জঙ্গিবাদ এবার আফ্রিকায়
২০০২ সাল। নাইজেরিয়ার বোর্নো রাজ্যের মাইদুগুরি শহর। হুট করে আবির্ভাব ঘটল মোহাম্মদ ইউসুফ নামের এক ব্যক্তির। মাইদুগুরির ধর্মীয় স্কুল ও মসজিদগুলোয় ভাষণ ও প্রচারণা দেওয়া শুরু করে দেন ইউসুফ। আর তাতেই সম্মোহিত হয়ে পড়েন স্থানীয় লোকজন। দলে দলে সবাই ইউসুফের অনুসারী বনে যান! এই ইউসুফের নেতৃত্বেই পরে আত্মপ্রকাশ করে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জঙ্গি সংগঠন—বোকো হারাম।
আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ নাইজেরিয়া। অথচ সক্ষমতা বেশি থাকলেও জঙ্গিদের সামলাতে পারছে না দেশটি। তাহলে আফ্রিকার বেশির ভাগ দরিদ্র দেশ কী করবে?
সাম্প্রতিক কালে ইরাক ও সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তবে এই কট্টরপন্থীরা ছড়িয়ে পড়ার নতুন জায়গা পেয়েছে। সেটি হলো আফ্রিকা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, জঙ্গিরা এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বলা যায়, ইরাক-সিরিয়ার পর আফ্রিকাতেই সবচেয়ে শক্তিশালী হতে পেরেছে আইএসপন্থী জঙ্গিরা। আর সহিংসতার ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের আইএস জঙ্গিদেরও ছাড়িয়ে গেছে আফ্রিকা।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফ্রিকায় জঙ্গি তৎপরতার ও এ-সংশ্লিষ্ট নানামাত্রিক হামলার অনেক খবরই মূলধারার সংবাদমাধ্যমে আসে না। তারপরও শুধু গত বছর এমন জঙ্গি হামলায় ১০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর আফ্রিকায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হলো নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাইদুগুরি। ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পুরো আফ্রিকা অঞ্চলে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর চালানো সহিংস ঘটনা বেড়েছে ৩০০ শতাংশেরও বেশি।
ইউএসএ টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাইজেরিয়ার বোকো হারাম ও ইথিওপিয়ার আল-শাবাব নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আফ্রিকা মহাদেশের আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করছে। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কিছু ক্ষেত্রে আইএসের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতাও ঘোষণা করেছে।
আফ্রিকায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিপরীত প্রতিক্রিয়া খুব একটা জোরদার নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো পশ্চিমা দেশগুলো এই মহাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করেই নানা ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ও তাদের কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলোর গরজ কম।
বোকো হারামই সব নষ্টের গোড়া?
আবার শুরুর প্রসঙ্গে আসি। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বোকো হারাম সক্ষমতার দিক থেকে সবচেয়ে ভয়ংকর। বোকো হারাম শব্দের অর্থ হলো ‘পশ্চিমা শিক্ষা একটি পাপ’। এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ তাঁর অনুসারীদের প্রতি প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, পৃথিবীর গোল নয় এবং বাষ্পীভবনের ফলে বৃষ্টি আসে না। এক কথায় সব বৈজ্ঞানিক ধারণাই খারিজ করে দিয়েছিলেন ইউসুফ।
২০০৯ সাল থেকে ইউসুফের অনুসারীরা স্থানীয় পুলিশ ও সেনাসদস্যদের ওপর হামলা চালানো শুরু করে। এ ছাড়া ইউসুফের প্রচারিত মতাদর্শের বিরোধিতা করা ইমামদের হত্যা করা হয়। পরে নাইজেরিয়ার পুলিশ ইউসুফকে গ্রেপ্তার করে এবং প্রকাশ্যে হত্যা করে। এই ঘটনার পর কিছুটা ধাক্কা খায় বোকো হারাম। এর সদস্যরা তখন আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল।
তবে আবুবকর শিকাউয়ের নেতৃত্বে ফের পুনর্গঠিত হয় বোকো হারাম। ২০১১ সালে নাইজেরীয় পুলিশ সদর দপ্তরে ও রাজধানী আবুজায় জাতিসংঘের কার্যালয়ে বোমা হামলা করে নিজেদের শক্তি জানান দেয় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ৩০০ স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয় বোকো হারাম। ওই সময়টিতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল আবুবকর শিকাউয়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
অবশ্য আইএসের মতো প্রথমেই শাসক হওয়ার চেষ্টা করেনি বোকো হারাম। শুরুতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাই ছিল এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। মসজিদ থেকে বাজার—সবখানেই বোমা হামলা চালিয়েছে বোকো হারাম। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অপহরণ করা হয় নারী ও শিশুদের। শুধু অপহরণই নয়, অনেক মেয়েকে দাসশ্রম দিতে বাধ্য করা হয় এবং নিলামে বিক্রিও করা হয়!। অন্যদের মানববোমা হিসেবে ব্যবহার করেছিল বোকো হারাম।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট পয়েন্টের মিলিটারি একাডেমির কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৪৩৪টি মানববোমা ব্যবহার করেছিল বোকো হারাম। এর অর্ধেকের বেশিই ছিল নারী। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর কাজে গত বছর কমপক্ষে ১৩৫ জন শিশুকে ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নারী ও শিশুদের বিক্রি ও দাস হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধর্মের দোহাই দিচ্ছে বোকো হারামের নেতারা। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সরব আবুবকর শিকাউ।
২০১৫ সালে ইসলামিক স্টেটের সংশ্লিষ্টতা ঘোষণা করে বোকো হারাম। নাম বদলে এটি এখন হয়েছে ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি)। ২০১৬ সালে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে আবু মুসাব আল-বারানায়ির নাম ঘোষণা করে আইএস। মূল আইএসের হস্তক্ষেপের ফলে এই গোষ্ঠীটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
বর্তমান অবস্থা কী?
নাইজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি ক্ষমতায় আসার পর দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান শুরু হয়। এতে করে পিছু হটে জঙ্গিরা। এই অভিযানে অংশ নেয় চাদ, নাইজার ও ক্যামেরুন। বহুজাতিক অভিযানের মুখে কয়েক মাসের মধ্যেই বড় শহরগুলো নাইজেরিয়ার সরকারের দখলে চলে আসে। চার দেশের সম্মিলিত অভিযানে এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গিরা।
ইকোনমিস্টের হিসাব অনুযায়ী, আফ্রিকার পিছু হটা আইএসের সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। সেই হিসাবে বলা যায়, বিশ্বে আইএসের সবচেয়ে বড় বাহিনী এখন আফ্রিকায়। কারণ, সিরিয়া-ইরাকে এখন টিকে আছেন হাজারখানেক আইএস জঙ্গি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আপাতত আড়ালে থাকলেও জঙ্গিরা বসে নেই। আইএসডব্লিউএপি বোমা বানানো ও হামলা চালানোর ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের কাজ করে যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও ১১০ জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে এ সন্ত্রাসী সংগঠন।
এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাসনকাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে আইএসডব্লিউএপি। চলছে খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। কিছু এলাকায় কর আদায়ও চলছে। এসব অঞ্চলে কার্যত নাইজেরিয়ার সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী বেশ কিছুদিন ধরেই প্রত্যন্ত এলাকার অধিবাসীদের সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সরিয়ে নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ মানুষ। তবে এতে মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব ক্যাম্পে অনেক নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে মৃত মানুষের সংখ্যা হবে হাজারের মতো।
এই অভাব ও অন্যায়-অবিচার জিহাদিদের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই ক্যাম্পগুলো ‘জঙ্গি তৈরির কারখানায়’ পরিণত হয়েছে। কারণ, এখানকার পরিবেশ নিয়ে একদমই মাথা ঘামায় না নাইজেরিয়ার সরকার। ফলে এখান থেকে ধর্মীয় উগ্রবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অনেকে। এরপর পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এসব জঙ্গি।
আফ্রিকায় জঙ্গি বেশি কেন?
আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। দারিদ্র্য এসব দেশের মূল সমস্যা। অন্যদিকে আছে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ না হওয়ার সমস্যা। এসব দেশের সরকারের নজরও নেই এদিকে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বঞ্চনা ও অভাব-অনটন সংশ্লিষ্ট ক্ষোভ দানা বাঁধছে বহুদিন ধরেই।
ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস, মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ), বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সক্রিয় রয়েছে। এসব সংস্থাই মূলত জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছে। সরকার এ নিয়ে খুব একটা ভাবিত নয়। দেশগুলোর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো উল্টো সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি জানিয়েছে, আফ্রিকা অঞ্চলের মোট জঙ্গির ৭১ শতাংশ এ পথে এসেছে নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে। তাদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত এবং দরিদ্র।
রক্ষা পাবে আফ্রিকা?
ধীরে ধীরে আফ্রিকা থেকে নিজেদের বাহিনী গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। পশ্চিমারা স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য, বিমান হামলা ও ড্রোন হামলা চালিয়ে সহায়তা দিয়ে থাকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফ্রিকার জিহাদিরা এখনো পশ্চিমাদের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। আর এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে।
সম্প্রতি শিকাগো ট্রিবিউনের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, আগামী তিন বছরে আফ্রিকায় থাকা মার্কিন বাহিনীর পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই পর্যালোচনা সিদ্ধান্তে পরিণত হলে তা অবিবেচকের মতো কাজ হবে। কারণ, আফ্রিকা এখন ইসলামি চরমপন্থার বীজতলায় পরিণত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, শুধু সামরিক পদক্ষেপ দিয়ে আফ্রিকা অঞ্চলে জঙ্গি কর্মকাণ্ড থামানো যাবে না। এর জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, আলোচনা দরকার। তা না হলে এই জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এই রাজনৈতিক পদক্ষেপ চালানোর জন্য আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর শাসকদের এক হওয়া জরুরি। তাদের জনদরদি ও সন্ত্রাস দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রবাদের চারণভূমি হওয়া থেকে আফ্রিকাকে বাঁচানো যাবে কি না—এই প্রশ্নের উত্তর সময়ের স্রোতেই লুকিয়ে থাকছে।