ফারুক নোমানীঃ

ত্যাগের অনন্য শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর আসে কুরবানী। কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা হলো ভোগ নয়, ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃত আনন্দ উদযাপন করা। অন্য ধর্ম আর ইসলামের মধ্যে পার্থক্যটা এখানেই। অন্য ধর্মে ধর্মীয় দিবস উদযাপন শুধু ভোগের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ইসলামের শিক্ষা হলো মুসলিমদের আনন্দ উদযাপন যেন শুধু ভোগসর্বস্ব না হয়ে পড়ে। তাই দুইটি ধর্মীয় আনন্দের দিনে জোরালোভাবে ত্যাগের আদেশও করেছে ইসলাম। ইসলাম ঈদুল ফেতরের আগে যেমন আদেশ করেছে ফিতরা প্রদানের, একইভাবে অসহায় দুঃস্থ মানুষের মাঝে কুরবানীর গোস্ত বিতরণের কথাও বলেছে ঈদুল আযহায়। ঈদের আনন্দ যেন ধনী শ্রেণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ না হয়ে পড়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধনী গরিব সকলের জন্যেই ঈদের নির্মল আনন্দ যেন উপভোগ্য হয়ে ওঠে, সে শিক্ষাই দিয়েছ ইসলাম। কারণ, যেখানে ত্যাগ নেই সেখানে প্রাপ্তির আনন্দটা যেন অপূর্ণই থেকে যায়।

পাঠক, বড় মমতা দিয়ে মানুষ বাড়িতে লালন পালন করে গরু বা ছাগল। সেই শুরু থেকে একটি মানব সন্তানের মতো পরম মমতায় বড় করে তোলেন গৃহকর্তা একেকটি চতুষ্পদ গৃহপালিত প্রাণীকে। সময় মতো খাদ্য পানীয় সরবরাহ করতে কখনো ক্লান্তিবোধ করেন না মালিক। এভাবেই একটি চতুষ্পদ প্রাণীর সাথে গৃহকর্তার গড়ে ওঠে গভীর সম্পর্ক। বড় ভালোবাসা দিয়ে বড় করা এমন একটি প্রাণীর গলায় যখন মালিক শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই ছুরি চালান, তখন তার মনের অবস্থাটা কেমন হয়? ভূক্তভোগী ছাড়া কে বা বুঝবে এই মর্মজ¦ালা! এটাই তো ত্যাগ, এটাই কুরবানী।

একই কথা হলো কঠোর পরিশ্রম করে অর্জিত হালাল টাকার মালিকের ক্ষেত্রেও। অন্ধকারে অনেক কালো টাকা কামাই করা যায়, কলমের মারপ্যাচে অথবা টেবিলের নিচ থেকে আসে অনেকের মোটা মোটা বাণ্ডিল। তবে কপালের ঘাম ঝরিয়ে, রক্ত পানি করে বৈধ উপায়ে যে টাকা মানুষ কামাই করে, উভয়ের মাঝে আছে আকাশ আর মাটির পার্থক্য।

পরিশ্রমের একটি টাকার মূল্যও অনেক। কারণ এখানে টাকার পরমাণটা মুখ্য নয়, বরং বৈধ পন্থায় কষ্ট করে উপার্জন করাটাই মূল বিষয় থাকে। তাই সহজেই এ ধরনের স্বচ্ছ টাকার প্রতি মানুষের আলাদা একটা আকর্ষণ থাকে। আর ত্যাগের পরীক্ষাটা তো এখানেই। কারণ কুরবনীসহ সকল ভালো কাজের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ হলো তা হালাল বা বৈধ অর্থ থেকেই সম্পাদন করতে হবে।

সুতরাং নিজগৃহে পালিত পশু হোক অথবা নিজের কর্ষ্টাজিত বৈধ টাকায় কেনা পশু হোক তা কুরবানী করা আসলেই ত্যাগের অনন্য পরিচয় দান করে। আর এই ত্যাগের ভেতরে যে অপার্থিব আনন্দটা রয়েছে তা শুধু অনুভবই করা যায়, ভাষা দিয়ে বলে বুঝানো যায় না।

ইবরাহীম খলিলুল্লাহর কুরবানী:

আমরা যে কুরবানী করি, তা মূলত ইবরাহীম আ. এর সুন্নাত। আর হযরত ইবরাহীম আ. এর পুরো জীবনটাই কুরবানীর। ত্যাগ ও বিসর্জনের। তবে প্রতিটি পরীক্ষাই তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। দয়াময় আল্লাহ কুরআনের মোট ২৫ টি সূরার ৬৩ টি আয়াতে নবী ইবরাহীম আ. এর আলোচনা করেছেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল একজন মূর্তি নির্মাতার ঘরে। তার পিতা আযর নিজহাতে মূর্তি বানিয়ে তা বিক্রি করতেন। সাথে সাথে তিনি ছিলেন কট্টরপন্থী মূর্তিপূজারী। বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর ইবরাহীম আ. দেখলেন, নিজহাতে বানানো মূর্তিকেই মানুষ সেজদা করছে, তার কাছে সাহায্য চাচ্ছে, তার সামনে ভোগ রাখছে। কিন্তু মাটির তৈরি মূর্তি না পারে মানুষের কোন উপকার করতে আর না পারে তাদের ডাকে সাড়া দিতে। এমনকি তার খাবারও যদি মাছিতে নিয়ে যায় তাও ঠেকাতে পারে না মাটির মূর্তি। এটা দেখেই নবী ইবরাহীম পিতাকে বললেন-‘হে আমার পিতা, তুমি কেনো তার (এমন একটি অপদার্থের) ইবাদত করো যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোনই কাজে আসে না?’ এ কথা শুনে পিতা বললো, ‘হে ইবরাহীম তুমি কি আমারা দেবদেবী থেকে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তাহলে আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণ হরণ করবো। তুমি (যদি নিজের ভালো চাও তাহলে) চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও।’ (সূরা মারইয়াম )

ইবরাহীম আ. পিতার সত্য পথে আসার বিষয়ে যখন নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন সাধারণ মানুষকে অন্ধকারের পথ ছেড়ে আলোর দিকে ডাকতে লাগলেন। তারা তো তার ডাকে সাড়া দিলোই না বরং তারাও তাকে নানাভাবে হয়রানী করলো। শেষ পর্যন্ত তার বিষয়ে অভিযোগ উঠলো নমরুদের দরবারে। সেকালে ইরাকের বাদশার উপাধি হতো নমরুদ। নমরুদ প্রজাদের রাজাই শুধু হতো না, সে নিজেকে তাদের খোদা ও মালিক মনে করতো। তাকে দেবতা মনে করে তাকেও জনগণ পূজা করতো। নমরুদকে নবী ইবরাহীম আ. আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন। কিন্তু সে অযৌক্তিক তর্ক জুড়ে দিলো। একপর্যায়ে যখন নিজের কথায় নিজেই আটকে গেলো তখন বললো, তোমরা তোমাদের দেবতার সাহায্য করতে চাইলে তাকে আগুলে পুড়িয়ে ফেলো। সে সময়ের কথা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-‘আমি বললাম, হে আগুন ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’(সূরা আম্বিয়া ৬৯) আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন জ¦লন্ত আগুন থেকে। অবশেষে যখন তিনি নিজপিতা, সাধারণ মানুষ ও বাদশাহসহ সকলের থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লুতকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করলেন। সে সময়ে মিশরের বাদশাহকে বলা হতো ফেরাউন। তার লোকেরা নবী ইবরাহীম আ. ও সারাকে বন্দি করে। তবে একটি পর্যায়ে তাদেরকে স্বসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবং বাদশাহর মেয়ে হাজেরাকেও তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইবরাহীম আ. সারার অনুমতিক্রমেই হাজেরাকে বিবাহ করেন। কারণ তখনো পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। অতপর আল্লাহর কাছে তিনি নেককার সন্তানের জন্য দ্আু করলেন। আল্লাহ তাকে দান করলেন পুত্র সন্তান ইসমাইলকে। তখন ইবরাহীম আ. এর বয়স ছিলো ৮৭ বছর। সন্তান জন্মের পর শুরু হলো আরেকটি পরীক্ষার। আদেশ হলো শিশুপুত্র ও তার মাকে রেখে আসতে হবে জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে। সামান্য খেজুর আর একটি মশকে কিছু পানি দিয়ে তাদেরকে রেখে এলেন ছায়া মানবহীন মরুতে। ইবরাহীম আ. বিদায় নিচ্ছেন মুখে কোন কথা নেই। স্ত্রী হাজেরা পেছন থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলছেন, আমাদেরকে এই মৃত্যুর মুখে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি নীরব। মুখে কোন ভাষা নেই। আবার তাকাচ্ছেনও না পেছনে। তৃতীয়বার হযরত হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এখানে রেখে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যা। হাজেরা বললেন, তাহলে আর কোন কিছুতেই আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

শিশুপুত্র ও স্ত্রীকে রেখে আসা সেই জায়গাটির পাশেই ছিলো কাবা ঘর। কালের বিবর্তনে তার দেয়ালগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মরুর বালিতে ঢাকা পড়ে যায় তার ভিত। আল্লাহর আদেশে সেখানেই জেগে ওঠে যমযম কুপ। নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ এসে বসতি গাড়ে এই কুপের পাশে। সকলেই পরম শ্রদ্ধা সম্মান ও ¯েœহের চোখে দেখে হযরত হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাইলকে।

ইসমাইলের বয়স যখন তেরো, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ করা হয় যেন নবী ইবরাহীম তার প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করেন। একটির পর একটি পরীক্ষা চলছিলো ইবরাহীম আ. এর ওপর। তবে আগের পরীক্ষার তুলনায় অনেক বড় পরীক্ষা ছিলো এটি। বৃদ্ধ বয়সে জন্ম নেয়া একমাত্র পুত্রকে আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে হবে! কিন্তু তিনি আল্লাহর হুকুমের কাছে বরাবরের মতোই নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তিনি পুত্রের কাছে স্বপ্নের বৃত্তান্ত এবং আল্লাহ পাকের দেয়া নির্দেশ বর্ণনা করলেন। পুত্র ছিলেন পিতার মতোই। ততক্ষণাৎ তিনি আত্মসমর্পণের মস্তক অবনত করে দিলেন এবং বললেন, এটাই যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয়ে থাকে তবে ইনশা আল্লাহ আমাকে আপনি সহনশীল পাবেন। এই কথোপকথনের পর পিতা পুত্র নিজেদের কুরবানী পেশ করার জন্য অরণ্যের দিকে যাত্রা করলেন। পিতা পুত্রের সম্মতি পেয়ে জবাইয়ের পশুর মতো পুত্রের হাত পা বেঁধে ফেললেন। ছুরি ধার দিলেন এবং পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে জবাই করতে উদ্যত হলেন। ততক্ষণাৎ হযরত ইবরাহীম আ. এর ওপর আল্লাহর ওহি নাযির হলো। ‘হে ইবরাহীম, তুমি নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছো। নিঃসন্দেহে এটা বড় পরীক্ষা ছিলো। এখন পুত্রকে ছেড়ে দাও এবং তোমার কাছে এই দুম্বাটি দাঁড়িয়ে আছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটিকে জবাই করো। আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে এভাবেই বিনিময় দিয়ে থাকি।’ হযরত ইবরাহীম আ. পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন, ঝোপের কাছে একটি দুম্বা দাঁড়িয়ে আছে। ইবরাহীম আ. আল্লাহর শোকর আদায় করে সেই দুম্বাটি জবাই করলেন।

এটাই সেই কুরবানী যা আল্লাহর দরবারে এমনভাবে কবুল হয়েছে যে স্মৃতিস্মারক হিসেবে তা সবসময়ের জন্য ইবরাহীমি মিল্লাতের প্রতীক সাব্যস্ত হয়ে থাকলো। আজো পর্যন্ত ইসলামী বিশে^ দশই জিলহজ এই প্রতীকটি পালন করা হয়।

মূলকথা, আল্লাহ ইবরাহীম আ. এর সন্তানকে জবাই করতে চাননি, দেখতে চেয়েছেন তিনি আল্লাহর হুকুমকে কতটা গুরুত্ব দেন, পুত্রের মায়া না আল্লাহর হুকুম তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

কুরবানীর শিক্ষা:

ইবরাহীম আ. এর পুত্র ইসমাইলকে জবাই করা আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিলো না, উদ্দেশ্য ছিলো নবী ইবরাহীম আ.কে পরীক্ষা করা, ছেলের প্রতি ভালোবাসা না আল্লাহর হুকুম তার হৃদয়ে বেশি প্রবল! নবী ইবরাহীম আ. প্রিয় পুত্রের ওপর আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহর বিধানের কাছে তার সর্বস্বকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। বিন্দু পরিমাণ কুণ্ঠাবোধ করেননি। ফলে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। তাকে ‘খলিলুল্লাহ’ বা আল্লাহর বন্ধু সম্ভাষণে ধন্য করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন তিনি হলেন মুসলিমদের জাতির পিতা। পরবর্তী নবীগণ এসছেন তারই বংশধারা থেকে। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ নবী ইবরাহীমের নামকে স্মরণ করবে বড়ই শ্রদ্ধার সঙ্গে। সোজাভাবে বললে, আল্লাহ ইবরাহীম আ. এর ত্যাগের পূর্ণ প্রতিদান দিয়েছেন।

একই কথা আমাদের ক্ষেত্রেও। আমরা যে পশু জবাই করি, তা তো খাই আমরা নিজেরাই। আল্লাহর কাছে পৌছে না এর রক্ত মাংশ কিছুই। তবুও আল্লাহ কুরবানীর বিধান দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেছেন, মানুষ তার অর্থ সম্পদকে বেশি ভালোবাসে না আল্লাহর আদেশকে? তিনি দেখতে চান সম্পদের মায়া তার হৃদয়ে প্রবল, না আল্লাহর হুকুম? সে কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্যের শিক্ষা এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের দীক্ষা অর্জন করতে পেরেছে কিনা?

সে কথাটাই বলেছেন আল্লাহ কুরআনে কারীমে-‘বলে দিন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। (সূরা আনআম ১৬২)

অন্য আয়াতে বলেছেন- ‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের স্তরে উপনীত হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (সূরা আলে ইমরান ৯২)

এই কুরবানী আমাদেরকে শেখায়, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস কুরবানী করতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন, তেমনি আমরাও যেন আপন মনোবাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করি। এবং সব অবৈধ মনোবৃত্তি ও পাপাসক্ত মনোভাব ঝেড়ে ফেলি।

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here