কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগের বেহাল অবস্থা !
সবুজদেশ ডেক্স: ডাঃ সম্পা, তিনি যে কোথায় আছেন, তা কেউ বলতেও পারেন না। ৪ বছর আগে সেই যোগদানের পরদিন থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ। কিন্তু তবুও তার সেই সরকারী চাকুরীটি কাগজে এখনো বহাল আছে। আর কর্মস্থলে কাজ না করেই বেতন ভাতা তুলছেন ৫ ডাক্তার ও ৩ নার্স সহ অনেকেই। এভাবেই বছরের পর বছর এমন অনিয়মের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে বর্তমানে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের চরম বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলেছে এসব অনিয়মের পেছনে শক্ত খুটি হয়ে রয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের একটি অসৎ চক্র। চক্রটির সহযোগিতায় ডেপুটেশন (প্রেষন) নামের এক তেলেসমাতি কাগজের বদৌলতে কাজ না করেই ওইসব ডাক্তার নার্সগন নিজ বাড়িতে থেকেই বেতন ভাতা তুলতে পারেন। তবে সরকারী নিয়োগ মোতাবেক ওই সকল ডাক্তার নার্সদের কর্মস্থল কালীগঞ্জ দেখানো হলেও বাস্তবে তারা রয়েছেন অন্য জেলা শহরে। আর ডেপুটেশন বা প্রেশনের কাগজটিতে অন্য জেলাতে কাজ করার কথা বলা হলেও মুলত সেখানেও শুভংকরের ফাকি দিয়ে ব্যাক্তিগত কাজ করে বেড়ান তারা। এদিকে এসব নানা অনিয়মে স্বাস্থ্য সেবার এমন বেহাল চিত্র দেখে খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন কমিটির সভাতেই সদস্যগন তিরষ্কার করছেন। তাদের একাধিক মাসিক সভাতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া সহ ডেপুটেশন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এমকি সর্বশেষ স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও রেজুলেশন করে ডেপুটেশন বাতিলের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে একাধিক চিঠি প্রেরন করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের আইনের মারপ্যাচে অদ্যাবধি তাও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। সেকারনে ৬ ডাক্তার আর ৩ নার্সের ডেপুটেশন কারসাজিতে বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় উপজেলায় স্বাস্থ্য সেবার খাতটি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ বিভাগ সহ একাধিক সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার বলরামপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ সানজিদা ইয়াসমিন সম্পা যোগদানের পরদিন থেকে এ পর্ষন্ত ৪ বছর নিরুদ্দেশ রয়েছেন। কিন্তু তার সরকারী চাকুরিটি একনো বহাল থাকায় ওই স্থানে নতুন কোন নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। আর কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার আতিকুর রহমান গত ২ বছর আগে যোগদানের কিছুদিন পরই চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তাই সেখানেও নিয়মের বেড়াজালে পড়ে নতুন ডাক্তার যোগদান করতে না পারায় নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নে ১১ জন মেডিকেল এ্যাসিসটেন্ট (সেকমো) এর মধ্যে প্রেসনের কাগজ করে ৪ জনই রয়েছেন অন্য জেলা শহরে। এদের মধ্যে জামাল ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ ইয়াসমিন আরা রয়েছেন কুষ্টিয়ার মিরপুরে, কোলা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ জয়নাল আবেদিন রয়েছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে, সুন্দরপুর দূর্গাপুর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ তাসলিমা খাতুন রয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ও সিমলা রোকনপুর উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ মাহবুবুর রহমান রয়েছেন ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডুতে। এরাও কাজ না করে প্রতি মাসে বেতন ভাতা তুলে নিচ্ছেন। তবে কাজ না করেই মাস বছরের পর বছর বেতন ভাতা তুলে নেবার পেছনে এদের সবারই রয়েছে ডেপুটেশন নামের এক তেলেসমাতী রক্ষাকবজ। একই ভাবে কালীগঞ্জ হাসপাতালের ৩ জন নার্স শাহানাজ পারভীন, হালিমা খাতুন ও লক্ষীরানী বিশ^াস ডেপুটেশন নিয়ে দীঘদিন বাইরে রয়েছেন। তারাও প্রতিমাসে এসে বেতন ভাতা তুলে নিয়ে যান। ডেপুটেশন বা প্রেষনে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসারদের মধ্যে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে থাকা জয়নাল আবেদিন জানান, তার স্ত্রীও দৌলতপুরে একই চাকুরী করেন। ছেলে মেয়ে বাবা মা সহ পরিবারের দেখাশুনার জন্য তিনি ডেপুটেশন নিয়ে সেখানে আছেন। ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডুতে ডেপুটেশনে থাকা মাহবুবার রহমান জানান, ব্যাক্তিগত অসুস্থতার কারনে তিনি নিজ জেলার কাছের উপজেলাতে প্রেষনে এসেছেন। আর কুষ্টিয়ার মিরপুরে থাকা ইয়াসমিন আরার ব্যাক্তিগত মোবাইল ফোনটি বন্ধ থাকায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এদের প্রায় সবাই পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে ডেপুটেশন নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এমন নানাবিধ সমস্যার বেড়াজালে আটকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য সেবার হাল এখন বড়ই নাজুক অবস্থায় আছে। এসব অনিয়মের খবরে গত ২ মাস আগে দুদকের ঢাকা প্রধান কার্ষালয়ের একটি টিম কালীগঞ্জ হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছিল। সরেজমিনে দুদক টিম নানা অনিয়ম পেয়েছিল। এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিবে বললেও সেটাও অদৃশ্য কারনে কাগজে ফাইলে আটকে আছে। এসব বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ হুসায়েন শাফায়াত জানান, তিনি যোগদানের আগে থেকেই দেখছেন ওইসব ডাক্তার, নার্সগন ডেপুটেশন নিয়ে বাইরে থাকেন। এ নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কমিটির একাধিক সভাতে কথা উঠায় সর্বশেষ তিনি সভার সিদ্ধান্তে ডেপুটেশন বাতিলের এক রেজুলেশন করেছেন। তিনি রেজুলেশন কপিটি জেলা সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে পাঠালেও অদ্যবধি কোন উত্তর আসেনি বলে জানান। ”ডেপুটেশন” কাগজ সংক্রান্ত বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ রাশেদা খাতুন বলেন, অনেক ইউনিয়নে ডাক্তারদের বসার জায়গা সংকট। এছাড়া ঢাকার ডি জি অফিস থেকে ডেপুটেশন অর্ডার কপির বিপক্ষে তার কিছুই করার নেই। ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে সেবাদান সমস্যার বিষয়টি তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে অবহিত করেছেন। তবে নিরুদ্দেশ ডাঃ সম্পার চাকুরিটি এখনো বহাল থাকার কথা স্বীকার করলেও ওই ডাক্তার সম্পা আর চাকুরী ফিরে পাবে না বলে জানান। আর ডাক্তার থেকেও নেই এমন বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সূবর্ণা রানী সাহা জানান, তিনি এ উপজেলাতে নতুন যোগদান করেছেন। আগামী সমন্বয় কমিটির সভাতে বিষয়টি আলোচনা করে পদক্ষেপ নিবেন বলে জানান। হাসপাতাল স্বাস্থ্য কমিটির প্রধান উপদেষ্টা এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার জানান, তিনি ইতিমধ্যে হাসপাতালটির সকল সমস্য লিখিত ভাবে অবহিত হয়েছেন। এবং গত স্বাস্থ্য কমিটির মাসিক সভাতে আর কাউকে ডেপুটেশন দেওয়া বন্ধ সহ তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে সকল ব্যাবস্থা গ্রহন করবেন বলে জানিয়েছেন।