ঢাকা ০৫:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কয়লার নামে ৮৫০ কোটি টাকা পানিতে

Reporter Name

৫ শতাংশ বেশি আর্দ্রতাসহ কয়লা কিনে প্রায় ৮৪৬ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)। এই খনির কয়লা উত্তোলনকারী চীনের দুই প্রতিষ্ঠানের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ৫ দশমিক ১ শতাংশ আর্দ্রতাসহ কয়লা কেনার চুক্তি করা হয়। কিন্তু কয়লা কেনা হয়েছে ১০ শতাংশ আর্দ্রতাসহ।

এদিকে গত জুলাইয়ে হঠাৎ জানা গেছে, খনির ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস নেই। মূলত এই খনির কয়লা দিয়ে চলা বড়পুকুরিয়া তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেলে এই ‘চুরি’ নজরে আসে। এই কয়লার আনুমানিক বাজারমূল্য ২৩০ কোটি টাকা। খনি কর্তৃপক্ষ শুরুতে একে সিস্টেম লস বা প্রক্রিয়াগত লোকসান বলে দাবি করে। কিন্তু খনির তদারকি সংস্থা পেট্রোবাংলা তদন্ত করে বলেছে, খনি কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই কয়লার যথাযথ হিসাব রাখেনি। ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে এই খনির কয়লা তোলা হচ্ছে।

বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের পর্ষদ সভার গত মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৩ বছরে এই খনি থেকে তোলা ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লা কিনেছে সরকার। ২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগে দেওয়া একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বড়পুকুরিয়া খনির কয়লায় ১০ শতাংশ আর্দ্রতা রয়েছে। কয়লার আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য রসায়নবিদ নিয়োগের কথা থাকলেও গত ১৩ বছরে এই পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে পূর্ণ আর্দ্রতায় (১০ শতাংশ) খনির কয়লা কিনেছে সরকার। চীনা দুই প্রতিষ্ঠান সিএমসি, এক্সএমসির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে পেট্রোবাংলার করা চুক্তির চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি আর্দ্রতায় কেনার ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টন বেশি ওজন কয়লার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। খোলাবাজারে প্রতি টন কয়লা ১৬ হাজার ৯২৭ টাকায় বিক্রি করে বিসিএমসিএল। এ হিসাবে ৫ লাখ টন কয়লার মূল্য ৮৪৬ কোটি টাকা।

বিসিএমসিএল সরেজমিন এবং খনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খনি থেকে কয়লা বুঝে নেওয়ার সময় ওজন ও আর্দ্রতা—দুটোই জানতে হয়। কিন্তু খনিতে কয়লার আর্দ্রতা পরীক্ষার জন্য কোনো রসায়নবিদ নেই। তবে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন কেমিস্ট বা রসায়নবিদ ছিলেন খনিতে। কিন্তু যেহেতু খনিতে তিন শিফটে (পালা) কয়লা তোলা হয়, তাই অন্তত তিনজন রসায়নবিদ থাকার কথা সেখানে।

জানতে চাইলে বিসিএমসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব আবুল কাশেম প্রধানীয়া প্রথম আলোকে বলেন, কেমিস্ট পদে একজন অস্থায়ী লোক ছিলেন অল্প কিছুদিনের জন্য। তিনি চলে যাওয়ায় আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে, বিশেষ করে যাঁর প্রতিবেদনের সঙ্গে সরকারের কোটি টাকা খরচের বিষয় যুক্ত, সেখানে কেন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে আবুল কাশেম কোনো জবাব দেননি।

১০ শতাংশ আর্দ্রতায় কয়লা কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি খনির কয়লায় চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি আর্দ্রতা থাকে এবং তা ওজন করার সময় বাদ দেওয়া না হয়, তাহলে কয়লার নামে আসলে আমরা আর্দ্রতা কিনেছি। আর্দ্রতা মাপার কথা কেমিস্টের। কিন্তু এ পদে কাউকে নিয়োগ না দেওয়া বেশ সন্দেহজনক।’

২৩০ কোটি টাকার কয়লা গায়েব
গত মাসে বড়পুকুরিয়া তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেলে কয়লা ‘চুরি’র বিষয়টি সবার নজরে আসে। এ ঘটনায় গঠিত সরকারি-বেসরকারি কমিটির সদস্যরা অবশ্য মনে করছেন, হদিস না মেলা কয়লা বাস্তবে খনি থেকে তোলাই হয়নি। কয়লা না তুলেই টাকা নিয়ে গেছে চীনা কনসোর্টিয়াম। আর এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খনি কর্তৃপক্ষের বড় কর্তারা।

কেনার হিসাব ধরলে তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে খনির মাঠ ছিল মজুতশূন্য। আর তাতেই ধরা পড়ে কয়লা ‘চুরি’র ঘটনা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ধরা পড়ার আরেক কারণ ছিল খনি বন্ধ থাকা। পুরোনো স্তরের কয়লা তোলা শেষ হওয়ায় খনির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় গত জুনে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে নতুন স্তর থেকে কয়লা তোলার কথা। এ প্রসঙ্গে ক্যাব গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মজুত কয়লা দিয়ে কোনোভাবে টেনেটুনে যদি সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ চালানো যেত, আর তখন নতুন কয়লা তোলা শুরু হয়ে যেত, তাহলে আর এই কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা জানাই যেত না।

এ ঘটনায় পেট্রোবাংলা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালককে (প্রশাসন) প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। আরেকটি তদন্ত কমিটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একটি কমিটি করেছে। সরকারি-বেসরকারি এসব কমিটির একাধিক সদস্য এ ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। পেট্রোবাংলা ছাড়া কোনো কমিটি এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

সরকারের কাছে জমা দেওয়া পেট্রোবাংলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খনি কর্তৃপক্ষ কয়লা তোলার যথাযথ হিসাবই রাখেনি। কারণ, তারা প্রথমে পেট্রোবাংলাকে বলেছিল, হদিস না মেলা কয়লা আসলে সিস্টেম লস বা প্রক্রিয়াগত লোকসান। কিন্তু পরে তারাই তাদের ১৯ জন পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কয়লা ‘চুরি’র অভিযোগে মামলা করেছে।

বিসিএমসিএলের গত ১১ জুলাইয়ের বোর্ড সভার কার্যপত্রে দেখা যায়, খনি থেকে গত ১৩ বছরে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫ টন কয়লা তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৫ টন কয়লার ঘাটতি হয়েছে, এটি উত্তোলিত কয়লার ১ দশমিক ৪২ শতাংশ।

এই ঘাটতির চারটি সম্ভাব্য কারণ দেখানো হয়েছে বোর্ড সভায়। এগুলো হলো অভ্যন্তরীণ তাপে কয়লা পুড়ে যাওয়া, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া, পরিমাপের সময় ভুল হওয়া ও গ্রীষ্মকালে বাতাসে কয়লা উড়ে যাওয়া। এসব প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সিস্টেম লস হতে পারে।

কিন্তু গত ১৫ এপ্রিল সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে এক সভায় খনি কর্তৃপক্ষ বলেছিল, সাধারণত কয়লাখনির সিস্টেম লস ২ শতাংশ হলেও বড়পুকুরিয়ার খনিতে সিস্টেম লসের পরিমাণ মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ।

এই অবস্থায় পেট্রোবাংলা ও মন্ত্রণালয় বিসিএমসিএলের কয়লা ঘাটতির এ ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি। এরই পরে গত ২৪ জুলাই খনি কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ‘চুরি’ হিসেবে অভিহিত করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর মডেল থানায় মামলা করে।

এর আগে কয়লার সিস্টেম লসের হিসাব নিতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে খনির মহাব্যবস্থাপক (সারফেস অপারেশন) এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও তারা তা দেয়নি।

এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব পরে বিসিএমসিএলের এমডিও হন। এখন বিসিএমসিএলের মামলায় তাঁকেই আসামি করা হয়েছে। সিস্টেম লস নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছিল, তবে তৎকালীন এমডি এম আমিনুজ্জামান বলেছিলেন, এখন প্রতিবেদন জমা দিতে হবে না, এ বিষয়ে আরও দেখতে হবে।

এই অভিযোগ অস্বীকার করেন বিসিএমসিএলের সাবেক এমডি মো. আমিনুজ্জামান। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি মিথ্যা কথা। আমি এ রকম কিছু বলিনি। কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।’

কয়লার হদিস না মেলায় ‘চুরি’ অভিধা দিয়ে কেন মামলা করা হলো, জানতে চাইলে খনি কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ও মাইন) সাইফুল ইসলাম সরকার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওপর থেকে বলা হয়েছে এভাবে মামলা করতে। আমরা আদেশ পালন করেছি।’

গত ১৩ বছরে ৭ জন এমডি খনির দায়িত্ব পালন করেছেন। পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে যথাযথ হিসাব না রাখার জন্য ৭ জন এমডিকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁদেরই একজন আবদুল আজিজ খান বর্তমানে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য। কয়লার আর্দ্রতা পরীক্ষার জন্য রসায়নবিদ কেন নিয়োগ করা হয়নি, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেমিস্ট (রসায়নবিদ) গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু খনিতে এ পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, এটা সত্য। কেন হয়নি, চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।

কয়লার ঘাটতি, আর্দ্রতা জটিলতাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য চীনা কোম্পানি এক্সএমসির স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। অন্য কোম্পানির দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

কয়লা দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করছে ক্যাবের একটি কমিটিও। এই কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কয়লার উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত বড় ধরনের গলদ আছে। খনি কর্তৃপক্ষ কয়লার বিপুল ঘাটতিকে সিস্টেম লস হিসেবে দেখাচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

About Author Information
আপডেট সময় : ০৩:৫১:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮
৭৪৪ Time View

কয়লার নামে ৮৫০ কোটি টাকা পানিতে

আপডেট সময় : ০৩:৫১:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

৫ শতাংশ বেশি আর্দ্রতাসহ কয়লা কিনে প্রায় ৮৪৬ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)। এই খনির কয়লা উত্তোলনকারী চীনের দুই প্রতিষ্ঠানের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ৫ দশমিক ১ শতাংশ আর্দ্রতাসহ কয়লা কেনার চুক্তি করা হয়। কিন্তু কয়লা কেনা হয়েছে ১০ শতাংশ আর্দ্রতাসহ।

এদিকে গত জুলাইয়ে হঠাৎ জানা গেছে, খনির ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস নেই। মূলত এই খনির কয়লা দিয়ে চলা বড়পুকুরিয়া তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেলে এই ‘চুরি’ নজরে আসে। এই কয়লার আনুমানিক বাজারমূল্য ২৩০ কোটি টাকা। খনি কর্তৃপক্ষ শুরুতে একে সিস্টেম লস বা প্রক্রিয়াগত লোকসান বলে দাবি করে। কিন্তু খনির তদারকি সংস্থা পেট্রোবাংলা তদন্ত করে বলেছে, খনি কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই কয়লার যথাযথ হিসাব রাখেনি। ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে এই খনির কয়লা তোলা হচ্ছে।

বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের পর্ষদ সভার গত মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৩ বছরে এই খনি থেকে তোলা ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লা কিনেছে সরকার। ২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগে দেওয়া একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বড়পুকুরিয়া খনির কয়লায় ১০ শতাংশ আর্দ্রতা রয়েছে। কয়লার আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য রসায়নবিদ নিয়োগের কথা থাকলেও গত ১৩ বছরে এই পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে পূর্ণ আর্দ্রতায় (১০ শতাংশ) খনির কয়লা কিনেছে সরকার। চীনা দুই প্রতিষ্ঠান সিএমসি, এক্সএমসির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে পেট্রোবাংলার করা চুক্তির চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি আর্দ্রতায় কেনার ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টন বেশি ওজন কয়লার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। খোলাবাজারে প্রতি টন কয়লা ১৬ হাজার ৯২৭ টাকায় বিক্রি করে বিসিএমসিএল। এ হিসাবে ৫ লাখ টন কয়লার মূল্য ৮৪৬ কোটি টাকা।

বিসিএমসিএল সরেজমিন এবং খনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খনি থেকে কয়লা বুঝে নেওয়ার সময় ওজন ও আর্দ্রতা—দুটোই জানতে হয়। কিন্তু খনিতে কয়লার আর্দ্রতা পরীক্ষার জন্য কোনো রসায়নবিদ নেই। তবে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন কেমিস্ট বা রসায়নবিদ ছিলেন খনিতে। কিন্তু যেহেতু খনিতে তিন শিফটে (পালা) কয়লা তোলা হয়, তাই অন্তত তিনজন রসায়নবিদ থাকার কথা সেখানে।

জানতে চাইলে বিসিএমসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব আবুল কাশেম প্রধানীয়া প্রথম আলোকে বলেন, কেমিস্ট পদে একজন অস্থায়ী লোক ছিলেন অল্প কিছুদিনের জন্য। তিনি চলে যাওয়ায় আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে, বিশেষ করে যাঁর প্রতিবেদনের সঙ্গে সরকারের কোটি টাকা খরচের বিষয় যুক্ত, সেখানে কেন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে আবুল কাশেম কোনো জবাব দেননি।

১০ শতাংশ আর্দ্রতায় কয়লা কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি খনির কয়লায় চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি আর্দ্রতা থাকে এবং তা ওজন করার সময় বাদ দেওয়া না হয়, তাহলে কয়লার নামে আসলে আমরা আর্দ্রতা কিনেছি। আর্দ্রতা মাপার কথা কেমিস্টের। কিন্তু এ পদে কাউকে নিয়োগ না দেওয়া বেশ সন্দেহজনক।’

২৩০ কোটি টাকার কয়লা গায়েব
গত মাসে বড়পুকুরিয়া তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেলে কয়লা ‘চুরি’র বিষয়টি সবার নজরে আসে। এ ঘটনায় গঠিত সরকারি-বেসরকারি কমিটির সদস্যরা অবশ্য মনে করছেন, হদিস না মেলা কয়লা বাস্তবে খনি থেকে তোলাই হয়নি। কয়লা না তুলেই টাকা নিয়ে গেছে চীনা কনসোর্টিয়াম। আর এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খনি কর্তৃপক্ষের বড় কর্তারা।

কেনার হিসাব ধরলে তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে খনির মাঠ ছিল মজুতশূন্য। আর তাতেই ধরা পড়ে কয়লা ‘চুরি’র ঘটনা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ধরা পড়ার আরেক কারণ ছিল খনি বন্ধ থাকা। পুরোনো স্তরের কয়লা তোলা শেষ হওয়ায় খনির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় গত জুনে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে নতুন স্তর থেকে কয়লা তোলার কথা। এ প্রসঙ্গে ক্যাব গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মজুত কয়লা দিয়ে কোনোভাবে টেনেটুনে যদি সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ চালানো যেত, আর তখন নতুন কয়লা তোলা শুরু হয়ে যেত, তাহলে আর এই কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা জানাই যেত না।

এ ঘটনায় পেট্রোবাংলা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালককে (প্রশাসন) প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। আরেকটি তদন্ত কমিটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একটি কমিটি করেছে। সরকারি-বেসরকারি এসব কমিটির একাধিক সদস্য এ ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। পেট্রোবাংলা ছাড়া কোনো কমিটি এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

সরকারের কাছে জমা দেওয়া পেট্রোবাংলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খনি কর্তৃপক্ষ কয়লা তোলার যথাযথ হিসাবই রাখেনি। কারণ, তারা প্রথমে পেট্রোবাংলাকে বলেছিল, হদিস না মেলা কয়লা আসলে সিস্টেম লস বা প্রক্রিয়াগত লোকসান। কিন্তু পরে তারাই তাদের ১৯ জন পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কয়লা ‘চুরি’র অভিযোগে মামলা করেছে।

বিসিএমসিএলের গত ১১ জুলাইয়ের বোর্ড সভার কার্যপত্রে দেখা যায়, খনি থেকে গত ১৩ বছরে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫ টন কয়লা তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৫ টন কয়লার ঘাটতি হয়েছে, এটি উত্তোলিত কয়লার ১ দশমিক ৪২ শতাংশ।

এই ঘাটতির চারটি সম্ভাব্য কারণ দেখানো হয়েছে বোর্ড সভায়। এগুলো হলো অভ্যন্তরীণ তাপে কয়লা পুড়ে যাওয়া, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া, পরিমাপের সময় ভুল হওয়া ও গ্রীষ্মকালে বাতাসে কয়লা উড়ে যাওয়া। এসব প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সিস্টেম লস হতে পারে।

কিন্তু গত ১৫ এপ্রিল সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে এক সভায় খনি কর্তৃপক্ষ বলেছিল, সাধারণত কয়লাখনির সিস্টেম লস ২ শতাংশ হলেও বড়পুকুরিয়ার খনিতে সিস্টেম লসের পরিমাণ মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ।

এই অবস্থায় পেট্রোবাংলা ও মন্ত্রণালয় বিসিএমসিএলের কয়লা ঘাটতির এ ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি। এরই পরে গত ২৪ জুলাই খনি কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ‘চুরি’ হিসেবে অভিহিত করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর মডেল থানায় মামলা করে।

এর আগে কয়লার সিস্টেম লসের হিসাব নিতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে খনির মহাব্যবস্থাপক (সারফেস অপারেশন) এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও তারা তা দেয়নি।

এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব পরে বিসিএমসিএলের এমডিও হন। এখন বিসিএমসিএলের মামলায় তাঁকেই আসামি করা হয়েছে। সিস্টেম লস নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম নুরুল আওরঙ্গজেব প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছিল, তবে তৎকালীন এমডি এম আমিনুজ্জামান বলেছিলেন, এখন প্রতিবেদন জমা দিতে হবে না, এ বিষয়ে আরও দেখতে হবে।

এই অভিযোগ অস্বীকার করেন বিসিএমসিএলের সাবেক এমডি মো. আমিনুজ্জামান। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি মিথ্যা কথা। আমি এ রকম কিছু বলিনি। কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।’

কয়লার হদিস না মেলায় ‘চুরি’ অভিধা দিয়ে কেন মামলা করা হলো, জানতে চাইলে খনি কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ও মাইন) সাইফুল ইসলাম সরকার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওপর থেকে বলা হয়েছে এভাবে মামলা করতে। আমরা আদেশ পালন করেছি।’

গত ১৩ বছরে ৭ জন এমডি খনির দায়িত্ব পালন করেছেন। পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে যথাযথ হিসাব না রাখার জন্য ৭ জন এমডিকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁদেরই একজন আবদুল আজিজ খান বর্তমানে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য। কয়লার আর্দ্রতা পরীক্ষার জন্য রসায়নবিদ কেন নিয়োগ করা হয়নি, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেমিস্ট (রসায়নবিদ) গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু খনিতে এ পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, এটা সত্য। কেন হয়নি, চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।

কয়লার ঘাটতি, আর্দ্রতা জটিলতাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য চীনা কোম্পানি এক্সএমসির স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। অন্য কোম্পানির দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

কয়লা দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করছে ক্যাবের একটি কমিটিও। এই কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কয়লার উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত বড় ধরনের গলদ আছে। খনি কর্তৃপক্ষ কয়লার বিপুল ঘাটতিকে সিস্টেম লস হিসেবে দেখাচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।