জীবনযুদ্ধে জয়ী কালীগঞ্জের এক যোদ্ধার হাতিয়ার এখন সুন্দরী কুল
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
লেখাপড়া শেখার প্রতি আগ্রহ ছিল কবিরুস সোবহানের। কিন্ত সে সময়ে কৃষক বাবার পরিবারে বাধা ছিল অভাব। তাই ইচ্ছা থাকলেও ৮ম শ্রেণী পাশের পর আর এগুতে পারেননি তিনি। বাধ্য হয়ে অন্য ভাইদের সাথে নামতে হয়েছে কৃষি কাজে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পৃথক হয়ে সংসার পাততে হয়েছে তাকে। তখন তার সম্পদ বলতে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া মাত্র দেড় বিঘা চাষের জমি। সে সময়ে অভাব তাকে জাপটে করার কারনে পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করতে হয়েছে। কিন্ত কখনও তিনি হতাশ হননি। বরং সংসারকে মনে করেছেন একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র। তাই দৃঢ় মনোবলকে পুঁজি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ হয়েছেন উপজেলার মধ্যে সফল ফল চাষী।
মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে তিনি মোট ১২ বিঘা জমি কিনেছেন। সুন্দর একটি বসতবাড়ি তৈরী করেছেন। ফল রাখার জন্য ১২ লাখ টাকা খরচ করে মাঠেই নির্মান করেছেন কোল্ড ষ্টোরেজ। বর্তমানে নিজের ও লিজ নেয়া মিলে মোট ২৪ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ফলের চাষ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে বল সুন্দরী ফলের চাষ করে ক্ষেতের কুল সকলের নজর কেড়েছে। অতীত ও বর্তমান জীবনের হিসাব নিকাশ মিলিয়ে এলাকার মানুষের কাছে তিনি জীবনযুদ্ধে জয়ী এক যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।
এমন সফল ফলচাষী ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর গ্রামের ওয়াহেদুস সোবহানের পুত্র।
সরেজমিনে কবিরুস সোবহানের ফল বাগানে গেলে দেখা যায়, মাটির সামান্য ওপর থেকেই সব কুলগাছের ডালপালা চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিনিটি ডালে প্রচুর পরিমানে কুল ধরে মাটিতে নুয়ে পড়ছে। অবস্থাটা এমন গাছের পাতার চেয়ে গাছে কুল বেশি দেখা যাচ্ছে। কুলগুলো দেখতে ঠিক অষ্ট্রেলিয়ান আপেলের মত। কিন্ত আকারে একটু ছোট। ক্ষেতের পাখি ঠেকাতে সারা ক্ষেতের উপর দিয়ে টানানো রশিতে বেধে দেয়া হয়েছে বিশেষ ধরনের বোতল। ক্ষেতের পাহারাদার ক্ষেতের মাঝখানের কুড়ের মধ্য থেকে রশি ধরে খানিক পর পর টানছে আর ছাড়ছেন এতে এক ধরনের শব্দ তৈরী হচ্ছে। এতে কোন পাখিই ক্ষেতের কুল নষ্ট করতে পারছে না।ওই মাঠের একটু দুরে আরেকটি ক্ষেতে রয়েছে একই জাতের কুল। সে ক্ষেতটিতেও একইভাবে চাষ করা হয়েছে বল সুন্দরী জাতের কুল। এ ক্ষেতটিতে কুলের ধরটা আরও বেশি। রঙটাও বেশ আকর্ষনীয়। এর পাশেই রয়েছে তার ড্রাগন ক্ষেত। এর অল্প দুরেই থাইল্যান্ডের-৫ ও ৭ জাতের পেয়ারা। পেয়ারা ক্ষেতের পাশেই রয়েছে থাইল্যান্ডের বারো মাসী জাতের আম। যেখানে ছোট ছোট আমগাছে মাটি থেকে একটু উপরে ছোট বড় আম ধরে আছে। আবার কিছু কিছু আম গাছে সবেমাত্র মুকুল আসছে। সকল ফলের ক্ষেতগুলোই আগাছামুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ক্ষেতের ফলগুলো এবং ক্ষেত দেখলে প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে।
ক্ষেতেই দেখা হয় কৃষক কবিরুস সোবহানের সাথে তিনি জানান,সাংসারিক জীবনে অভাবের তান্ডবে খুব কষ্ট করেছেন। কিন্ত তার বিশ্বাস ছিল পরিশ্রম করেই সফল হবেন। অর্থ না থাকলেও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ২০০০ সালে প্রথমে কিছু ধারদেনার মাধ্যমে নিজের দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ শুরু করেন। লাভ পেয়ে এ চাষেই জমি বর্গা নিয়ে ফুলচাষ বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১২ বছর ফুলের চাষের মাধ্যমে বেশ সফল হন তিনি। এরপর ফলচাষে আরও সফলতা ধরা দেয়। তিনি বলেন, বর্তমানে তার সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে এ এলাকার জন্য প্রথম বল সুন্দরী জাতের কুল, ১০ বিঘা থাই পেয়ারা, ৩ বিঘা জমিতে ড্রাগন, ৩ বিঘা জমিতে বারোমাসী জাতের আমের চাষ রয়েছে। কৃষক কবিরুস সোবহানের ভাষ্য, এ পর্যন্ত জীবনে যত ফল ও ফসলের চাষ করেছেন প্রায় সবগুলোতেই লাভবান হয়েছেন। কিন্ত বেশি সাড়া জাগিয়েছে বল সুন্দরী জাতের কুলে। ক্ষেতে যে পরিমানে কুল ধরেছে তা দেখতে মানুষ আসছে। অন্য কৃষকেরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। তিনি আরও বলে, মাত্র ১৪ মাস আগে যশোরের ঝুমঝুমপুর থেকে বল সুন্দরী জাতের কুলের চারা প্রতিপিচ ৫০ টাকা দরে ৬’শ চারা কিনে সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে রোপন করেন। এ বছরই সব কুৃলগাছগুলোতে কুল ধরেছে। কুলের শাখা প্রশাখায় তারার মত ধরে আছে। অবস্থাটা এমন পাতার চেয়ে কুল বেশি। এ উপজেলায় অনেক জাতের কুলচাষ হয়েছে কিন্ত বল সুন্দরী জাতের কুলচাষ এই প্রথম। এ জাতের কুলের আকার রঙ ও ধরার দৃশ্যটা বেশ ভিন্ন। বল সুন্দরী কুৃল দেখতে অষ্ট্রেলিয়ান ছোট আপেলের চেয়ে একটু ছোট। কিন্ত স্বাদে কড়া মিষ্টি। কুল বয়সে পরিপূর্ণ হয়নি। এখনও কমপক্ষে ২০ দিন পরে ক্ষেতের কুল বিক্রি উপযোগী হবে। কয়েক দিন আগে সারাক্ষেত একটু আগে ধরা অল্প কিছু কুল স্থানীয় কালীগঞ্জ শহরে বিক্রি করতে এনেছিলেন। অন্যান্য জাতের কুল বাজারে ২০/২৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও তার বল সুন্দরী কুল স্বাদের জন্যই প্রতিকেজি ৮০ টাকা দরে বিক্রি করতে পেরেছেন। ফলে তিনি বুঝতে পারছেন এ কুল থেকে বেশ লাভ আসবে। তার আশা,সাড়ে সাত বিঘা কুল থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা আসবে। এ বাগান থেকে কমপক্ষে ৫/৬ বছর ভালোভাবে কুল পাবেন।
এছাড়াও বারোমাসী আম, ড্রাগন ও পেয়ারা মিলে এ বছর কমপক্ষে ৬০ লাখ টাকা আসবে বলে মনে করছেন। তিনি আরও জানান, মাঠে নিজের ১২ বিঘা আর বাকি জমি প্রতিবিঘা বছরে ১২ হাজার টাকায় দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তিতে নেয়া জমিতে চাষ এ সকল ফলের চাষ করেছেন। এরমধ্যে বল সুন্দরী কুল সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। কৃষক কবিরুস সোবহান আরো জানান, তার ফল বাগানে মাসিক বেতন চুক্তিতে মোট ১৪ জন লোক সারা বছর কাজ করে তারাই বাগান টিকিয়ে রাখে। কোন কোন সময় বাজারজাতও তারা করেন। তারা অনেক ভালো বলেই বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। বিনিময়ে তাদের সুযোগ সুবিধাগুলোও নিজের মত করে দেখা লাগে।
তার ফল বাগান তদারকির দায়িত্ব পালনকারীদের একজন ওই গ্রামের পরিতোষ দাস জানান, দীর্ঘ ১৮ টি বছর তার সাথে আছি। আমরা ১৪ জন শ্রমিক সারাবছরের জন্য তার ফল বাগানে কাজ করি। বাগান মালিকের ভাষ্য, বাগানগুলো নিজেদের মনে করে ভক্তি রেখো। আমরা শ্রমিক হলেও আমাদেরকে সেই দৃষ্টিতে দেখেন না। বিশ্বাসের কারনেই তিনি ফলের বাজারজাত থেকে শুরু করে অনেক কাজের জন্য তিনি আমাদেরকে পাঠান। সাথে সাথে সাংসারিকভাবে কেউ কোন বিপদ আপদে পড়লে অভিভাবকের মত পাশে থাকেন। ফলে আমরা শ্রমিক হলেও বাগানগুলো আমাদের মনে করে দরদ দিয়ে কাজ করি। আর মালিক শুধু ব্যবস্থাপনায় থাকেন।
উপজেলোর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান জানান, এ এলাকায় যেন ফলের বিপ্লব ঘটে গেছে। কবিরুস সোবহান অনেক পরিশ্রম করে বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষ করেছেন। তার মধ্যে বল সুন্দরী কুল যেভাবে গাছে ধরে আছে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, কয়েকদিন আগে তিনি কবিরুস সোবহানের বল সুন্দরী কুলসহ তার সকল ফলের বাগান ঘুরে এসেছেন। যেভাবে কুল ধরে আছে তা দাড়িয়ে দেখার মত। তিনি বলেন, ফলচাষী কবিরুস সোবহান নিজে এক সময়ে কষ্ট করেছেন। আর এখন হয়েছেন এলাকার মধ্যে একজন আদর্শ কৃষক। কৃষি কাজ করে যে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানো যায় এ কৃষক তার উদাহরন। প্রচন্ড ধর আসা কড়া মিষ্টির বল সুন্দরী কুল তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে যোগ করেন এই কৃষিবিদ।