ঢাকা ০৬:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে

সবুজদেশ ডেস্ক:

ছবি সংগৃহীত-

 

গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে এক চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উন্মোচন করেছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের উপর চালানো অমানবিক আচরণ। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৭০০টি গুমের অভিযোগের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুর মুখে পড়েছেন, আর যারা ফিরে এসেছেন, তারা দীর্ঘকালীন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। এই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিলেছে, যা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠিয়েছে।

গুমের অভিযোগ: পরিসংখ্যান ও বিষয়ভিত্তিক বিবরণ
গুম কমিশন ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। কমিশন জানায়, ২০১৬ সালে ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটে, যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসে ২১টি গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিটি গুমের ঘটনায় কমপক্ষে চারটি মূল বৈশিষ্ট্য থাকে, যা কমিশন নিশ্চিত করেছে— ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো ও আইনি সুরক্ষা প্রদান না করা।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনুযায়ী, গুমের ঘটনা নিয়মিতভাবে সংগঠিত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে যে, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা এবং মুক্তি—এগুলো সবই একটি সুসংগঠিত চক্রের অংশ হিসেবে ঘটানো হয়েছে।

গুমের পদ্ধতি ও অপহরণ
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো— প্রথমে কাউকে আটক করা, এরপর নির্যাতন করে তার কাছ থেকে অন্যদের নাম আদায় করা এবং তারপর তাদেরও গুম করা।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুম করা, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির সরাসরি নির্দেশে গুম ও নির্যাতন চালানো হতো। এছাড়া, গুমের শিকার ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করতে মোবাইল ফোনের নজরদারি করা হতো বলেও কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

কমিশন জানায়, ডিজিএফআই এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য নজরদারি চালাত। গুমের শিকারদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপহরণের সময় তাদের চোখ বাঁধা হতো, হাতকড়া পরানো হতো এবং দ্রুত গাড়িতে তুলে নেওয়া হতো। অপহরণকারীরা সাধারণত নিজেদের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন।

গোপন বন্দিশালা ও নির্যাতন
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের শিকারদের অনেক সময় গোপন স্থানে আটকে রাখা হতো। আটকের পর ভিকটিমদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কমিশনের তদন্তে জানানো হয়, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো ডিজিএফআই, র‍্যাব এবং সিটিটিসি পরিচালনা করত। এসব গোপন বন্দিশালাগুলো ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত এবং এখানকার কার্যক্রমে কিছু কাঠামোগত মিল পাওয়া গেছে। কমিশন ধারণা করছে, এ ধরনের কার্যক্রম কোনো একটি কেন্দ্র থেকে পরিকল্পিত ও তদারকি করা হতো।

নির্যাতনের ধরন অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। গুমের শিকারদের উপর শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হতো। ২০১০ সালে ধানমন্ডি থেকে র‍্যাব এক যুবককে অপহরণ করে এবং কোনো অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া তার ঠোঁট সেলাই করে দেয়। এছাড়া, এক ভিকটিমের কানে এবং যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়।

কমিশন জানায়, র‍্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের গোপন স্থাপনাগুলোতে এসব নির্যাতনের সকল প্রস্তুতি ছিল। অনেক গোপন কারাগারে বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং বিশেষ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা যন্ত্র।

গুমের পর হত্যা ও লাশ গুম
গুমের শিকার অনেকেই পরে হত্যা হয়ে যান। হত্যার পর তাদের লাশ সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী ছিল লাশ গুম করার জন্য ব্যবহৃত প্রধান নদী। এক সাক্ষীর বক্তব্য অনুযায়ী, র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা তাকে এক বার দুইটি ভিকটিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেখিয়েছে। সেনা সদস্যদের এক সাক্ষ্য অনুযায়ী, গুমের শিকার একজন পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করার পর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়।

একটি ঘটনা বর্ণনা করে জানা গেছে যে, এক সেনা সদস্যকে ঢাকার রেললাইনের ওপরে একটি লাশ রেখে ট্রেনের চাপায় লাশটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার জন্য বলা হয়েছিল। এছাড়া, আরও এক ভিকটিমকে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তবে গাড়িটি পাশ কাটিয়ে চলে গেলে সে বেঁচে যায়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের ঘটনা শুধু দেশীয় বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি একটি সুসংগঠিত ও আন্তর্জাতিক চক্রের অংশ ছিল।

আন্তর্জাতিক যোগসূত্র: ভারতীয় বাহিনীর ভূমিকা
গুম কমিশন বলছে— গুমের ঘটনার মধ্যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রমাণও পাওয়া গেছে। ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে বন্দি বিনিময় হয় বলে দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, সালাহউদ্দিন আহমেদ (বিএনপি নেতা) ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে, তাকে নির্জন স্থানে রাখা হয়েছিল এবং সেখানে টিএফআইয়ের (টাস্ক ফোর্স অব ইন্টারোগেশন) কম্বল ছিল, যা র‍্যাব সদর দফতর পরিচালিত ছিল।

কমিশন জানায়, গুমের সাথে জড়িত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়ই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, যাতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না যায়।

ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন
কমিশন জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মার্চে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হবে, এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। এ রিপোর্টে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে এবং সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর, গুম কমিশন র‍্যাবের বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে এবং শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে। এছাড়া, গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সইয়ের ফলে এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে, এবং গুমের ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার দাবি জানানো হয়েছে।

গুম কমিশন বর্তমানে আরো গভীর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, এবং শিগগিরই আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবে।

সূত্র: বিবিসি

About Author Information
আপডেট সময় : ০৭:২০:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
১৬ Time View

নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে

আপডেট সময় : ০৭:২০:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

 

গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে এক চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উন্মোচন করেছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের উপর চালানো অমানবিক আচরণ। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৭০০টি গুমের অভিযোগের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুর মুখে পড়েছেন, আর যারা ফিরে এসেছেন, তারা দীর্ঘকালীন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। এই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিলেছে, যা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠিয়েছে।

গুমের অভিযোগ: পরিসংখ্যান ও বিষয়ভিত্তিক বিবরণ
গুম কমিশন ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। কমিশন জানায়, ২০১৬ সালে ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটে, যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসে ২১টি গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিটি গুমের ঘটনায় কমপক্ষে চারটি মূল বৈশিষ্ট্য থাকে, যা কমিশন নিশ্চিত করেছে— ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো ও আইনি সুরক্ষা প্রদান না করা।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনুযায়ী, গুমের ঘটনা নিয়মিতভাবে সংগঠিত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে যে, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা এবং মুক্তি—এগুলো সবই একটি সুসংগঠিত চক্রের অংশ হিসেবে ঘটানো হয়েছে।

গুমের পদ্ধতি ও অপহরণ
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো— প্রথমে কাউকে আটক করা, এরপর নির্যাতন করে তার কাছ থেকে অন্যদের নাম আদায় করা এবং তারপর তাদেরও গুম করা।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুম করা, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির সরাসরি নির্দেশে গুম ও নির্যাতন চালানো হতো। এছাড়া, গুমের শিকার ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করতে মোবাইল ফোনের নজরদারি করা হতো বলেও কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

কমিশন জানায়, ডিজিএফআই এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য নজরদারি চালাত। গুমের শিকারদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপহরণের সময় তাদের চোখ বাঁধা হতো, হাতকড়া পরানো হতো এবং দ্রুত গাড়িতে তুলে নেওয়া হতো। অপহরণকারীরা সাধারণত নিজেদের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন।

গোপন বন্দিশালা ও নির্যাতন
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের শিকারদের অনেক সময় গোপন স্থানে আটকে রাখা হতো। আটকের পর ভিকটিমদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কমিশনের তদন্তে জানানো হয়, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো ডিজিএফআই, র‍্যাব এবং সিটিটিসি পরিচালনা করত। এসব গোপন বন্দিশালাগুলো ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত এবং এখানকার কার্যক্রমে কিছু কাঠামোগত মিল পাওয়া গেছে। কমিশন ধারণা করছে, এ ধরনের কার্যক্রম কোনো একটি কেন্দ্র থেকে পরিকল্পিত ও তদারকি করা হতো।

নির্যাতনের ধরন অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। গুমের শিকারদের উপর শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হতো। ২০১০ সালে ধানমন্ডি থেকে র‍্যাব এক যুবককে অপহরণ করে এবং কোনো অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া তার ঠোঁট সেলাই করে দেয়। এছাড়া, এক ভিকটিমের কানে এবং যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়।

কমিশন জানায়, র‍্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের গোপন স্থাপনাগুলোতে এসব নির্যাতনের সকল প্রস্তুতি ছিল। অনেক গোপন কারাগারে বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং বিশেষ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা যন্ত্র।

গুমের পর হত্যা ও লাশ গুম
গুমের শিকার অনেকেই পরে হত্যা হয়ে যান। হত্যার পর তাদের লাশ সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী ছিল লাশ গুম করার জন্য ব্যবহৃত প্রধান নদী। এক সাক্ষীর বক্তব্য অনুযায়ী, র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা তাকে এক বার দুইটি ভিকটিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেখিয়েছে। সেনা সদস্যদের এক সাক্ষ্য অনুযায়ী, গুমের শিকার একজন পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করার পর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়।

একটি ঘটনা বর্ণনা করে জানা গেছে যে, এক সেনা সদস্যকে ঢাকার রেললাইনের ওপরে একটি লাশ রেখে ট্রেনের চাপায় লাশটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার জন্য বলা হয়েছিল। এছাড়া, আরও এক ভিকটিমকে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তবে গাড়িটি পাশ কাটিয়ে চলে গেলে সে বেঁচে যায়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের ঘটনা শুধু দেশীয় বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি একটি সুসংগঠিত ও আন্তর্জাতিক চক্রের অংশ ছিল।

আন্তর্জাতিক যোগসূত্র: ভারতীয় বাহিনীর ভূমিকা
গুম কমিশন বলছে— গুমের ঘটনার মধ্যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রমাণও পাওয়া গেছে। ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে বন্দি বিনিময় হয় বলে দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, সালাহউদ্দিন আহমেদ (বিএনপি নেতা) ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে, তাকে নির্জন স্থানে রাখা হয়েছিল এবং সেখানে টিএফআইয়ের (টাস্ক ফোর্স অব ইন্টারোগেশন) কম্বল ছিল, যা র‍্যাব সদর দফতর পরিচালিত ছিল।

কমিশন জানায়, গুমের সাথে জড়িত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়ই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, যাতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না যায়।

ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন
কমিশন জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মার্চে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হবে, এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। এ রিপোর্টে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে এবং সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর, গুম কমিশন র‍্যাবের বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে এবং শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে। এছাড়া, গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সইয়ের ফলে এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে, এবং গুমের ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার দাবি জানানো হয়েছে।

গুম কমিশন বর্তমানে আরো গভীর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, এবং শিগগিরই আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবে।

সূত্র: বিবিসি