জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচান কক্সবাজারের লাইফগার্ডরা
আবদুল শুক্কুর কথা বলছেন, কিন্তু তাঁর নজর সমুদ্রের দিকে। গোসল করতে নেমে কে না আবার ডুবে যায়। ডুবে না গেলেও ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে অনেকে। তাঁর দায়িত্বই হলো নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের জীবন বাঁচানো। তিনি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে জ্যেষ্ঠ লাইফগার্ড হিসেবে কাজ করছেন।
গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচে কথা হয় আবদুল শুক্কুরের সঙ্গে। জানালেন, সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত মোট ২৬ জন লাইফগার্ড কাজ করছেন। লাবণী, কলাতলী ও সুগন্ধা বিচে সিসেইফ লাইফগার্ড সার্ভিস দিচ্ছেন তাঁরা। ঈদসহ যেকোনো বিশেষ দিবসে সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে গেলে লাইফগার্ডদের সঙ্গে ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবকও যোগ দেন এ কাজে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের অধীনে আবদুল শুক্কুরসহ অন্যরা কাজ করছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন এ কাজে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১৪ সালের মে মাস থেকে প্রকল্প হিসেবে সিসেইফ লাইফগার্ড সার্ভিস চালু করা হয়েছে। তখন থেকে এ পর্যন্ত মোট ২৬৭ জনকে সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন কর্মীরা। এখন পর্যন্ত লাইফগার্ডেরা যে নির্দিষ্ট জায়গায় কাজ করেন, সেই এলাকায় কেউ ডুবে মারা যায়নি। তবে ২০১৫ সাল থেকে কর্ম এলাকার বাইরে ১৭ জন পর্যটক এবং স্থানীয় জনগণসহ মোট ২২ জন সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন। এ তথ্য নিজেই সংগ্রহ করেছেন বলে জানালেন ইমতিয়াজ।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সম্প্রতি সিসেইফের কর্ম এলাকার বাইরে ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সী এক তরুণ শিক্ষার্থী সমুদ্রে ডুবে মারা যান। সিসেইফের কর্মীরা উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
ইমতিয়াজ আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, পর্যটকেরা একটু সচেতন হলেই ডুবে মারা যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। সমুদ্রে নামার আগেই নিয়মগুলো জানতে হবে। জোয়ার-ভাটার হিসাব রাখতে হবে। লাইফগার্ড সার্ভিস আছে কি না, তা দেখে নামতে হবে।
বুধবার সকালে সুগন্ধা বিচে গিয়ে দেখা যায়, আবদুল শুক্কুর ও তাঁর দলের সদস্যরা নির্দিষ্ট সীমানায় স্ট্যান্ডের মধ্যে লাল ও হলুদ কাপড়ের দুটি পতাকা গর্ত করে পুঁতে দিলেন। দুই পতাকার ভেতরের জায়গাটিতে পর্যটকেরা অনেকখানি নিশ্চিন্তেই গোসল করতে পারেন। এখানে কোনো ঘটনা ঘটলে, তা কর্মীদের নজর এড়াবে না। আর সাদা ক্যাপ মাথায় লাল হাফপ্যান্ট ও হলুদ টি-শার্ট গায়ে দেওয়া কর্মীরা গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে টহল দিচ্ছেন। উঁচু টাওয়ারে বসে আবদুল শুক্কুর চারপাশে নজর রাখছেন। এই নিরাপদ দূরত্বের বাইরে যাঁরা গোসল করতে নেমেছেন, তাঁদের বিভিন্নভাবে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা পতাকার সীমানাও পরিবর্তন করছেন।
অন্যদের বাঁচানোর জন্য এই কর্মীদের কাছে বলতে গেলে তেমন কোনো সরঞ্জাম নেই। তারপরও এই কর্মীরা পিছপা হন না। প্রশিক্ষণের দক্ষতাকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগান বলে জানালেন জুনিয়র লাইফগার্ড সাদেক উদ্দিন। আরেকজন লাইফগার্ড আদ্রাম ত্রিপুরাও কাজের ফাঁকে একই কথা জানান।
এ কাজের চ্যালেঞ্জ হিসেবে লাইফগার্ড কর্মকর্তারা জানালেন, তিনটি বিচ ছাড়া অন্য জায়গায় জেলা প্রশাসনের অনুমোদন না থাকায় লাইফগার্ডের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। রাতের বেলায় যাঁরা গোসল করতে নামছেন, তাঁরাও ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন। পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি তো আছেই। তবে যখন কাউকে বাঁচানো সম্ভব হয়, তখনকার যে অনুভূতি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আর পরিবারের একজন সদস্যকে বাঁচানোর অর্থ হলো, পুরো পরিবারটিকে একটি দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচানোর মতোই।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বিভিন্ন সাইনবোর্ডে সমুদ্রে নামার নিয়মাবলি লেখা আছে। জেলা প্রশাসন এবং বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির পক্ষ থেকেও প্রচার করা হচ্ছে নানান সতর্কবার্তা। আর পর্যটন পুলিশের টহলও আছে। কোনো কোনো এলাকায় রবি লাইফগার্ড এবং ইয়াছির লাইফগার্ডের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।
বিভিন্ন সাইনবোর্ডের সতর্কবার্তা অনুযায়ী, গুপ্ত খাল, খাড়া পাড়, বড় ঢেউ, স্পিডবোট ও জেটস্কি এবং অগভীর বালুর গর্ত থেকে সাবধান থাকতে হবে। ইঞ্জিনচালিত যান চলাচলের এলাকায় সাঁতার কাটা যাবে না। লাল-হলুদ পতাকার মাঝখানের এলাকায় সার্ফিং করা যাবে না। গোসলে নামার আগেই জোয়ার–ভাটার সময় জেনে নামতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাটার সময় গোসল করা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আর এক হাঁটু পানির নিচে না নামাই শ্রেয়।