কেন এত ‘গায়েবি মামলা’
সবুজদেম ডেক্সঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি পর্যন্ত প্রত্যেক নেতাকে মামলার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পুলিশ বাদী হয়ে সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘গায়েবি’ মামলা করছে। ঢাকা ও জেলা পর্যায়ের পুলিশের বেশ কিছু সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীর সম্ভাব্য এজেন্ট কারা এবং মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার সক্ষমতা কার আছে, এমন নেতা–কর্মীদেরও শনাক্ত করে মামলার আওতায় আনতে থানাপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও সূত্রগুলো বলছে।
এদিকে বিএনপির তৈরি এক হিসাবে দাবি করা হচ্ছে, গত এক মাসে সারা দেশে তাদের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এতে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত মিলিয়ে আসামির সংখ্যা ৩ লাখ ৬০ হাজার। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪ হাজার ৬০০ জন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠপর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনার ভিত্তিতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি ধরে ধরে মামলার আসামি করা হচ্ছে। এ কারণে কোনো কোনো মামলায় মৃত ব্যক্তি, হজে থাকা, বিদেশে থাকা, বয়োবৃদ্ধ, গুরুতর অসুস্থ হয়ে চলাফেরায় অক্ষম ও কারাগারে থাকা নেতা-কর্মীরাও আসামি হয়ে গেছেন, যা গণমাধ্যমে আসায় কিছুটা বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছে।
মামলা দেওয়া ছাড়াও নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতি জেলার জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্রগুলো জানায়, পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার দুজন কর্মকর্তা এ পরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন তদারকিতে যুক্ত আছেন। তাঁরা পর্যায়ক্রমে জেলা পুলিশ সুপারদের (এসপি) আলাদাভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে ডেকে এসব পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। এ ধরনের কোনো কোনো বৈঠকে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও উপস্থিত থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র, ডিআইজি (গণমাধ্যম ও পরিকল্পনা) রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেছেন, এটা ঠিক নয়। তবে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলার যাতে অবনতি না ঘটে, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য এসপিদের সঙ্গে বৈঠক হতেই পারে।
মাঠপর্যায়ের পুলিশের বেশ কটি সূত্র থেকে জানা গেছে, কয়েক মাস আগেই বিএনপির কমিটির তালিকা থানার পুলিশকে পাঠিয়ে প্রত্যেকের ঠিকানা যাচাই করতে বলা হয়। যাঁদের একাধিক ঠিকানা আছে, সেটাও বের করতে বলা হয়েছে। বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে আসা নেতা–কর্মীদের ছবি তুলতে বলা হয়েছে। পরে ছবি দেখে নেতা-কর্মীকে শনাক্ত করে, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নিবাচনে বিএনপির সম্ভাব্য এজেন্টদেরও শনাক্ত করে এবং বিগত বিভিন্ন নির্বাচনে যাঁরা বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট হয়েছেন, তাঁদেরও মামলার আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে থানা-পুলিশকে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এসব গায়েবি মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনের সময়ে নেতা-কর্মীরা যাতে মাঠে থাকতে না পারেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাতে প্রার্থী হতে না পারেন। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। তিনি বলেন, ‘আমরা তো মনে করি, এটা সরকারের নীলনকশা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় এসব মামলা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কিছু করছে না। আর বিএনপি অভিযোগ সব সময় করে। বেশির ভাগ অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে এ ধরনের কথিত গায়েবি মামলা দেওয়া শুরু করে পুলিশ। ৫ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি থানায় ‘ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকের’ অভিযোগ এনে বিএনপির ১২৪ নেতা-কর্মী এবং অজ্ঞাতপরিচয়ের আরও দুই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করে পুলিশ। সব কটি মামলায় এজাহারের বর্ণনা অভিন্ন। শুধু ঘটনাস্থল, আসামির নাম ও বাদীর নাম ভিন্ন। এতে বিদেশে ছিলেন, এমন ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে তখন ওই সব মামলা করা হয়েছিল। ওই সব মামলা নিয়ে গত ৩ এপ্রিল প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এরপর গত আগস্টে বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের কিছু মামলা হয়, তখন অনেকে গ্রেপ্তারও হন।
১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকার নয়াপল্টনে সমাবেশে বড় জমায়েত হওয়ার পর থেকে সারা দেশে ব্যাপকভাবে কথিত গায়েবি মামলা দেওয়া শুরু হয়। এতে দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদেরও আসামি করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীকেও আসামি করা হয়। অনেক মামলায় বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মীদের নামও আসামির তালিকায় এসেছে।
বিভিন্ন মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলাগুলোর এজাহারও প্রায় একই ছকে লেখা। গোপন বৈঠক, নাশকতার উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া, পুলিশ গেলে তাদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ ইত্যাদি অভিযোগে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এতে লাঠি, বাঁশ, ইটের টুকরাসহ কিছু আলামতও জব্দ দেখানো হচ্ছে।
এ ধরনের মামলা নিয়ে অভিযোগ হচ্ছে, কোনো ঘটনা ঘটেনি, এরপরও কল্পিত ঘটনার কথা উল্লেখ করে পুলিশ মামলা দিয়েছে। তাই এসব মামলা ‘গায়েবি মামলা’ হিসেবে লোকমুখে প্রচার পেয়েছে। বিএনপি এসব মামলাকে ‘ভৌতিক মামলা’ বা ‘কল্পিত মামলা’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো মানুষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া মামলা বা গ্রেপ্তার করা হলে তা আইনবহির্ভূত। আমাদের প্রত্যাশা, এভাবে কাউকে যেন কোনো প্রকার হয়রানি বা নির্যাতন করা না হয়।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৈরি করা এক হিসাবে দেখা যায়, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ১৩৫টি মামলা হয়েছে। এতে মোট আসামি ৩ লাখ ৬০ হাজার ৩১৪। এর মধ্যে এজাহারনামীয় আসামি ৮৫ হাজার ৬০৪ জন। অজ্ঞাত আসামি ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭১০ জন। এই সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪ হাজার ৬৫০ জন।
পুলিশের হিসাবে, গত এক মাসে সারা দেশে মোট মামলার সংখ্যা কত—এটা জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব প্রস্তুত করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে।
ঢাকার বাইরে ১৯ জেলা ও মহানগর থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ওই ১৯ জেলায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন মামলার সংখ্যা ১৮৭। মোট আসামি ১২ হাজার ৫৮ জন। গ্রেপ্তার ৪০৪ জন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীতে কমপক্ষে ১২৩টি মামলা হয়েছে। ঢাকার আদালত সূত্রে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, গত মাসের প্রথম ১২ দিনে ঢাকার ৩২টি থানায় ৮৬টি মামলা করে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করে ১৬৯ জনকে। রাজধানীর চকবাজার থানার এক মামলায় পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করার অভিযোগে ২৮ মাস আগে মারা যাওয়া বিএনপির নেতা আবদুল আজিজুল্লাহকে আসামি করা হয়। হজে ছিলেন, এমন ব্যক্তিও এই মামলার আসামি।
গত সোমবার ঢাকার ৩১টি থানায় ৩৭ মামলা হয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় ১৯৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মূলত গত রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসভা শেষে ফেরার সময় বিভিন্ন স্থান থেকে এঁদের আটক করা হয়। এর মধ্যে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির ৭ জন নেতাসহ ৫৫ জনকে আসামি করে। তাঁদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য, মগবাজার রেলগেট এলাকায় যানবাহন ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের ওপর হামলা এবং পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখমের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে ওই এলাকায় গেলে স্থানীয় লোকজন জানান, তাঁরা ওই দিন এমন কোনো ঘটনা দেখেননি বা শোনেননি। এই আসামিদের মধ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেশেই ছিলেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসও এ মামলার আসামি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা হচ্ছে হীরক রাজার দেশ, যা বলবে তাই হবে, হচ্ছে। পুলিশ আগেই মামলা কম্পিউটারে সাজিয়ে রেখেছে, এখন শুধু নাম বসিয়ে দিচ্ছে।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র উপমহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও পরিকল্পনা) রুহুল আমিন বলেন, এ অভিযোগ ঠিক নয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা বা তাঁকে ধরার কথা নয়। বিএনপির নেতাদের যদি মনে হয় যে অন্যায়ভাবে কাউকে আসামি করা হচ্ছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের ইউনিট প্রধানের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারেন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান তত বাড়বে। নির্বাচনের আগ দিয়ে এসব মামলা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। অজামিনযোগ্য এসব মামলায় গ্রেপ্তার হলে জামিনের জন্য নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে হবে। সব ধাপ পার হতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। তত দিনে নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে। এ ছাড়া এসব মামলায় এখন যেসব নেতা উচ্চ আদালত থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আগাম জামিন পাচ্ছেন, তাঁদের জামিনের মেয়াদ নির্বাচনের আগেই শেষ হয়ে যাবে। তখন তাঁদের আবার নিম্ন আদালতে যেতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ স্পষ্টত রাষ্ট্রের পুলিশের পরিবর্তে সরকারের পুলিশ হয়ে গেছে। এরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে ক্রমাগত যোগ্যতা হারাচ্ছে। ফলে নির্বাচনের সময় আমার ধারণা, সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করার পক্ষে বিভিন্ন দলের যে দাবি, তার যৌক্তিকতা বাড়ছে।’