ঢাকা ০৯:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জামায়া‌তের অভিন্ন কর্মসূচি দিল ইসলামী আন্দোলন

  • সবুজদেশ ডেস্ক:
  • Update Time : ০৭:৩৫:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ২৯ বার পড়া হয়েছে।

 

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন, পিআর পদ্ধ‌তি‌তে জাতীয় নির্বাচন, জাপা ও চৌদ্দ দ‌লের রাজনী‌তি নি‌ষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দা‌বি‌তে জামায়া‌তের অভিন্ন কর্মসূ‌চি দি‌য়ে‌ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক, প্রয়োজ‌নে আরো ক‌ঠোর কর্মসূচি দি‌য়ে রাজপ‌থে ক‌ঠোর আন্দোলনের হুম‌কি দি‌য়ে‌ছে দল‌টি।

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যাল‌য়ে এক সংবাদ স‌ম্মেল‌নে কর্মসূ‌চি ঘোষণা ক‌রেন দল‌টির আমির মুফতি সৈয়দ মুহম্মাদ রেজাউল করীম।

ঘো‌ষিত কর্মসূ‌চি হ‌লো:

১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব জেলা উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল অনু‌ষ্ঠিত হ‌বে।

এর আগে একই কর্মসূ‌চি দেয় বাংলা‌দেশ জামায়াতে ইসলামী ও খেলাফত মজ‌লিস।

পাঁচ দফা দা‌বি হ‌লো: জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হ‌বে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করতে হ‌বে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হ‌বে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করতে হ‌বে এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হ‌বে।

যুগপৎ আন্দোলনের যৌ‌ক্তিকতা তু‌লে ধ‌রে মুফ‌তি রেজাউল করীম ব‌লেন, “আমাদের দাবি সুস্পষ্ট। আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই, এর আইনি ভিত্তি চাই। জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতেই আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন চাই।দ্রুততার সাথে ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত দেখতে চাই।ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন বন্ধ করতে চাই। জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিষিদ্ধ চাই। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। আমাদের অবস্থান কোন দলের বিরুদ্ধে না। বরং জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই অবস্থান।”

যুগপৎ আন্দোলন কোন দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নয় জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, “এই পরিস্থিতিতে দেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রাজনৈতিক সংগঠন একত্রিত হয়ে আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা সর্বদিক চিন্তা করে এবং জুলাইয়ের রক্তের প্রতি দায়বোধ থেকে সুনির্দিষ্ট এই দাবিগুলো নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একই দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ কর্মসূচি পালন করব। যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলব।”

মুফতি রেজাউল করীম ব‌লেন, “দেশকে স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা, রাষ্ট্রের পরতে-পরতে জমা হওয়া ৫৪ বছরের জঞ্জাল দূর করা, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সর্বত্র জবাদিহিতা নিশ্চিত করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ও স্বাধীন করার জন্য মৌলিক সংস্কার করার জন্য এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শুদ্ধতা আনা ও সব নাগরিকের ভোটের অধিকার, সম্মান-মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য জুলাইতে ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। অতএব জুলাই পববর্তী বাংলাদেশে ‘সংস্কার-বিচার ও নির্বাচন’ এই ক্রমধারা অনুসরণ করা রক্তের দায় ও অঙ্গীকার। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মূখ্য করে তোলা হয়েছে যা দেশকে পুরোনো অশুভ বন্দোবস্তে আবারো নিপতিত করবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।”

বিএন‌পি‌কে ইঙ্গিত ক‌রে তি‌নি বলেন, “দেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণ দেখলে মনে হয়, জুলাইয়ের আন্দোলন হয়েছিল কেবলই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য। আদতে বিগত দিনের রাজনীতিতে এটা পরিস্কার যে, কেবলই নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয় নাই।”

যুগপৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে রেজাউল করীম বলেন, “আমরা যারা জুলাইয়ে জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, যারা বাচ্চাদের রক্ত ও জীবন উৎসর্গিত হতে দেখেছি, যারা আহতদের রোনাজারী শুনছি তারা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। সেই তাগিদ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং আমরা জুলাইয়ের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ আন্দোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যেই নানা মাধ্যমে সরকারের নীতি নির্ধারকদের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে আমাদেরকে এই রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে।”

জুলাই সনদ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পরে ১৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বর্ধিত মেয়াদও আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো জুলাই সনদ ঘোষণা করা যায় নাই। জুলাই সনদ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়েছে কিন্তু আপনারা লক্ষ করলে দেখবেন, ভবিষ্যৎ স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য আইনি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায় নাই। একটি নির্দিষ্ট মহল থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা এসেছে।ফলে জুলাইয়ের মূল প্রত্যাশা স্বৈরতন্ত্রকে চিরতরে বিলোপের যে চাহিদা তা পূরণে তেমন প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয় নাই। এমনকি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে কোন কোন সংস্কারের প্রস্তাব জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এখনই সেটা বাতিলযোগ্য করে রাখা হয়েছে। ফলে জুলাই সনদ কার্যত সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন দলের মতামত দলীলে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রত্যাশা ছিল জুলাই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের দিক-নির্দেশনা।”

নির্বাচনের পরে সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, “আমরা ৯০ সালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ সংস্কার প্রতিজ্ঞা দেখেছি। নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন দল ইশতেহার দেয়। সেগুলোতে সুন্দর সুন্দর বাণী থাকে। কিন্তু তার কোনো আইনি ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনের পরে গালভরা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন আর হয় না। জুলাই সনদ ও সংস্কার প্রতিশ্রুতিই হয়ে থাকবে যদি না তার আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না করা যায়।”

“আমরা মনে করি, যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের সার্বভৌম এখতিয়ার থাকে। সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ার বলে জুলাই সনদকে এই আমলেই বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তারই ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতায় নির্বাচনের পরে কেউ এসে এটা বাস্তবায়ন করবে সেই আশা করা যায় না।”

“অতএব, দ্রুত সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদকে আইনসম্মত করতে হবে।”

ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার ও জাপা নিষিদ্ধের বিষয়ে দল‌টির আমির বলেন, “পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপতৎপরতায় জাতি বিষিয়ে ছিল বিগত পনের বছর। এই লজ্জাহীনেরা ফ্যাসিবাদের সব অপকর্মের পক্ষ নিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করেছে।এর মধ্যে জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সবাই অবগত। তারা ফ্যাসিবাদের মন্ত্রিসভায় ছিল। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে অবৈধ নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই জাতীয় পার্টি অভ্যুত্থানের পরে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা করছে। দেশের একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে। আমরা পরিস্কার করে বলতে চাই, জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের সব দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, তারা কোন স্বাধীন রাজনৈতিক দল নয় বরং তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য এজেন্ট।”

সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয়েছে জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, “নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া নির্বাচন করা যায় না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জনপ্রশাসনের আচরণ ও সন্ত্রাসের যে ভয়াবহতা আমরা লক্ষ করছি তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। এখানে মনে রাখা লাগবে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও বটে। লন্ডন বৈঠক, এককভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে বর্তমান সরকার একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি যে পক্ষপাত দেখাচ্ছেন তাতে মাঠপ্রশাসন তাদের দিকে ঝুঁকে পড়াই স্বাভাবিক। আমরা বলব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। জনপ্রশাসনকে সক্রিয় ও নিরপেক্ষ করতে হবে এবং সরকারকে কোন দলের প্রতি পক্ষপাত দেখানো থেকে সরে আসতে হবে।”

পিআরের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে দলের আমির বলেন, “আমরা বার বার বলছি যে, বিগত ৫৪ বছরে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে সেই পদ্ধতি দেশকে ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। এমন তিক্ত অতীতের বাস্তবতায় পুরোনো বন্দোবস্তে নির্বাচন করার কোন অর্থ হয় না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাই উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।”

দ‌লের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী ও অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম ও কেএমস আতিকুর রহমান, মুফতি মোস্তফা কামাল, কেএম শরীয়াতুল্লাহ।

সবুজদেশ/এসএএস

Tag :

জামায়া‌তের অভিন্ন কর্মসূচি দিল ইসলামী আন্দোলন

Update Time : ০৭:৩৫:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

 

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন, পিআর পদ্ধ‌তি‌তে জাতীয় নির্বাচন, জাপা ও চৌদ্দ দ‌লের রাজনী‌তি নি‌ষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দা‌বি‌তে জামায়া‌তের অভিন্ন কর্মসূ‌চি দি‌য়ে‌ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক, প্রয়োজ‌নে আরো ক‌ঠোর কর্মসূচি দি‌য়ে রাজপ‌থে ক‌ঠোর আন্দোলনের হুম‌কি দি‌য়ে‌ছে দল‌টি।

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যাল‌য়ে এক সংবাদ স‌ম্মেল‌নে কর্মসূ‌চি ঘোষণা ক‌রেন দল‌টির আমির মুফতি সৈয়দ মুহম্মাদ রেজাউল করীম।

ঘো‌ষিত কর্মসূ‌চি হ‌লো:

১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব জেলা উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল অনু‌ষ্ঠিত হ‌বে।

এর আগে একই কর্মসূ‌চি দেয় বাংলা‌দেশ জামায়াতে ইসলামী ও খেলাফত মজ‌লিস।

পাঁচ দফা দা‌বি হ‌লো: জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হ‌বে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করতে হ‌বে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হ‌বে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করতে হ‌বে এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হ‌বে।

যুগপৎ আন্দোলনের যৌ‌ক্তিকতা তু‌লে ধ‌রে মুফ‌তি রেজাউল করীম ব‌লেন, “আমাদের দাবি সুস্পষ্ট। আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই, এর আইনি ভিত্তি চাই। জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতেই আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন চাই।দ্রুততার সাথে ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত দেখতে চাই।ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন বন্ধ করতে চাই। জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিষিদ্ধ চাই। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। আমাদের অবস্থান কোন দলের বিরুদ্ধে না। বরং জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই অবস্থান।”

যুগপৎ আন্দোলন কোন দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নয় জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, “এই পরিস্থিতিতে দেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রাজনৈতিক সংগঠন একত্রিত হয়ে আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা সর্বদিক চিন্তা করে এবং জুলাইয়ের রক্তের প্রতি দায়বোধ থেকে সুনির্দিষ্ট এই দাবিগুলো নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একই দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ কর্মসূচি পালন করব। যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলব।”

মুফতি রেজাউল করীম ব‌লেন, “দেশকে স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা, রাষ্ট্রের পরতে-পরতে জমা হওয়া ৫৪ বছরের জঞ্জাল দূর করা, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সর্বত্র জবাদিহিতা নিশ্চিত করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ও স্বাধীন করার জন্য মৌলিক সংস্কার করার জন্য এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শুদ্ধতা আনা ও সব নাগরিকের ভোটের অধিকার, সম্মান-মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য জুলাইতে ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। অতএব জুলাই পববর্তী বাংলাদেশে ‘সংস্কার-বিচার ও নির্বাচন’ এই ক্রমধারা অনুসরণ করা রক্তের দায় ও অঙ্গীকার। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মূখ্য করে তোলা হয়েছে যা দেশকে পুরোনো অশুভ বন্দোবস্তে আবারো নিপতিত করবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।”

বিএন‌পি‌কে ইঙ্গিত ক‌রে তি‌নি বলেন, “দেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণ দেখলে মনে হয়, জুলাইয়ের আন্দোলন হয়েছিল কেবলই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য। আদতে বিগত দিনের রাজনীতিতে এটা পরিস্কার যে, কেবলই নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয় নাই।”

যুগপৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে রেজাউল করীম বলেন, “আমরা যারা জুলাইয়ে জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, যারা বাচ্চাদের রক্ত ও জীবন উৎসর্গিত হতে দেখেছি, যারা আহতদের রোনাজারী শুনছি তারা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। সেই তাগিদ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং আমরা জুলাইয়ের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ আন্দোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যেই নানা মাধ্যমে সরকারের নীতি নির্ধারকদের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে আমাদেরকে এই রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে।”

জুলাই সনদ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পরে ১৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বর্ধিত মেয়াদও আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো জুলাই সনদ ঘোষণা করা যায় নাই। জুলাই সনদ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়েছে কিন্তু আপনারা লক্ষ করলে দেখবেন, ভবিষ্যৎ স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য আইনি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায় নাই। একটি নির্দিষ্ট মহল থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা এসেছে।ফলে জুলাইয়ের মূল প্রত্যাশা স্বৈরতন্ত্রকে চিরতরে বিলোপের যে চাহিদা তা পূরণে তেমন প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয় নাই। এমনকি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে কোন কোন সংস্কারের প্রস্তাব জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এখনই সেটা বাতিলযোগ্য করে রাখা হয়েছে। ফলে জুলাই সনদ কার্যত সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন দলের মতামত দলীলে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রত্যাশা ছিল জুলাই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের দিক-নির্দেশনা।”

নির্বাচনের পরে সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, “আমরা ৯০ সালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ সংস্কার প্রতিজ্ঞা দেখেছি। নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন দল ইশতেহার দেয়। সেগুলোতে সুন্দর সুন্দর বাণী থাকে। কিন্তু তার কোনো আইনি ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনের পরে গালভরা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন আর হয় না। জুলাই সনদ ও সংস্কার প্রতিশ্রুতিই হয়ে থাকবে যদি না তার আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না করা যায়।”

“আমরা মনে করি, যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের সার্বভৌম এখতিয়ার থাকে। সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ার বলে জুলাই সনদকে এই আমলেই বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তারই ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতায় নির্বাচনের পরে কেউ এসে এটা বাস্তবায়ন করবে সেই আশা করা যায় না।”

“অতএব, দ্রুত সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদকে আইনসম্মত করতে হবে।”

ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার ও জাপা নিষিদ্ধের বিষয়ে দল‌টির আমির বলেন, “পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপতৎপরতায় জাতি বিষিয়ে ছিল বিগত পনের বছর। এই লজ্জাহীনেরা ফ্যাসিবাদের সব অপকর্মের পক্ষ নিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করেছে।এর মধ্যে জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সবাই অবগত। তারা ফ্যাসিবাদের মন্ত্রিসভায় ছিল। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে অবৈধ নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই জাতীয় পার্টি অভ্যুত্থানের পরে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা করছে। দেশের একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে। আমরা পরিস্কার করে বলতে চাই, জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের সব দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, তারা কোন স্বাধীন রাজনৈতিক দল নয় বরং তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য এজেন্ট।”

সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয়েছে জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, “নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া নির্বাচন করা যায় না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জনপ্রশাসনের আচরণ ও সন্ত্রাসের যে ভয়াবহতা আমরা লক্ষ করছি তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। এখানে মনে রাখা লাগবে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও বটে। লন্ডন বৈঠক, এককভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে বর্তমান সরকার একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি যে পক্ষপাত দেখাচ্ছেন তাতে মাঠপ্রশাসন তাদের দিকে ঝুঁকে পড়াই স্বাভাবিক। আমরা বলব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। জনপ্রশাসনকে সক্রিয় ও নিরপেক্ষ করতে হবে এবং সরকারকে কোন দলের প্রতি পক্ষপাত দেখানো থেকে সরে আসতে হবে।”

পিআরের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে দলের আমির বলেন, “আমরা বার বার বলছি যে, বিগত ৫৪ বছরে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে সেই পদ্ধতি দেশকে ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। এমন তিক্ত অতীতের বাস্তবতায় পুরোনো বন্দোবস্তে নির্বাচন করার কোন অর্থ হয় না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাই উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।”

দ‌লের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী ও অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম ও কেএমস আতিকুর রহমান, মুফতি মোস্তফা কামাল, কেএম শরীয়াতুল্লাহ।

সবুজদেশ/এসএএস