কুরবানীতে পশু জবাইয়ের বিকল্প নেই কেন?
ফারুক নোমানীঃ
কুরবানী ইসলামের অন্যতম একটি ইবাদত। সক্ষম ব্যক্তির জন্য কুরবানীর দিনে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কুরবানী করা আবশ্যক। এটি শুধু উম্মতে মুহাম্মাদির উপরই বিধিবদ্ধ এমন নয়, বরং তা পূর্ববর্তী নবীদের শরিয়তেও ছিলো। কুরবানীতে পশু জবাই এটা যেমন ধর্মীয় আদেশ, আবার এর জাগতিক উপকারও রয়েছে অনেক। অথচ কুরবানীর সময় হলে কিছু মানুষ পশুর প্রতি অতি দরদীভাব প্রদর্শন করেন। কিন্তু এই পশু দরদীরা ঠিকই খাসি ও মুরগীর মাংশ বড় আয়েশেই ভক্ষণ করেন। গোমাংশের প্রতিও তাদের আলাদা আকর্ষণ আছে। আমরা ইনশা আল্লাহ কুরআন সুন্নাহ ও যুক্তির আলোকে দেখবো ইসলামে পশু কুরবানী করাটাই বিধিবদ্ধ ও যুক্তিসংগত।
কুরআনের আলোকে কুরবানীতে পশু জবাই:
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। ইসলামের প্রতিটি ইবাদতই পূর্ণতা পেয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মের ভেতর এখন কোন রকম সংযোজন ও বিয়োজনের কোন আবকাশ নেই। এ সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন-‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে করলাম পূর্ণ এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলামকে করলাম মনোনিত।’ (সূরা মায়েদা ৩)
ইসলাম ধর্মে কুরবানীতে সরাসরি পশু জবাইয়ের আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-‘অতএব আপনি আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন ও কুরবানী করুন।’ (সূরা কাউসার ২)
এখানে ‘নাহর’ শব্দের অর্থ উট বা অন্য প্রাণী জবাই করা।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই।’ (সূরা হজ ৩৭)
তাই স্পষ্ট করেই আমরা বলতে পারি, পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কুরবানী করা এটা সরাসরি আল্লাহর আদেশ।
হাদীসের বিবরণে কুরবানীর পশু জবাই:
ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হলো হাদীস। কুরআনুল কারীমের পর আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে কুরবানীর পদ্ধতিটি দেখবো। তিনি কিভাবে কুরবানী করতেন?
কুরবানী সম্পর্কে নবীজী সা. ইরশাদ করেন- ‘কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। জবাইয়ের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও।’ (তিরমিযী ১৫৬৭, ইবনে মাজাহ ৩১২৬)
অন্য হাদীসে বলেছেন-‘কেউ (ঈদের) নামায আদায়ের আগে জবাই করলে সে যেন (নামাযের পর) পুনরায় জবাই করে।’ (সহীহ বুখারী ৫৫৪৯, সহীহ মুসলিম ১৯৬২)
নবীজী সা. নিজেও প্রত্যেক বছর কুরবানী করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন- ‘রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় দশ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন।’ ( তিরমিযী ১৫০৭, মুসনাদে আহমাদ ৪৯৫৫)
আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন-‘রাসূলুল্লাহ সা. দুটি সাদা-কালো বর্ণের নর দুম্বা কুরবানী করেছেন এবং বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলেছেন। আর আমি দেখেছি যে, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে নিজ হাতে সেগুলো জবাই করেছেন।’ (সহীহ বুখারী ৫৫৫৮, সহীহ মুসলিম ১৯৬৬, সুনানে নাসায়ী ৪৩৮৭)
পাঠক, পৃথিবীর শক্তিধর নানা রাষ্ট্রে খাবারের জন্য পশু হত্যা করা হয়। তবে এই পশু হত্যা হয় নিমর্মভাবে, যন্ত্রণা দিয়ে। গুলি করে, গরম পানিতে ছেড়ে দিয়ে, ইলেকট্রিক শক দিয়ে, মাথায় আঘাত করে, জ¦লন্ত আগুনে পুড়িয়ে। অথচ ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সা. জবাই করার সময় পশুকে কষ্ট দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
এ সম্পর্কেই শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। এতএব, যখন তোমরা (কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে) হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর, যখন জবাই করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে জবাই কর। এবং প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে, যেন জবাইয়ের প্রাণির বেশি কষ্ট না হয়।’ (সহীহ মুসলিম ১৯৫৫, আবু দাউদ ২৮১৫, তিরমিযী ১৪০৯, নাসায়ী ৪৪০৫)
মোটকথা আমরা নবীজী সা. এর জীবনচরিত দেখলে স্পষ্ট ধারণা পাই যে, তিনি মদীনার দশ বছরের জীবনে প্রতি বছর কুরবানী করেছেন এবং পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই কুরবানী করেছেন। ইসলামের ইতিহাস ও হাদীসে এমন কোন নজির নেই যে, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ভিক্ষে তিনি পশু জবাই না করে তার মূল্য দান করার মাধ্যমে কুরবানী পালন করেছেন। বরং কিছু হাদীস এমনও আছে যে, একবার দুর্ভিক্ষের কারণে তিনি মানুষদেরকে তিনিদিনের বেশি কুরবানীর গোস্ত জমা রাখতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কুরবানীর বিকল্প হিসেবে অর্থ দানের স্পষ্ট ও অস্পষ্ট কোন আলোচনাই তিনি করেননি। তাই কুরবানী পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই হবে এটাই কুরআন ও হাদীসের সিদ্ধান্ত। এখানে হাত ঢোকানোর অধিকার কারো নেই।
কুরবানীতে পশু জবাইটাই যৌক্তিক:
যারা অসহায় মানুষের অবস্থা বিবেচনা করে পশু জবাই না করে তার অর্থ দান করে দিতে বলেন, তারা একটি অবস্থার কারণে এমনটি বলেন। কিন্তু কুরবানীতে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে অনেক মানুষকেই সহযোগিতা করা হয়।
পশু কুরবানীর মাধ্যমে নানা ধরনের মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়, যা অন্য কোন উপায়ে সম্ভব ছিলো না।
১। খামারী ও পশু ব্যবসায়ীকে রক্ষা করা। দেশে হাজারো খামারী আছেন যারা পুরো বছর ব্যাংক থেকে লোন করে অথবা মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে পশু পালন করেন। লক্ষ্য থাকে একটাই কুরবানীর বাজার ধরা। তাই পশু না কিনে সে টাকা যদি অভাবী মানুষের মাঝে বিতরণ করে দেয়া হয়,তাহলে এসকল খামারী দেউলিয়া হয়ে পথে বসবে। সুতরাং খামারী ও ব্যবসায়ীদের কল্যাণে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কুরবানী করাটাই মানবিক।
২। অসহায় মানুষের গোস্তের চাহিদা মিটানো। সমাজে অনেক এমন মানুষ আছে যারা পয়সার অভাবে গোস্ত কিনে খেতে পারে না। কুরবানীতে পশু জবাই হলে এসকল মানুষ বিনা পয়সায় মনভরে গোস্ত খেতে পারে। আর এর মাধ্যমে এ শ্রেণীর মানুষের গোস্তের চাহিদা পূরণ হয়।
৩। এতিম ও দুঃস্থ বাচ্চাদের উপকার। এমন কোন শহর নেই যেখানে এতিমখানা নেই। প্রতিটি শহরেই গড়ে উঠেছে এতিম ও দুঃস্থ বাচ্চাদের প্রতিপালনে সরকারী ও বেসরকারী এতিমখানা। এতিমখানার বাচ্চাদের খাবার ও লেখাপড়ার যে খরচ তার বড় একটি অংশ আসে দানকৃত কুরবানীর চামড়া থেকে। সুতরাং কুরবানীতে পশৃু জবাই বন্ধ হলে চরম ঝুকিতে পড়বে দেশের এতিমখানাগুলো। বন্ধ হয়ে যেতে পারে হাজারো এতিমের মানুষ হয়ে ওঠা।
৪। চামড়া শিল্পে দেশকে সমৃদ্ধ করা। চামড়া শিল্প একটি সম্ভবনাময় শিল্প। রাষ্ট্রের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চামড়া শিল্পে দেশ হতে পারে সমৃদ্ধ। দেশের চাহিদা পূরণের পর তা বর্হিবিশ্বেও রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
মোটকথা: কুরবানীতে পশু জবাই যেমন কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ, সাথে সাথে তার সাথে জড়িয়ে আছে সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষের নানাবিধ কল্যাণ। তাই কুরবানীতে পশু জবাইয়ের বিধানটিই চূড়ান্ত, এখানে নতুন করে বিকল্প চিন্তার কোন অবকাশ নেই।
লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।