ভৈরব থেকে ঢাকা যাচ্ছিল যাত্রীবাহী একটি বাস। বিপরীত দিক থেকে আসছিল যাত্রীবাহী লেগুনা। নরসিংদীর জঙ্গুয়ারে পৌঁছালে বাসের সঙ্গে লেগুনাটির সংঘর্ষ হয়। এতে দুর্ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১১ জন। তাঁদের সবাই লেগুনার যাত্রী।
গত সোমবারের এই দুর্ঘটনার মতোই দেশের বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে ঘটা দুর্ঘটনার বড় একটি অংশের সঙ্গে জড়িত ছোট আকারের যানবাহন। যার মধ্যে মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, তিন চাকার বাহন এবং মোটর সাইকেলও রয়েছে। আর এমন দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছোট বাহনের যাত্রী বা চালকের সংখ্যাই বেশি।
গত সাত দিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটা দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে ৫২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০৯ জন। যাঁদের ৬৮ জনই ছোট যানবাহনের যাত্রী বা চালক। আর ৩৩টি দুর্ঘটনার সঙ্গেই জড়িত ছোট আকারের বাহন। কিছু ক্ষেত্রে এসব বাহন দুর্ঘটনার কারণ, আবার কিছু ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার।
হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে চলাচল উপযোগী গাড়ি মহাসড়কে চলছে না। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাহেন্দ্র, টমটম (ইলেকট্রিক অটোরিকশা), নছিমন এ রকম নানা ধরনের তিন চাকার বাহন চলছে। মহাসড়কে পূর্ণ গতিতে চলমান একটি বড় বাস বা ট্রাকের সামান্য কোনাও যদি থ্রি-হুইলারের সঙ্গে কোনোভাবে লেগে যায়, তাহলেই হালকা এই যানগুলো দুমড়েমুচড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এ ছাড়া মহাসড়কে চলা হিউম্যান হলারগুলো ‘মুভিং কফিন’ বলে মনে করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এর আগে দেশের সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনার ধরন জানতে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২৮ দিনের দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে প্রথম আলো। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই ২২৮ দিনে মোট ১ হাজার ৪৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ১১১ জন। ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ৪০ দশমিক ৫২ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে যানবাহনের চাপা ও ধাক্কায়। যার কারণে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ দশমিক ৬৫ শতাংশই ছিলেন পথচারী।
এই সময়ে তিন চাকার বাহনে (বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত নছিমন-ভটভটি) ঘটা দুর্ঘটনার পরিমাণ ১৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনো না-কোনোভাবে জড়িত থাকে মোটরসাইকেল। বড় যানবাহনের চাপা বা ধাক্কা, অন্য যানের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। তবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার চেয়ে আহত হওয়ার সংখ্যা অন্তত ১০ গুণ বলে দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞদের ধারণা। যার প্রকৃত কোনো হিসাব নেই।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার মাইক্রোবাস। গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর বেলাবতে এমন মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটে। ওই দিন গ্রামের মেলা উপলক্ষে ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে কিশোরগঞ্জের নিকলীতে যাচ্ছিলেন কয়েকজন। পথে দ্রুতগামী এক বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে পুরো মাইক্রোবাসটিই দুমড়েমুচড়ে যায়। নিহত হন মাইক্রোবাসের ১৩ আরোহী।
মহাসড়কে মাইক্রোবাসগুলোর উচ্চগতিকে এসব দুর্ঘটনার কারণ বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া একই সময়ে মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ২০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে কার ও জিপের মতো ব্যক্তিগত বাহনও।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, দেশের সড়কগুলোতে লেন বাড়ানো হচ্ছে। চার লেন, আট লেন পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু কোথাও স্থানীয় বা ধীরগতির যান চলাচলের জন্য পৃথক সার্ভিস লেন হচ্ছে না। সার্ভিস লেন ও দ্রুতগতির লেন সুনির্দিষ্ট না থাকায় একই মহাসড়কে বিভিন্ন গতির যান চলছে। আজকালকার বাসগুলো অনেক উন্নত প্রযুক্তির ও গতিসম্পন্ন। সেই বাস আর নছিমনের মতো যান যদি একই মহাসড়কে চলে তাহলে সেখানে ওভারটেকিং অবধারিত। আর এ কারণে সংঘর্ষ, পেছন থেকে ছোট যানকে চাপা বা ধাক্কা দেওয়ার মতো দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা একটা বিজ্ঞান। শুধু সাধারণ কিছু ধারণা দিয়ে এটা করতে গেলে বলতে হবে দুর্ঘটনার উপকরণগুলো আপনি নিজেই তৈরি করছেন। বিজ্ঞান ছাড়া উন্নয়ন হলে রক্তক্ষরণের উন্নয়ন হবে। আপনি ঠেকাতে পারবেন না।’