েছে। এ মানুষগুলোকে একই সুতোঁয় গেঁথে নিয়ে এলাকার ভিতরের সত্যিকার অসহায় মানুষকে সাহায্য করাই হবে গ্রুপটির লক্ষ্য। তারা জানান, এটি প্রথম দিকে হালে পানি না পেলেও গ্রুপটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮৪ হাজার।
সদস্যরা বেশির ভাগই এ অঞ্চলের হলেও একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রবাসীরা। গ্রুপটির মানবিক কাজ পরিচালনায় তারাই বেশি ভূমিকা রেখে থাকেন। তাদের দাবি,কালীগঞ্জ আঞ্চলিক ভাষা গ্রুপই এ এলাকার অসংখ্য গ্রুপের মধ্যে অধিক সদস্যের।
উপজেলার ছোট ভাটপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র আব্বাস আলী জানান, তিনি একজন হতদরিদ্র মানুষ। গত ২০২১ সালের ১৩ আগস্ট ঘরে আগুন লেগে সবকিছু ছাই হয়ে যায়। এরপর ছোট ছোট ৩ টি সন্তান নিয়ে খোলা আকাশের নীচে পলিথিন টানিয়ে ঘুমাতাম। আমাদের কষ্টের খবর পেয়ে কালীগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা গ্রুপের কয়েকজন সদস্য আমার বাড়িতে ছুটে আসেন। তারা আমার পরিবারের অসহায় অবস্থা দেখে নিজেদের গাঁটের টাকায় বাড়ি করে দেন। তারা বলেন,আমার কোন উপায় ছিলনা। তাদের উপকারের কথা কখনও ভুলতে পারবো না।
একই উপজেলার কমলাপুর গ্রামের রুহুল আমিন জানান, ধারদেনার মাধ্যমে অনেক কষ্টে একটি ইজিবাইক কিনেছিলাম। এতে যাত্রীবহন করে আমি সংসার চালাতাম। কিন্ত গত ২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী শহরের চিনিকল এলাকা থেকে আমার ইজিবাইকটি চুরি হয়ে যায়। এতে আমি একেবারে পথে বসে যায়। সংসার চালানো নিয়ে আমি মহাচিন্তায় পড়ে শুধু কাঁদতাম। পরে আমার পারিবারিক দুরাবস্থা দেখে কালীগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষাগ্রুপ তাদের নিজেদের টাকায় ওই বছরের ৯ মার্চ আমাকে নতুন আরেকটি ইজিবাইক কিনে দেন। তিনি বলেন, তাদের এমন কাজ চলমান থাকলে সত্যিই অসহায় মানুষের উপকার হবে।
উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা গ্রামের মাসুদ হোসেন জানান, করোনাকালে আমার স্ত্রী ফেরদৌসি বেগম ও মেয়ে সানজিদা খাতুন করোনায় আক্রান্ত হলে পরিবারের জন্য বিরাট এক কষ্ট নেমে আসে। সময়টাতে মানুষ এ মহামারি থেকে বাঁচতে চরম ভয়ের মধ্যে ছিল। আক্রান্তদের পরিবারের ধারে কাছেও কেউ যেতো না। একপর্যায়ে আমার স্ত্রী ও সন্তানের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কালীগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষাগ্রুপের সদস্যরা নিজেরা বিনামূল্যে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বাড়িতে দিয়ে যান। তিনি বলেন, শুধু আমার পরিবারই না সে সময়ে খবর পেলেই করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার তারা পৌছে দিয়ে চরম উপকারে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার পরিবারের এমন দুরাবস্থা পূর্বে কোনদিন আসেনি। সে সময়ে তারা যে উপকার করেছে তাদের জন্য সব সময় প্রার্থনা করি।
একই উপজেলার বাকুলিয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী তানজির হোসেন জানান,তার চায়ের দোকানে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্থ হলে কালীগঞ্জ আঞ্চলিক ভাষাগ্রুপ আমাকে নগদ ২০ হাজার টাকা প্রদান করে আমার দোকানে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন।
কালীগঞ্জ আঞ্চলিক ভাষা গ্রুপের এ্যাডমিন শাহারিয়ার আলম সোহাগ জানান, তারা মাতৃভাষাকে সম্মান দেখিয়ে গ্রুপের এ নামটি দেন। প্রথম দিকে অল্প কিছু সংখ্যক সদস্যদের নিয়ে পথচলা শুরু হয়। কিন্ত পরে বৃদ্ধি পেয়ে এখন আমাদের সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ৮৪ হাজার। তিনি বলেন, অসংখ্য প্রবাসী আমাদের গ্রুপের সদস্য বন্ধু। মুলত আমরা গাঁটের টাকায় এ সকল মানবিক কাজ করে আসছি। তিনি আরও বলেন, সত্যিকারের নিরুপায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেদেরও ভালো লাগে।
ঝিনাইদহ আদালতে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর তোহিদুল ইসলাম সৌরভ জানান, সারাবিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখন ইন্টারনেট সাথে আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারনে দুরদেশের মানুষও এখন কাছের মনে হয়। তিনি বলেন,কালীগঞ্জের কতিপয় যুবকের উদ্যোগে গড়া ফেজবুকভিত্তিক আঞ্চলিক ভাষা গ্রুপটি নানা ধরনের মানবিক কর্মকান্ড করে আসছে। যে কারনে তাদেরকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়।
সবুজদেশ/এসইউ